Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

অরণ্যের অধিকারী

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

জুলাই ২৭, ২০২৩

urban wildlife in the US
urban wildlife in the US
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

কলামের অন্যান্য পর্ব:  [] [] [] [] [] [] [] [] []

আমাদের শহরে গত দু-তিন মাসে মোট চারটি ভাল্লুক, সপরিবারে ঢুঁ মেরে গেছে। এদের সঙ্গে সার্কাস পার্টির কোনও সম্পর্ক নেই। ডুগডুগির তালে তালে পথেঘাটে পা তুলে তুলে নেচে বেড়ানোরও ট্রেনিং নেই। আচমকা শুয়ে পড়ে ভাল্লুকের জ্বরে কাঁপতে থাকার কায়দাও শেখেনি। এরা একেবারে সোজা বন থেকে বেরিয়ে পড়ে একা নয়তো ছানাপোনা নিয়ে উদাসভাবে হাঁটতে হাঁটতে এসে হাজির। কিছুদিন আগে আমাদের পাশের শহর রিভারডেল্-এ একটা বিশাল কালো ভাল্লুক ত্রিশ ফুট উঁচু গাছে চার হাত-পা জড়িয়ে বসেছিল। খবর পেলাম কাছাকাছি ওকল্যান্ড শহরে কাদের বাড়ির বাগানে ঢুকে দুটো খুদে ভাল্লুক সে বাড়ির জার্মান শেপার্ডের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে। তাদের মুটকি মায়ের সঙ্গে বাঘা কুকুরের একচোট হাতাহাতি, কামড়াকামড়িও হয়েছে।

প্রতি বছর শীত শেষ হলেই কাছাকাছি জঙ্গল “ব়্যামাপো ফরেস্ট” (Ramapo Mountain State Forest) থেকে খাবারের সন্ধানে এরা লোকালয়ে চলে আসে। এখনও তাদের চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা হয়নি বটে। তবে টিভিতে স্থানীয় সংবাদে তাদের আনাগোনার খবর প্রায় রোজ দেখছি। কখনও হাইওয়ের চলন্ত ট্র্যাফিকের মাঝে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাল্লুক! কখনও শপিং সেন্টারে বিশাল পার্কিং লটে আনমনে হাঁটছে। আমার বন্ধু ফ্র্যান্সিস সেলস্ থাকে কাছের শহর পমটম লেকসে। ওর প্রতিবেশীর বাগানে ঢুকে গারবেজ ক্যানের ঢাকনা খুলে এক ভাল্লুক মা উৎসাহে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। সারা পাড়ার লোক ফোনে ফোনে বার্তা পেয়ে যে যার রান্নাঘরের জানলা ধরে স্ট্যাচু! ফ্র্যান্সিস আমাকে ছবিও পাঠাল। একটু পরে বিফলমনোরথ ভাল্লুক ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেল। পার্ক রেঞ্জাররা খবর পেয়ে এসে পাড়ার লোকেদের উপদেশ দিয়ে গেল—ক্ষুধার্ত ভাল্লুকদের সামনে ফেলে দেওয়া খাবারদাবার শুদ্ধু গারবেজ ক্যান বাইরে রাখবেন না। গ্যারাজে বন্ধ করে রাখবেন। 

Ramapo Mountain State Forest
এই ব়্যামাপো ফরেস্ট থেকেই প্রতি বছর হানা দেয় ভালুক

নিউজার্সির উত্তর অংশে পাহাড় জঙ্গলে ভাল্লুকদের বহুকালের বসবাস। বনবিভাগের হিসেব অনুযায়ী কাছাকাছি কয়েকটি রিজার্ভেশন মিলিয়ে প্রায় সাত-আটশো ভাল্লুক আছে। এখান থেকে পনের মাইল উত্তরে গেলেই তাদের সাম্রাজ্য শুরু হয়ে যায়। ওদের কাছে নাকি পনেরো, কুড়ি মাইল হাঁটা কোনও ব্যাপারই নয়। শীতকালের শেষে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ হলে মাঝে মাঝে পদব্রজে বেরিয়ে পড়া আর লেকের জলে নেমে মাছ ধরা, লোকালয়ে হানা দিয়ে খাবারদাবার হাতানোর চেষ্টা—এসব ওরা বরাবরই করে আসছে। 

ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে শহরে ভাল্লুক এসেছে শুনে বিশ্বাসই হত না। তারপর স্থানীয় খবরের কাগজে হুমদো ভাল্লুকের ছবি আর টিভিতে তার গাছের মগডাল জড়িয়ে বসে থাকা, তার গড়াগড়ি দেওয়া, ঘুমের ওষুধ মাখানো তীর খেয়ে ঘুমঘোরে চ্যাংদোলা অবস্থায় ফরেস্ট রেঞ্জারের গাড়িতে উঠে অরণ্যে ফিরে যাওয়া—এসব দেখতে দেখতে আর অবাক হই না। আমাদের ভয় পাওয়াও বারণ! তাতে নাকি ধেয়ে আসা ভাল্লুকের বিপদ হতে পারে! ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে আর “অ্যানিমাল অ্যাকটিভিস্টরা” বলে দিয়েছে— ভাল্লুককে ধারেকাছে দেখলে ভয় পাবে না! তাকে ভয় দেখাবে না। সে লোকালয়ে আসতেই পারে। একে তো শীতের শেষে তাদের জমা খাবারের স্টক শেষ। মরা ডালে ফলপাকুড়ও ধরেনি। লেকের জলে জমে বরফ না হলেও মাছ ধরা শক্ত। তখন ভাল্লুক পেটের দায়ে শহরে আসবে না? ভাল্লুক এলেও তোমাদের বুকে জাপটে ধরছে না। আপন মনে পথেঘাটে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে। বড় জোর খরগোশ, নয়তো পোষা ছোটখাটো কুকুর, বেড়াল কামড়ে নিয়ে পালাচ্ছে। 

bear crossing highway
হাইওয়ে পেরচ্ছে নির্লিপ্ত ভালুক

হাইওয়েতে খুব সাবধান! তাকে চাপা না দিয়ে গাড়ি নিয়ে কেৎরে বেরিয়ে যাবে। হাঁটা পথে মুখোমুখি হলে তুমিও সহজভাবে হেঁটে চলে যাবে। তোমার গায়ে তো আর মহুয়ার গন্ধ নেই, যে বুনো ভাল্লুক তোমাকে খেয়ে মাতাল হবার তাল করবে। বাড়ির গারবেজ ক্যানে কখনও বাসি খাবার জমিও না। ভাল্লুকের প্রলোভন হতে পারে। তখন সে পেটের জ্বালায় সে সব টেনে টেনে বের করতে চাইলে তাকে ঢিল মারা, চ্যালাকাঠ ছুঁড়ে মারার চেষ্টা তো করবেই না। তাতেই বরং সে ধেয়ে এসে তোমার সঙ্গে কোলাকুলি করতে চাইবে। বন্দুক চালালে তো নির্ঘাৎ তোমার জেলখানার রুটি বরাদ্দ হয়ে যাবে। 

তবে তোমার কর্তব্য কী? শহরের পার্ক অ্যান্ড রিক্রিয়েশন বিভাগকে ফোন করে ভাল্লুক সংবাদ জানিয়ে দেওয়াই নাগরিকের একমাত্র দায়িত্ব। তারপর তাদের কর্মীরা রেডিও মেসেজ, মেল্ ফোন, ফার্স্ট এইড বক্স ইত্যাদি নিয়ে ঘুমপাড়ানি ওষুধ সহযোগে কাজে নেমে পড়বে। দূর থেকে পটাশ করে ওষুধের তীর মেরে দিলেই ভাল্লুক ধরাশায়ী। তখন রেঞ্জারদের সাহস দেখে কে? ঢলে পড়া ধুমশো ভাল্লুকের মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে একজন। ধুমসি মা আর তার ছানাপোনা ধরাশায়ী হলেও একই ব্যবস্থা। অন্যজন ভাল্লুকের কানের সঙ্গে সেলাই করা নম্বর দেখে মিলিয়ে নিচ্ছে সে কোন্ বন থেকে এসেছে। রেকর্ড মিলিয়ে দেখা হচ্ছে তার জীবনী। ইতিহাস, ওজন, লোমের ঘনত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি হিসেব মতো মিলছে কিনা। তারপর উৎসাহী দর্শককূলের সামনে দিয়ে তাকে চ্যাংদোলা করে ভ্যানে তুলে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়া। ঘণ্টা দুই পরে তন্দ্রা কাটলে ভাল্লুক দেখবে সে আবার নিজের ডেরায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। অবশ্যই পর্যাপ্ত ফলমূল, মাছ, রুটি ইত্যাদি বস্তা করে রেখে আসবে ফরেস্ট রেঞ্জাররাই। সাধারণত একবার লোকালয়ে অভিজ্ঞতার পরে সে বছরে আর সে হানা দেয় না। 

ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে শহরে ভাল্লুক এসেছে শুনে বিশ্বাসই হত না। তারপর স্থানীয় খবরের কাগজে হুমদো ভাল্লুকের ছবি আর টিভিতে তার গাছের মগডাল জডিয়ে বসে থাকা, তার গড়াগড়ি দেওয়া, ঘুমের ওষুধ মাখানো তীর খেয়ে ঘুমঘোরে চ্যাংদোলা অবস্থায় ফরেস্ট রেঞ্জারের গাড়িতে উঠে অরণ্যে ফিরে যাওয়া—এসব দেখতে দেখতে আর অবাক হই না। আমাদের ভয় পাওয়াও বারণ! তাতে নাকি ধেয়ে আসা ভাল্লুকের বিপদ হতে পারে!

একবার স্থানীয় টিভি চ্যানেলের সামনে রেঞ্জারদের সঙ্গে একদল মায়ের তুমুল ঝগড়া লেগেছিল। এভাবে হঠাৎ হঠাৎ ভাল্লুক হানা দিলে বাচ্চাদের বিপদ হতে কতক্ষণ? কেনই বা কাছাকাছি জঙ্গল থেকে সবকটাকে আমেরিকার জনবিরল গ্রামাঞ্চলে চালান করে দেওয়া হচ্ছে না? ক্রমশ বনজঙ্গল কেটে ফেলে নতুন নতুন শহর গড়ে উঠছে। লোকালয়ের পরিধি বেড়ে চলেছে। উত্তর নিউজার্সির বাসিন্দাদের প্রাণের কথা ভেবেও জঙ্গল থেকে ভাল্লুক, কয়োটিদের (coyote) বাস ওঠানো দরকার। কিন্তু রেঞ্জার থেকে শুরু করে পশুপ্রেমী দল কেউ কিছুতেই মানতে রাজি নয় যে, ভাল্লুক কাউকে খুন করতে আসে। তাদের এক কথা—ভালুক জানে বাসতে ভাল। 

তবে ইদানীং রাজ্য সরকারের টনক নড়েছে। গত আট-দশ বছরে ভাল্লুকের বংশবৃদ্ধি হতে হতে তারা আর বনজঙ্গলের সীমানা মানছে না। কোথাও সুপার মার্কেটের স্লাইডিং ডোর দিয়ে ঢুকে মাছ, মাংস তুলে নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। লোকজনদের আঁচড়ে, খিমচে, মোটা মোটা থাবার বাড়ি মেরে ফেলে দিচ্ছে। কারওর বাড়ির পিছনের রান্নাঘরের দরজা খোলা পেয়ে রেফ্রিজারেটর খুলে হামলে পড়ছে। বাড়ির লোকজন সামনের দরজা খুলে পালিয়েছে। এরা আমেরিকার সেই ভয়ঙ্কর গ্রিজলি বেয়ার (grizzly bear) না হলেও বড় বড় বুনো ভাল্লুক তো বটে। ইদানীং তাদের হিংস্র আচরণও বাড়ছে। প্রায় প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে মধ্য আর দক্ষিণ নিউজার্সির কোনও কোনও জঙ্গলে আগুন লাগে। ফরেস্ট ফায়ারের দাউ দাউ আগুনে মাইলে পর মাইল বনজঙ্গল ধ্বংস হয়ে যায়। বাস্তুহারা বন্য প্রাণীর তখন লোকালয়ই ভরসা। 

urban wildlife in the US
কোথাও জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে চলে আসে নেকড়ে

লোকজন নেই। সুইমিং পুল, লেক-এর জলে দল বেঁধে লোকজন স্নান করতে নামে না। কোথাও কার্নিভ্যাল, মেলা বসে না। এমন জনমানবহীন পরিবেশ দখল করতে তারা দলে দলে ধেয়ে আসতে লাগল। খাবারের অভাবে আরও বেশি আক্রমণাত্মক আচরণ বাড়তে থাকল। সবচেয়ে বিপদে পড়ল ফুড ডেলিভারি কোম্পানির লোকজন। হয় ফুড ট্রাক খোলা পেয়ে খাবারদাবার বগলদাবা করে বেরিয়ে যাচ্ছে, নয়তো ডেলিভারিম্যানদের তাড়া করছে। কোভিডের কারণে বহুদিন পর্যন্ত ছোট, বড় রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। বাইরে টেবিল, চেয়ার সাজিয়ে, প্রয়োজনে কাছাকাছি রুম হিটার জ্বালিয়ে রেখে, মালিকরা রেস্তোরাঁ চালু রেখেছিলেন। আমরাও সেখানে মাঝে মাঝে লাঞ্চ, ডিনার খেতে গেছি। কিন্তু সেখানেও গন্ধে গন্ধে ভাল্লুক চলে আসছিল। বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে টেবিল, চেয়ার, গারবেজ ক্যান উল্টে দিয়ে তছনছ করছিল। 

এই যখন অবস্থা “ডিফেন্ডার অফ্ ওয়াইল্ড লাইফ”-এর প্রচণ্ড প্রতিবাদ, আন্দোলন সত্ত্বেও নিউজার্সির গভর্নর মার্ফি ভাল্লুক নিধনের অর্ডার দিলেন। রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে “বেয়ার হান্টিং” শুরু করতে হবে। একটা হিসেব অনুযায়ী প্রায় দেড় মাস ধরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের শ্যুটার আর শখের শিকারিরা গুলি চালিয়ে প্রায় একশো চোদ্দখানা ভাল্লুক মেরেছে। কিন্তু তার বউ, বাচ্চাদের মারা চলবে না। সেই সব করুণ দৃশ্যও টিভিতে দেখাচ্ছিল। পশুপ্রেমীদের পোস্টার হাতে প্রতিবাদ, করুণ আবেদন, কান্নাকাটি সত্ত্বেও বাস্তুহারা অরণ্যের অধিকারীদের মৃত শরীরগুলো ট্রাকে চাপিয়ে কোথায় যে নিয়ে গেল! 

এদিকে ভাল্লুক নিধন তো, ওদিকে নেকড়ে বাঘের জন্যে হামদর্দ! ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস আর “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ” দল মিলে “নেকড়ে বাড়াও” অভিযানের জিগির তুলেছে। ইয়োলোস্টোন আর আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলের বনজঙ্গলে নেকড়ের বংশবৃদ্ধি হওয়া নাকি বিশেষ জরুরি। কিন্তু সেখানকার খেত-খামারের মালিকরা রেগে খুন! হাঁস, মুরগি, শুয়োর, গরু, বাছুর, ভেড়া প্রতিপালন করতে গেলে নেকড়ের অত্যাচার সহ্য করা যায়? নেকড়ের বংশবৃদ্ধি মানে তো বাছুর, ভেড়াদের দলে দলে স্বর্গপ্রাপ্তি। নেকড়ে, বাঘের শাখা-প্রশাখা বব ক্যাট, মাউন্টেন লায়ন, কুগার (cougar) এদেশের পশ্চিমের পাহাড়ে, জঙ্গলে ক্রমশই বংশবিস্তার করছে। ক্যালিফোর্নিয়ার নানা শহরের উপকণ্ঠে আচমকা উদয় হয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ক’দিন আগে হলিউডের বিখ্যাত রাস্তা সানসেট বুলেভার্ডেও একটা মাউন্টেন লায়ন ল্যাজ দুলিয়ে ঘুরে গেছে। অভিজাত পাড়ায় পোষা কুকুর, বেড়াল আর সেলিব্রিটিদের দেখা না পেয়ে ঝোপজঙ্গল পার হয়ে পালিয়েছে।

cougar in California
জঙ্গল পেরিয়ে প্রায়ই লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায় কুগার (cougar)

এবার হিংস্র প্রাণীদের কথা থাক। আমাদের পাড়ার অহিংস বাসিন্দাদের খবর দিই। একজনের বাড়ির পেছনের বাগানে লাল শেয়ালগিন্নির চারটে বাচ্চা জন্মেছে। এই ছোট ছোট রেড-ফক্সগুলোকে আগে বিশেষ দেখতে পেতাম না। কোভিডের মরশুমে নির্জন রাস্তাঘাট পেয়ে কাছাকাছি পার্কে, ঝোপঝাড়ে আস্তানা গেড়েছে। আমেরিকায় এই প্রথম দূর থেকে মাঝে মাঝে রাতে শেয়ালের ডাক শুনেছি। এখন তাদের বংশ বিস্তারের খবর দিয়ে একজন ছবি পাঠিয়েছে। আমাদের বাড়িতে মানুষ বলতে আমরা দু’জন। বাগানে কাঠের ডেক্-এর নীচে বহুদিন ধরে আস্তানা গেড়েছে একজোড়া গ্রাউন্ড হগ (ground hog)। গেরুয়া রং-এর লোমওলা হোঁৎকা ভোঁদড়ের মতো মুখ। লম্বা ল্যাজ। বেঁটে বেঁটে পা ফেলে ঘাসের মধ্যে কি জানি কী খেয়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে আনমনে রোদ পোহায়। আবার ডেক্-এর নীচে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢুকে যায়। বছর বছর শীতকালে বরফ-ঝড় হয়। তাও দিব্যি টিকে আছে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় ওরা এত বছর বাঁচে নাকি? কে জানে এ দুটো আগের গ্রাউন্ড হগ দুটোর বংশধর কিনা। আমেরিকায় এদের উৎপত্তি নাকি বহু বছর আগে হয়েছিল। প্রচলিত গল্প আছে—গ্রাউন্ড হগ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে যদি নিজের ছায়া দেখতে পায়, ভয়ে পেয়ে তখনই নাকি গোপন আস্তানায় ফিরে গিয়ে দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকে। ২রা ফেব্রুয়ারি হচ্ছে “গ্রাউন্ড হগ ডে”। সচরাচর ওই সময় ওরা বেরিয়ে এসে দর্শন দিলে লোকে মনে করে আর ছ’সপ্তাহ পরে শীতকাল শেষ হবে। আমিও কিন্তু এ বছর ওইরকম এক সকালেই হৃষ্টপুষ্ট প্রাণী দুটোকে হঠাৎ চরে বেড়াতে দেখলাম। 

একজনের বাড়ির পেছনের বাগানে লাল শেয়ালগিন্নির চারটে বাচ্চা জন্মেছে। এই ছোট ছোট রেড-ফক্সগুলোকে আগে বিশেষ দেখতে পেতাম না। কোভিডের মরশুমে নির্জন রাস্তাঘাট পেয়ে কাছাকাছি পার্কে, ঝোপঝাড়ে আস্তানা গেড়েছে। আমেরিকায় এই প্রথম দূর থেকে মাঝে মাঝে রাতে শেয়ালের ডাক শুনেছি। এখন তাদের বংশ বিস্তারের খবর দিয়ে একজন ছবি পাঠিয়েছে। আমাদের বাড়িতে মানুষ বলতে আমরা দু’জন। বাগানে কাঠের ডেক্-এর নীচে বহুদিন ধরে আস্তানা গেড়েছে একজোড়া গ্রাউন্ড হগ।

এবার আসি তৃতীয় বাসিন্দাদের কথায়। হরিণের চারণভূমি বলতে যা বোঝায়, আমাদের বাড়িটুকু বাদ দিয়ে আশপাশের সবটুকুই তাই। রাস্তার ওপারে বড় বড় গাছে ঘেরা বেশ অনেকখানি জমি আছে। কিন্তু সেখানকার বিশাল বিশাল মাথা উঁচু সরলবর্গীয় গাছের ডালপালার তারা নাগাল পায় না। কাঁটাঝোপ আর ঘাসেও বোধহয় অরুচি। সাজানো বাগান তো নেই। তার ফলে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মতো আঁকাবাঁকা শিং-এর ডালপালা নিয়ে সদলে, সপরিবারে হরিণবাহিনী আমাদের জমিতে উঠে আসছে। ফুলের বাগান করা ছেড়ে দিয়েছি। রাতারাতি ফুলগাছগুলো মুড়িয়ে খেয়ে চলে যেত! আমাদের মালি বুদ্ধি দিয়েছিল—“আইরিশ স্প্রিং নামের কড়া ডিটারজেন্টওলা গায়ে মাখা সাবান সুতো বেঁধে ফুলগাছে ঝুলিয়ে দাও। হরিণ পালাবে। আধডজন সাবান কিনে এনে সামনের, পেছনের বাগানে ফুলগাছে সুতো দিয়ে জড়িয়ে রাখলাম। কোথায় কী? সাবান গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমার চোখের সামনে হরিণ দুটো চোখ বুঁজে ফুল চিবিয়ে চলে গেল। তাও হাল ছাড়িনি। আর একজন বুদ্ধি দিল—কোনও গাছ, বীজ আর সারের দোকানে চলে যাও। বোতলভর্তি শেয়ালের “হিসি” কিনতে পাওয়া যায়। সেই কড়া প্রস্রাব ফুল গাছে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। শেয়ালের হিসি নিয়ে ফুলগাছে জলাঞ্জলির প্রবৃত্তি হল না। হরিণ তাড়ানোর এমন পদ্ধতি শুনে ফুলবাগিচার আশা ত্যাগ করলাম। 

ফুল ফুটুক না ফুটুক, হরিণ দেখে দেখেই আমার দিন কেটে যায়। এক মেঘলা সকালে পেছনের বাগানে দেখলাম হরিণীর প্রসন্ন মাতৃমূর্তি। তিনটে ছোট ছোট হরিণ, গায়ে সাদা ফোঁটার মতো ছাপ, লাফিয়ে লাফিয়ে মায়ের দুধ খেতে ব্যস্ত। একচিলতে সাদা লেজ টুকটুক করে নড়ছে। মা গলা উঁচু করে আপনমনে ওক্ গাছের পাতা চিবিয়ে খাচ্ছে। 

খাদ্যসংস্থানের যদি এমন ব্যবস্থা থাকে, বাগানের স্প্রীঙ্কলারের ফোয়ারার মতো জলে গা ভিজিয়ে চান করা যায়, পান করা যায়, যদি বাড়ির কুকুরের সগর্জন আক্রমণ না থাকে, তবে আর বনবাসে কে যায়? বাড়ির বাসিন্দারা যদি বেশি রাতে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় নিজেদের ড্রাইভ-ওয়েতেই দেখেশুনে ওঠে, অন্ধকারে বসে থাকা হরিণদের জ্বলজ্বলে চোখগুলোর ওপর হেডলাইট জ্বেলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে থাকে, ওরা উধাও হবার পর গ্যারাজে গাড়ি ঢোকায়, তবে ওদের ভয় কীসের? মাঝে মাঝে দুপুরবেলা আমাদের সামনের দরজার বাইরে ছোট চত্বরে, নয়তো সিঁড়িতে বসে অপলক চেয়ে থাকে। 

এইসব নিয়েই আছি। এ বাসভূমিতে একজন শকুন্তলা ছিল। সে কবেই পতিগৃহে চলে গেছে। অনসূয়া, প্রিয়ংবদা কেউ নেই। তাদের সাহচর্য্য না থাক, কেমন এক সহজাত নিরাপত্তাবোধে বনের হরিণের দল এখানেই আশ্রয় খুঁজে নিল। ওরা কি ইংরিজিতে লেখা বাড়ির ঠিকানা অনুমান করেই এসেছে? আমাদের ঠিকানা—৩১ নম্বর পার্ক উড ড্রাইভ!

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Picture of আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
Picture of আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com