তথাকথিত সুন্দরী হয়তো নন। কিন্তু তাঁর চোখের তারায় বুদ্ধির নরম দীপ্তি কারও হৃদয় স্পর্শ করেনি, এমনটাও হয়তো নয়। তিনি হাসলে হয়তো মুক্তো ঝরে পড়ত না। তবে তিনি হেসে উঠলে তাঁর দর্শকের কাছে আরও মনোরম হয়ে উঠতেন না, তা-ও হয়তো নয়। রেখার মতো দাপুটে-ডাকসাইটে সুন্দরী, জিনাত আমান, পারভিন বাবিদের মতো লাস্যময়ী মায়াবিনীদের মাঝে তিনি হয়তো কিছুটা ছাপোষা, অনেকখানি আটপৌরে, কিন্তু সত্তরের দশকের মধ্যবিত্ত গেরস্থালীর কাছে ততটাই মধুর। তিনি বিদ্যা সিনহা। বিনোদন জগতে পুরুষতান্ত্রিকতার মাপমতো ছকে ফেলে যিনি প্রতিভাত হতে চাননি। বরং অনেকটা রজনীগন্ধার মতোই তাঁর মনে রেশ রেখে যাওয়া উপস্থিতি। আর কী আশ্চর্য সমাপতনে, অমল পালেকরের সঙ্গে ‘রজনীগন্ধা’ নামে ছবি করেই ১৯৭৪ সালে দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত অভিনেত্রী। সাদা-সুগন্ধি সেই ফুলের মতোই স্নিগ্ধ, নির্মল তিনি… দরকারিও।
দরকারি কারণ, এমন একটা সময়ে তিনি মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যোগ দিয়েছিলেন, যখন সিনেমায় নারী ক্ষমতায়ন এখনকার মতো তো নয়ই, বাস্তব জীবনের মাইল খানেকের মধ্যেও পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু ওই সময়ের বেড়াজালে নিজেকে বাঁধা পড়তে দেননি বিদ্যা। স্টিরিও টাইপ ভাঙা কাকে বলে, সে বিষয়ে তখনও তেমন সড়গড় নয় বলিউড। কিন্তু প্রথম ছবিতেই তিনি পিএইচডি রিসার্চ স্কলার, আত্মনির্ভর এক বিরল চরিত্র করলেন। রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে যে ভুলোমন প্রেমিকের বদলে নিজেই বিল মেটায়। কোনও স্টেটমেন্ট দেওয়ার স্বার্থে কিন্তু নয়, খুব সহজাত ভাবেই, যে কোনও আত্মসচেতন মানুষ হিসেবে। তখনকার বা এখনকার যে কোনও সপ্রতিভ-শিক্ষিত মেয়ের মতোই। বড় চাকরি পেয়ে অন্য শহরে একাই পৌঁছে যাওয়ার মতো নির্ভীকতা বা দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রেমিক এবং আদর্শবাদী প্রাক্তনের মধ্যে বেছে নিতে পারার মতো সিদ্ধান্ত একাই নিতে পারার মধ্যে তাঁর চরিত্রটির যে প্রতিফলন, তার সঙ্গে সহজেই একাত্ম হতে পারতেন ওই সময়ের যে কোনও মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, চাকুরিরতা নারী। কারণ সিনেমার পর্দায় তাঁদের প্রতিনিধি জিনাত আমন বা পারভিন বাবিরা কখনওই ছিলেন না। বরং পেশাদার নারীকে তখন খলনায়িকার ভূমিকাতেই মানানসই মনে করতেন মূলধারার বলিউডের পুরুষ প্রযোজক-পরিচালকরা! তাঁদের প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদকে পাত্তা না দিয়েই।
শুধু সিনেমার ইন্সপিরেশন নয়, বিদ্যার আটপৌরে সৌন্দর্য, তাঁর মাধুর্যও একই রকম আচ্ছন্ন করেছিল মধ্যবিত্ত দর্শককে। বিদ্যার সুতির শাড়ি, বিনুনি বাঁধা চুল তখনকার বহু কর্মরতার স্টাইল স্টেটমেন্টও তৈরি করে দিয়েছিল। পর্দার অভিনেত্রীর সঙ্গে রিলেট করতে পারার মধ্য দিয়েই যে অগুনতি দর্শকের সঙ্গে তাঁর রিলেশন বা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তার পিছনে হয়তো এগুলোই কারণ। হিন্দি ছবিতে ক’জন অভিনেত্রীকে তখন সেলুলয়েডে দেখা যেত, বাসস্ট্যান্ডে বসে ডেনিস রবিন্সের বই পড়ছেন? পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি বোধহয় বিদ্যার ব্যক্তিত্বকে মাথায় রেখেই ‘ছোটি সি বাত’-এ এমন দৃশ্য রেখেছিলেন। যেখানে সূক্ষ্ম কমেডির সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে গিয়েছিল এক আত্মবিশ্বাসী, কর্মঠ নারীর চেতনা, তার যাপন। সে-ও তো বিদ্যার দৌলতেই!
সেই জন্যই বোধহয় অমল পালেকর সহকর্মী, সহযাত্রিনীর একটি প্রতিকৃতি এঁকে দিয়েছিলেন। উপহারের বিনিময়ে হিসেবে যে হাসিটি অমল পেয়েছিলেন, তাতে মিশেছিল একটা সুন্দর মনের নির্যাস। তাই বোধহয় অমল বলেছেন, “ইট ওয়াজ আ বিউটিফুল পোর্ট্রেট বিকজ দ্য মিউজ ওয়াজ আ বিউটিফুল পার্সন অ্যাট হার্ট।”