(Kaifi Azmi) বাংলাদেশ তখনও পাকিস্তানের অংশ। উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সেখানে গড়ে উঠছে মুক্তিকামী মানুষের ঐক্য। শাসকের বেয়নেটের সামনে শহিদের মৃত্যুবরণ করছেন সে দেশের তরুণরা। সেই বিদ্রোহই ভাষা পেল ভারতবর্ষের এক উর্দু কবির কলমে, ভাষা পেল বেদনার মর্মন্তুদ সুর, জন্ম হল ‘বাংলাদেশ’ কবিতার। (Kaifi Azmi)
আবার ‘কর চলে হাম ফিদা জান-ও-তন সাথিয়ো, অব তুমহারে হাওয়ালে ওয়াতন সাথিয়ে,’ চেতন আনন্দের ‘হকিকৎ’ ছবিতে মহম্মদ রফির কণ্ঠে এই গান, বা ‘পাকিজা’ ছবির ‘চলতে চলতে ইউহি কোয়ি মিল গয়া থা’ কিংবা ‘ঝুকি ঝুকি সি নজর’-এর মতো কালজয়ী গানেরও তিনিই স্রষ্টা। তিনি কবি, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও সর্বোপরি মানবতাবাদী শিল্পী কাইফি আজমি। আসল নাম সৈয়দ আতাহার হোসেন রিজভি, কিন্তু পরিচিত হলেন কাইফি আজমি নামেই। (Kaifi Azmi)
১৯১৯-এর ১৪ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ের এক জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। কিন্তু অল্প বয়সেই জমিদারির গন্ধ ঝেড়ে ফেলে, লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে। ১৯৪৩ সালে যোগ দিলেন অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআইতে। আলি সরদার জাফরি সম্পাদিত উর্দু মুখপত্র ‘কউমি জং’-এ শুরু হল লেখালেখি। (Kaifi Azmi)
পরের বছর ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হল কাইফি আজমির প্রথম কাব্যসংকলন ‘ঝংকার’। সেই থেকে নারী অধিকারের পক্ষে, জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে বারংবার গর্জে উঠেছে তাঁর কলম। বিদ্রোহ ও কবিতা একাকার হয়ে উঠেছিল তাঁর মননে। উর্দু, ফারসি ও হিন্দি তিন ভাষাতেই ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘আখিরে-শব’, ‘আওয়ারা সাজদে’, ‘মেরি আওয়াজ শুনো’, ‘ইবলিস কি মজলিস-এ শোরি’ প্রভৃতি। (Kaifi Azmi)
ভিডিও: সুরের জাদুকর শ্যামল মিত্র – জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য
কবিতার পাশাপাশি ১৯৫২ সালে প্রবেশ করেন চলচ্চিত্র জগতে। শহীদ লতিফের ছবিতে গান লেখার মধ্যে দিয়ে অচিরেই হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় গীতিকার। ‘শামা’, ‘কাগজ কি ফুল’, ‘শোলা অউর শবনম’, ‘অনুপমা’, ‘আখেরি খত’, ‘হাকিকত’, ‘আর্থ’ ইত্যাদি ছবির চিত্রকাহিনিও তাঁর রচনা। চেতন আনন্দের ‘হীর রঞ্ঝা’ ছবির সংলাপ লিখেছিলেন কবিতার মতো করে, কিংবা দেশভাগের ওপর নির্মিত এম এস সত্থ্যুর ‘গরম হাওয়া’ ছবির সংলাপ ও চিত্রনাট্যেরর কথাই বা কে ভুলতে পারে। এই ছবিই তাঁকে এনে দিয়েছিল জাতীয় পুরস্কার ও ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।
আজীবন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন দেশবিদেশের নানা সম্মান। সেই পুরস্কারের ঝুলিতে রয়েছে সাহিত্য একাডেমি থেকে পদ্মশ্রী, আফ্রো এশীয় রাইটার্স লোটাস পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার, মহারাষ্ট্র গৌরব, প্রভৃতি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে সাম্মানিক ডক্টরেট। পেয়েছেন বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ও।
লতা মঙ্গেশকর ও তালাত মাহমুদের কণ্ঠে ‘ডর লাগে দুনিয়া সে’, মহম্মদ রফির গলায়, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল মেরে কাম কি নেহি’ বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ইয়ে নয়ন ডরে ডরে’-র মতো একাধিক গান; অসংখ্য কবিতা, শায়েরি ও গীতিকাব্যের মধ্যে দিয়ে আজও তিনি অমর হয়ে আছেন। আত্মজৈবনিক ‘ম্যায় ঔর মেরি শায়েরি’ প্রবন্ধে তিনি উন্মোচন করেছেন তাঁর জীবন ও ভাবনার নানা দিগন্ত।
আমৃত্যু মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন কাইফি আজমি। বিশ্বাস করতেন তাঁর জীবদ্দশায় দেশে সমাজতন্ত্র আসবে, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিতেও বুনে রাখতেন সেই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনারই বীজ। বলতেন, ‘পরাধীন ভারতে জন্মালাম, স্বাধীন ভারতে বড় হলাম আর মরতে চাই সমাজতান্ত্রিক ভারতে।’ সাধারণ মানুষের ওপর আস্থা ছিল অপরিসীম, সেই স্বপ্নকে বুকে নিয়ে ২০০২ সালের ১০ মে বিদায় জানান পৃথিবীকে। আজ তাঁর জন্মদিনে মানবতাবাদী এই কবিকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।