মানুষটা পড়ে রয়েছে রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে। বাঁকা হয়ে। অজ্ঞান। মুখটা মাটির দিকে, ফলে পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। গাড়িটা রাস্তার গা ঘেঁসে কাত হয়ে পড়ে। ঘোড়ার বাঁধন ছেঁড়েনি, ঘোড়াটি ছটফট করছে। মাঝেমধ্যে আকাশবাতাস কাঁপিয়ে ডেকে উঠছে। পড়ে থাকা মধ্যবয়সী মানুষটার চারদিকে থিকথিকে ভিড়। বোঝা যাচ্ছে বড় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে এখানে। এই জায়গাটায় রাস্তার বাঁক। বাঁকের মুখে ঘুরতে গিয়েই উল্টে ছিটকে গিয়েছে গাড়িটা। ভিড় থেকে হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে বলে উঠল, আরে এ তো বিদ্যেসাগর। বেধবাদের বিয়ে দেয়। এই সময় আর একটা ঘোড়াগাড়ি ঝমঝমিয়ে উল্টে থাকা গাড়িটার কাছে এসে থেমে গেল। গাড়ি থেকে নামলেন একজন বিদেশিনী, বয়স ষাটের কাছাকাছি, মায়াবী মুখমণ্ডল তাঁর। নেমেই দৌড়ে এলেন ভিড়ের দিকে। বহু কষ্টে ভিড় সরিয়ে দেখলেন ওই দৃশ্য। হাহাকারের মতো মাটিতে বসে পড়লেন সটান। সস্নেহে কোলে তুলে নিলেন বিদ্যাসাগরের মাথা। তারপর রুমাল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকলেন– সাগর, সাগর, সাগর…
সাগর পেরিয়ে যেন কানে পৌঁছল সেই ডাক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চোখ খুললেন। পৌষের ২ তারিখ আজ। চারদিকে প্রকৃতি ঝলমলে। বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের তৈরি উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে এসেছিলেন বিদ্যাসাগর। কিছুটা পিছনে আর একটি গাড়িতে ছিলেন স্কুল ইন্সপেক্টর উড্রো, শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর অ্যাটকিনসন সাহেব এবং যে বিদেশিনীকে বিদ্যাসাগরের শুশ্রূষায় দেখা যাচ্ছে, সেই মেরি কার্পেন্টার। মিস মেরি কার্পেন্টার এসেছেন ভারতে, নারীশিক্ষা প্রসারে অপরিসীম আগ্রহ তাঁর। কাজ করছেন বিস্তর।
[the_ad id=”270088″]
বাবা রেভারেন্ড ডক্টর কার্পেন্টার বন্ধু ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের। জীবনের শেষ দিনগুলিতে রাজা ছিলেন ব্রিস্টলে। প্রবল পরিশ্রমের ফলে সেখানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মিস কিডল নামে এক মহিলা স্টেপলটন গ্রোভে তাঁর বিশাল বাড়ির অনেকাংশ রামমোহনকে থাকার জন্য দেন। সেখানেই নিত্য যাওয়া-আসা ছিল রেভারেন্ড ও মেরি কার্পেন্টারের। রামমোহন অসুস্থ হলে ডেভিড হেয়ারের ভাইঝি মিস হেয়ার তাঁর সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মেরি কার্পেন্টারও সেই সেবায় নিজেকে ঢেলে দিয়েছিলেন। ১৮৩৩-এর ১৯ সেপ্টেম্বর স্টেপলটন গ্রোভেই রামমোহনের মৃত্যু হয়। তারপর সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে মেরির ভারতে আসার সিদ্ধান্ত। এসেছেন বেশ কয়েক বার। লাস্ট ডেজ ইন দ্য ইংল্যান্ড অফ দি রাজা রামমোহন রায়, সিক্স মান্থস ইন ইন্ডিয়া-র মতো বইও লেখেন কার্পেন্টার।

যা হোক, সেদিন বিদ্যাসাগর প্রবল যন্ত্রণাকাতর, প্রথমে ঘোড়াগাড়িতে বালি স্টেশন, তারপর রেলে কলকাতা ফিরছেন। একটা আলো-অন্ধকার-বোধ তাঁকে তাড়া করছিল। প্রবল যন্ত্রণা বিদ্যাসাগরের পেটে, মেরুদণ্ড বেয়ে। চোখে খুলতে পারছেন না, চেতনার মধ্যে কেউ যেন ঘুম মিশিয়ে দিচ্ছে। তার মধ্যেই চলছে চিন্তার এতোলবেতোল। তীব্র ভাবে মনে হচ্ছিল– আর বাঁচবেন না। মৃত্যুচিন্তা ভিড় করছিল, কত ভাব ঘুরে বেড়াচ্ছে তার সঙ্গে। তাঁকে জীবিত ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা, মেরি কার্পেন্টার উড্রো অ্যাটকিনসনদের কাছেও লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে উঠেছিল। বিদ্যাসাগরের কিছু একটা হয়ে গেলে, কার্পেন্টার নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবেন না, এই বোধ ওই বিদেশিনীকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। তাঁর অনুরোধেই যে ঈশ্বরের এই সফর।
বিদ্যাসাগরের সেই ঘোরে হাজির হচ্ছিলেন বেথুন সাহেব। আর সেই সঙ্গে একটা আনন্দ, মৃত্যুর পর আবার…নিশ্চয়ই দেখা হবে বেথুনের সঙ্গে। বিদ্যাসাগরের থেকে বয়সে খানিক বড় ছিলেন বেথুন, তার উপর ব্রিটিশ হেভিওয়েট– কিন্তু এ সবে গভীর বন্ধুত্বে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি। বিদ্যাসাগরের মতোই স্কুল পরিদর্শনে যেতে গিয়ে বেথুনের জীবনে যে অঘটন এসেছিল, বাঁচানো যায়নি তাঁকে। সে কথাই মনে এসে হাজির হল ঈশ্বরের।
বিদ্যাসাগরের থেকে বয়সে খানিক বড় ছিলেন বেথুন, তার উপর ব্রিটিশ হেভিওয়েট– কিন্তু এ সবে গভীর বন্ধুত্বে কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি। বিদ্যাসাগরের মতোই স্কুল পরিদর্শনে যেতে গিয়ে বেথুনের জীবনে যে অঘটন এসেছিল, বাঁচানো যায়নি তাঁকে। সে কথাই মনে এসে হাজির হল ঈশ্বরের।
সেটা ছিল ১৮৫১, এই দুর্ঘটনার বছর ১৫ আগের কথা। এক বর্ষাকালে গঙ্গার ওপারে জনাই গ্রামে এক স্কুল পরিদর্শনে যাচ্ছিলেন জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন মানে বেথুন সাহেব। জনাইয়ের সমাজ-মাথারা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাই এই বর্ষাকালেও তিনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল, বেথুনও ভিজে যাচ্ছিলেন। অথচ যাবেন যখন বলেছেন, ফিরে আসার প্রশ্নই নেই। হ্যাঁ, তিনি পৌঁছলেন জনাই গ্রামে, স্কুল দেখাও হল। তারপর গুরুতর অসুখে পড়লেন। সেই অসুখ তাঁর প্রাণ নিয়ে ছাড়ল।
বিদ্যাসাগর ট্রেনে যেতে যেতে বেথুনের জীবন পরিণামের কথা ভেবে দুঃখে কাতর হলেন, একটু আগে যেভাবে সাহেবের সঙ্গে মরণোত্তর মিলনের কথা ভেবে আনন্দের আবেশ আসছিল, তা হারিয়ে গেল। দেখলেন, তার চোখের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা, সেই রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি চলে যাচ্ছে একটা। তার গায়ে লেখা— কন্যাপেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতি যন্ততঃ। এ গাড়ি বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের। মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসা হয় এতে। গাড়ির গায়ে এমন শ্লোক লেখার সিদ্ধান্ত বিদ্যাসাগরদেরই। বিদ্যার্জনে মেয়েদের অধিকার বোঝাচ্ছে এই শ্লোক।বিদ্যাসাগর দেখলেন, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দুই বালিকা কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালা সেই গাড়িতে। ওরা দু’জনে খুব হাসছে। একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে প্রায়। সঙ্গে মদনমোহনও রয়েছেন।
[the_ad id=”270086″]
তর্কালঙ্কার ঘাই মারল বিদ্যাসাগরের হৃদয়ে। মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গেও দেখা হওয়ার আনন্দময় আশা জেগে উঠল। কান্দিতে কলেরায় ভুগে মানুষটা চলে গেলেন বেশ ক’বছর হল। মাত্র ৪১ বছরে এক মহা-প্রতিভার অস্ত হয়েছে। অনেক ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। কিন্তু দু’জন মিলে যে সংস্কৃত-যন্ত্র প্রেস তৈরি করেছিলেন, তা মসিজগতে নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে এ দেশে। বিদ্যাসাগর দ্বন্দ্ব মনে করতে চাইলেন না। মৃত্যুর পর সব ভুল বোঝাবুঝির ঊর্ধ্বে উঠে যেতে হয়, যেতে হবেই, যদি পুনর্মিলন হয় তাহলে মদনমোহনকে জড়িয়ে ধরবেন, সব পুরনো ঝঞ্ঝাট তিনি শোকাশ্রুতে বিসর্জন দেবেন বলে স্থির করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র দেখতে পাচ্ছেন, সেই গাড়িটা ঝমঝম করে এগিয়ে গিয়ে সুকিয়া স্ট্রিটের স্কুলবাড়ির গেট অতিক্রম করল। হ্যাঁ, এই হল বেথুন স্কুল, মানে তখনও এই নাম হয়নি, হিন্দু ফিমেল স্কুল নাম ছিল তখন, সুকিয়া স্ট্রিটে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বৈঠকখানায় এই স্কুল শুরু হয় প্রথমে, সেখানেই এই গাড়িপ্রবেশ। ২১ জন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিল শুরুতে। তার মধ্যেই ছিল তর্কালঙ্কারের দুই মেয়ে ভুবনমালা ও কুন্দমালা।
গাড়িটা স্কুলের দরজায় এসে দাঁড়ালে ভুবনমালা ও কুন্দমালা লাফ দিয়ে নামল। নামলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারও। এই স্কুলে পড়ান মদনমোহন, নাহ কোনও পারিশ্রমিক নেন না সে জন্য। স্কুলের সম্পাদক করা হয়েছে বিদ্যাসাগরকে। আর বেথুন সাহেব অর্থ ঢালছেন, প্রাণও ঢালছেন। তিনি জানেন না কত দিন স্কুলটা চালাতে পারবেন। যে রকম বাধা আসছে চারদিক থেকে। বিশেষ করে তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার চলছে লাগাতার। রাস্তায় ঘাটে তাকে হেনস্থা করা হচ্ছে। বাড়িতে ঢিল পর্যন্ত ছোঁড়া হয়েছে। কিন্তু মদনমোহন অনড়, নিজের দুই মেয়েকে স্কুল ছাড়াবেন না কিছুতেই। এদিকে, আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও ঠাকুরবাড়ির কোনও মহিলা তখনও পর্যন্ত আসেনি স্কুলে পড়তে। এটা পীড়িত করেছে স্কুলের উদ্যোক্তাদের। ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে ভালই চলে মেয়েদের পড়াশুনো, কিন্তু স্কুলে পাঠানোয় কেন এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বুঝতে পারছেন না বেথুন-বিদ্যাসাগর-তর্কালঙ্কাররা।
[the_ad id=”270085″]
ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে কোনও কোনও দিন বাড়ি থেকে নিজের গাড়িতে করে স্কুলে নিয়ে আসতেন বেথুন সাহেব। নিয়ে যেতেন নিজের বাড়িতেও। ভুবনমালা-কুন্দমালা বেথুনকে পিতৃব্য মনে করত। বিদ্যাসাগর দেখছিলেন, বেথুন সাহেবের বাড়ি। স্কুল থেকে এই দুই বালিকাকে তিনি নিয়ে এসেছেন। নানা রকম খাওয়াদাওয়া হয়েছে। সেখানে বিদ্যাসাগরও হাজির। হঠাৎ ভুবন বলে বসল, ঘোড়া হও সাহেব, আমরা চড়ব। শুনে তো বিদ্যাসাগর থ। বেথুন কিন্তু হাহা করে হেসে উঠলেন। আরও চমক দিয়ে দুই বালিকার জন্য ঘোড়া হলেন তিনি। দুই মালা বেথুনঘোড়ায় চড়ল। সারা ঘর ঘুরে ঘুরে প্রাক-চল্লিশের বেথুন ঘোড়ার ডাকও ডাকলেন– দেখলেন ঈশ্বর। সেই বেথুন সাহেব স্কুলের বিরাট উন্নতির ছবিটা দেখে যেতে পারেননি। এই দুঃখ সাগরকে শান্তি দেয় না। বেথুনের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর আর স্কুলের দায়িত্বে থাকতে চাননি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পীড়াপীড়িতে সরতে পারেননি প্রথমে, তারপর অবশ্য সম্পর্ক তেতো হয়ে যায়, এবং দায়িত্ব ছাড়লেও এই স্কুল তাঁকে ছেড়ে যায়নি। এই তো কিছু দিন আগে, মানে ভারতে আসার পর মেরি কার্পেন্টার বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎ চাইলেন। মাস খানেক আগে অ্যাটকিনসন সাহেব সাগরকে চিঠি লিখে বেথুন স্কুলে আমন্ত্রণ জানালেন সে জন্য। সেই চিঠি আজ সকালেও বিদ্যাসাগর উলটিয়ে পালটিয়ে দেখছিলেন।
‘মাইডিয়ার পণ্ডিত, মিস কার্পেন্টারের নাম আপনি অবশ্যই শুনে থাকবেন। তিনি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং ভারতে স্ত্রী-শিক্ষায় বিষয় আলাপ আলোচনা ও সে সম্পর্কে নিজের মত ব্যক্ত করতে চান। আপনি কি আগামী বৃহস্পতিবার সাড়ে এগারোটার সময় একবার বেথুন স্কুলে আসতে পারবেন?…’
অ্যাটকিনসনের অনুরোধ ফেলতে পারেননি বিদ্যাসাগর। আর মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে আলাপ তাঁকে আশ্চর্য আনন্দ দিয়েছিল। স্ত্রী-শিক্ষায় নিবেদিত প্রাণ এমন মানবী তিনি আগে দেখেননি কখনও। আলাপের পর বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছেন কার্পেন্টার। ব্যস্ত মানুষ ঈশ্বর, সময়াভাবে সব জায়গায় যেতে পারেন না, আবার সব সময় না-ও বলতে পারেন না। এই যেমন উত্তরপাড়ার স্কুলে তাঁকে আসতে হল। আজ দুর্ঘটনার পর তাঁর চেতনা ফিরল যখন, মনে হল, স্বয়ং মাতৃদেবী কোলে নিয়ে বসে আছেন তাঁকে। স্নেহভরে পুত্রের সেবা করে চলেছেন। মনে হল, এ তো সশরীরেই স্বর্গভোগ, আহ কী আনন্দ কী শান্তি!
কয়েক ঘণ্টা আগের ঘটনা ভাবতে ভাবতে বিদ্যাসাগরের চোখ উপচে জলের ধারা নেমে এল গাল বেয়ে। এই হল তাঁর সমস্যা, অল্প আবেগে চোখে জল এসে যায়। ঝরঝর কেঁদে ফেলেন মাঝেমধ্যেই। কম বয়স থেকে তাঁর এমন স্বভাব। একবার ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন। মহেন্দ্রলাল হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ও কিছু নয়, ভালবাসা।

এই সময় প্রবল আওয়াজ করে ট্রেনটা থেমে গেল। কী হল কে জানে? বিদ্যাসাগর শুনলেন, চারদিকে তীব্র গোলযোগ উপস্থিত। হঠাৎ শুনলেন একটা নাম, ‘ভগবতী। ভগবতী.. ‘ তাঁর মায়ের নাম। এই ট্রেনে ভগবতী নাম কেন? বিদ্যাসাগর শুনলেন কেউ বলছে, ‘ভগবতীর জ্ঞান এখনও ফেরেনি যে! আবাগির ব্যাটাগুলো কী খাইয়েছে কে জানে? ভগবতী, ও ভগবতী, ভগবতী রে, ওঠ মা, ওঠ–।’ কী হয়েছে মেয়েটার? নিশ্চয়ই কোনও বড় সংকট এসে হাজির হয়েছে তাঁর জীবনে। কী হয়েছে তাঁর মাতৃনামের এ মেয়ের? উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন ভাবলেন, কিন্তু চোখই খুলতে পারছেন না– ওঠার তো প্রশ্নই নেই। ভিতরে ভিতরে উদভ্রান্ত হয়ে উঠলেন। এবার একটি ক্ষীণকণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলেন– ভগবতীর জ্ঞান ফিরেছে। বিদ্যাসাগর একটু স্বস্তি পেলেন। কী হয়েছে তখনও বুঝতে পারছেন না কিছুই। — মেয়েটির সঙ্গে কী হইয়াছে? দৃপ্ত স্বর। এই গলা মেরি কার্পেন্টারের। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাধারণের কামরায় চড়েছেন। সাগরকে অবশ্য অনেক অনুরোধ করা হয়েছিল ফার্স্টক্লাসে চড়ার জন্য। কিন্তু ভয়ানক অসুস্থ শরীরেও তৃতীয় শ্রেণিতেই চড়বেন, গোঁ ধরেছিলেন ঈশ্বর। খটকটে বেঞ্চিতে শোয়ায় সাগরের ক্লেশ আরও বাড়ছিল বৈকি, কিন্তু তাঁর জেদের কাছে এ কষ্টের মূল্য কানাকড়িও নয়।
[the_ad id=”270084″]
মেরি কার্পেন্টারের প্রশ্নের পর কিছুক্ষণ কোনও উত্তর শোনা গেল না। তারপর একটি পুরুষ কণ্ঠে যা কথা শোনা গেল, বিদ্যাসাগর তাতে হাহাকার করে উঠলেন, মৃত্যুকে আরও জড়িয়ে ধরতে চাইলেন তিনি। এই মেয়েটি, যার নাম ভগবতী, বয়স সতেরো। দুই আত্মীয় ভগবতীকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বার করে এনেছিল বাড়ি থেকে। তারপর মেয়েটি নিখোঁজ হয়ে যায়। শুরু হয় গরুখোঁজা। দল বেঁধে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েন গ্রামের লোকজন। তার একটি দলই এই ট্রেনের বেঞ্চিতে মেয়েটিকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছে।
বেথুনের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর আর স্কুলের দায়িত্বে থাকতে চাননি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পীড়াপীড়িতে সরতে পারেননি প্রথমে, তারপর অবশ্য সম্পর্ক তেতো হয়ে যায়, এবং দায়িত্ব ছাড়লেও এই স্কুল তাঁকে ছেড়ে যায়নি। এই তো কিছু দিন আগে, মানে ভারতে আসার পর মেরি কার্পেন্টার বিদ্যাসাগরের সাক্ষাৎ চাইলেন। মাস খানেক আগে অ্যাটকিনসন সাহেব সাগরকে চিঠি লিখে বেথুন স্কুলে আমন্ত্রণ জানালেন সে জন্য।
মেয়েদের শিক্ষা হোক। তারা অর্গলমুক্ত হোক। এই ব্রত নিয়ে দৌড়ে চলেছেন বিদ্যাসাগর। তিনি এই অপহরণের কাহিনি কী করেই বা সহ্য করবেন। অনর্গল কেঁদে যাচ্ছিলেন এ সব শুনে। কিন্তু এখন তিনি চলচ্ছক্তিহীন, বাকশক্তি রহিত। কিছু করা সম্ভব নয়। মেরি কার্পেন্টার তাঁর ভরসা এখন। মা মেরিতে তাঁর বিশ্বাস এখন, অল্প দিনেই এই বিশ্বাস সঞ্চারিত। বিদ্যাসাগর আর মানুষ চিনতে ভুল করেন না। নিশ্চয় মেরি মেয়েটির একটা সুব্যবস্থা করবেন। করবেনই।…
হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর তো বেঁচে গিয়েছিলেন সেই দুর্ঘটনার পর। ২৫ বছর বেঁচেছিলেন আরও। কিন্তু তাঁকে সারাজীবন এই অঘটনের দুর্ভোগ তাড়া করে বেড়িয়েছে। জীবনীশক্তি হুহু করে কমিয়ে দিয়েছে। কার্যে পর্বতপ্রমাণ বাধা তৈরি করেছে। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল বিদ্যাসাগরকে সুস্থ করার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু ডাক্তাররা তো জাদু জানেন না। চিকিৎসকদের মত ছিল, দুর্ঘটনার ফলে তাঁর যকৃত উল্টে গিয়েছে। জ্বর আর পেটখারাপ তাঁর লেগেই থাকত তারপর। খেতে পারতেন না প্রায় কিছু। পাখির মতো আহার করতেন। দুধ ফোঁটামাত্র অসহ্য ছিল। সকালে মাছের ঝোল, ভাত, রাতে বার্লির রুটি খেতেন। মাঝে মাঝে স্বাদ বদলে গরম লুচি এক-দুটো খেলেও পরে তাও পারতেন না। পরের দিকে এক মুঠো মুড়ি খেয়ে রাত্রে তাঁকে শুয়ে পড়তে হত। তখন তাঁর নতুন বাড়ি হয়েছে, বাগান হয়েছে। মনে খালি ভাবতেন, সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, আগুনে পুড়িয়া গেল/ অমিয়া-সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।
[the_ad id=”270084″]
একদিন সে রকমই প্রায় না খেয়ে রাতে শুয়েছেন ঈশ্বর। সারা রাত এপাশ ওপাশ। নানা রকম অসুবিধা হচ্ছে শরীরে। ভাবছেন ডাক্তারকে একটা কল দেবেন সকাল হলে মাত্র। শেষ রাত্রে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখলেন স্বপ্নে এসেছেন ভগবতী। হ্যাঁ তাঁর মা। নাকি দেশের নারীসমাজের প্রতিনিধি? মায়ের একদিকে দাঁড়িয়ে বেথুন সাহেব, অন্য দিকে মদনমোহন। তিন জনই স্মিত হাসছেন। কী এক পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এক পৃথিবী-অতীত আলোও।
পাখী-সব করে রব, রাতি পোহাইল।/ কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।।/ রাখাল গরুর পাল, ল’য়ে যায় মাঠে।/ শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।।…
ঘুম ভেঙে গেল বিদ্যাসাগরের। মুখে এসে পড়েছে সূর্যের আলো। একটা চড়ুই পাখি ঢুকে এসেছে ঘরে।
*ট্রেনযাত্রা ও শেষদৃশ্য ইতিহাস বহির্ভূত, সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এছাড়াও কোথাও কোথাও কল্পনার মিশেল আছে।
পেশায় সাংবাদিক নীলার্ণব বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। গল্প কবিতা ও ফিচার লেখায় সমান আগ্রহ ও দক্ষতা রয়েছে। প্রকাশিত বই রাতের কাহিনী, অসংলগ্ন রিপোর্টাজ, হাওয়ার আওয়াজ।
One Response
ভীষণ ভালো প্রবন্ধ।