(Village Food) আশ্বিন ফুরিয়ে এখন কার্তিক। মাঠের শিশির এখন ভোরের উষ্ণতাকে প্রত্যাশা করে। শিউলির শরীর ভিজিয়ে দেয় হিম, সমস্ত রাত ধরে। একেকটা ভোর যেন একটা নতুন চিঠির মতো। খুব ভোরে এই মাঠ ঘাট ধানিজমি কুয়াশার চাদরে ঘিরে থাকে মোমরঙে আঁকা ছবিটির মতো। খানিক বাদে ক্রমে ক্রমে আলো বাড়লে সেই ছবি বদলে বদলে যায়। ঝড়ে জলে কাশেরা তো কবেই ঝরে গেছে। তবু তার অবশিষ্টটুকু হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে। তিলা মুনিয়া সেই নরম কাশের গোছা মুখে করে উড়ে যাচ্ছে ওই। শীতের আগে আগে সকলেই তো উষ্ণতা খোঁজে, পাখিরাই বা তার ব্যতিক্রমী হবে কেন! ধানের শীষ এখন বেড়ে উঠতে চাইছে প্রতিদিন। (Village Food)

আকাশের আলোয় কী আশ্চর্য ওর পরাগ সংরাগ! গবাক্ষ খুলে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে ওই! কবেকার কোন জাতক আর লোকপুরাণের পাতায়! এই ধানফুলেদের উন্মুখ স্বভাব যেন অমন। কেউ কেউ এসব দেখে দেখে এক সময়ে ওই আলের পাশটিতে গিয়ে বসে। এই জল মাটি আর প্রান্তরকে কাছ থেকে দেখা যায় বটে কিন্তু সেইটুকুই তো সব নয়! ওকে কি মানুষের হাতে গড়া ক্যানভাস ধরতে পারে! এই অনন্ত চরাচরে কার্তিক তাই ধরা দেয় ফলে ফুলে বৃক্ষশাখে। (Village food)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫]
মানুষের রান্নাঘর এসব দেখছে সেই কবে থেকে। দেখে দেখে ওর আশ মেটে না বুঝি। রান্নাঘরের দাওয়াখানি পেরোলেই শিশিরের আশ্বাস। সেই শিশির মেখে একেকদিন কাড়ান ছাতু গজিয়ে ওঠে এদিক সেদিকে। বেগুন গাছে অপূর্ব ফুল ধরে। দুর্গা টুনটুনিরা এখন পেঁপেগাছে দুলে দুলে মধু খাবে। সুর করে ডাকবে। ওদের সুর আপনাকে পৌঁছে দিতে পারে বাঁশের বেড়াটির ওপারে। কী নক্সায় বোনা শিমের লতাখানা! কোনও দক্ষ কারিগর বুঝি বসে বসে শিমফুলের ছাঁচখানি বানিয়েছেন। (Village food)
হাওয়ায় হাওয়ায় শিমের লতারা দুলবে, কে বলে ওরা অবিন্যস্ত! কী বিন্যাস ওই নুয়ে পড়া শিমের গোছায়, কী বিভঙ্গ! মানুষের রান্নাঘরের তাই অবাক হওয়া ফুরোয় না। রান্নাঘর তাই নিজেই কার্তিকের ভোরকে সমস্ত শরীর দিয়ে বুঝতে চায়। ওই যে হলুদের গাছ! কী নিপুণ গ্রন্থনা ওর ফুলের গোছায়। এই কার্তিকের দিনে গরম ভাতে মরিচ ডলে দুটি হলুদ ফুল মাখা খেতে যে কী সুখ! (Village food)
চোদ্দশাকের দিন মানে সে তো একদিনে শেষ নয়! সে হল শাকপাতার কাছে ফিরে যাওয়ার মরশুম। বর্ষা পেরিয়ে আবার একটি শাকান্নে ভাতের থালা সাজিয়ে দেওয়ার মরশুম। ওল, কেউ কালকাসুন্দাকে চিনে নিতে নিতে এই রান্নাঘর কত না নিয়মের শৃঙ্খল বুনেছে। কেবল ভেবেছে এই পৃথিবীর অনাবাদী যাপনটুকু অটুট থাকুক। পৃথিবীরও তো খানিক স্নেহের প্রয়োজন হয়। রান্নাঘর জানে এসব।
এসব পার্থিব যাপনকে আপনারা শিল্প বলতে কুণ্ঠিত হন বুঝি? হলুদ ফুলের পাঁপড়িদের কী অপূর্ব বিন্যাস। মানুষের হাত সেই সেই বিন্যাসকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে কত দিন ধরে। দেখতে দেখতে আনত হচ্ছে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। কী অপরূপ ঔষধি গন্ধ ওর শরীরে। রান্নাঘর এই সমস্তের কাছে নতজানু হয়েছে কত কত দিন ধরে। একেকদিন তাই আমার মনে হয় এই রান্নাঘর যেন কোন সে কিন্নরলোক থেকে উঠে আসা চিত্রকল্পের ইস্কুল। (Village food)
শাক পাতায় বল্কলে ভারী সুন্দর ওর যাপন। হেমন্তের দিনে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিনে মানুষেরা ফিরে যাবেন অনাবাদি শাক পাতার আসরে। মেয়েরা ঘুরে ঘুরে দেখবেন, এই পৃথিবী এখনও অনাবাদী যাপনে সাড়া দিচ্ছে কী না। সেই কবেকার কোন কৃষিযাপনকে রান্নাঘর এমন করে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে প্রতিদিন। (Village food)

চোদ্দশাকের দিন মানে সে তো একদিনে শেষ নয়! সে হল শাকপাতার কাছে ফিরে যাওয়ার মরশুম। বর্ষা পেরিয়ে আবার একটি শাকান্নে ভাতের থালা সাজিয়ে দেওয়ার মরশুম। ওল, কেউ কালকাসুন্দাকে চিনে নিতে নিতে এই রান্নাঘর কত না নিয়মের শৃঙ্খল বুনেছে। কেবল ভেবেছে এই পৃথিবীর অনাবাদী যাপনটুকু অটুট থাকুক। পৃথিবীরও তো খানিক স্নেহের প্রয়োজন হয়। রান্নাঘর জানে এসব। আসলে অনেক দিন ধরেই জেনেছে। তাই আস্ত একখানা নবান্নের দেশ সে মনের মধ্যে লালন করে হেমন্তের দিনে। (Village food)

শরীর দিয়ে মন দিয়ে এই পৃথিবীকে চেনা তার ফুরোবে কি? রান্নাঘর জানে না সে কথা। সে তো আর পরীক্ষা পেরিয়ে স্নাতক হতে চায় না, সে কেবল শিখতে চায়। শিশিরে গোড়ালি ডুবিয়ে উবু হয়ে বসে কাড়ান ছাতুতে তার টুকরি খানা ভরে গেলে সূয্যিদেব পুব আকাশে দেখা দেন। বিলীয়মান শিশিরেরা। হেমন্তের রান্নাঘর সেও কি কুয়াশায় বিলীন হবে! নাকি নরম আতপে তার শরীরের জাড্য কেটে দিয়ে আস্ত একখানা ইজেল হয়ে উঠবে সে নিজেই! (Village food)
কলমী শাকের বড়ার শুক্তো
উপকরণ – কলমি শাক, মটর ডাল, পেঁপে, সাদা তিল, আদা, কাঁচালংকা, সাদা তেল, নুন, চিনি, ঘি এবং এক চিমটে রাঁধুনি।

পদ্ধতি – হাফ বাটি মটরের ডাল রাত্রে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে উঠে জল ঝরিয়ে নিন। কলমি শাকের নরম পাতা ও কচি ডাঁটি আলাদা করে ধুয়ে বেছে নিন। পাতাগুলো কুচিয়ে অল্প আদা ও খুব সামান্য কাঁচালংকা দিয়ে শিলে বেটে নিন। নুন দিয়ে ফেটিয়ে বড়া ভেজে তুলুন। বড়া খুব কড়া করে ভাজার দরকার নেই। কড়াইয়ে যদি বড়া ভাজার অবশিষ্ট তেল থাকে তবে সেই তেলেই হবে। তেল হাফ চামচ মতো অবশিষ্ট থাকলেই যথেষ্ট। ওই তেলে রাঁধুনি ফোড়ন দিয়ে পাতলা করে কেটে নেওয়া পেঁপে ছাড়ুন। সামান্য নেড়েচেড়ে নুন জল দিয়ে সেদ্ধ হতে দিন।
এই সময়ে এক কুচি আদা দিয়ে সাদা তিল মোলায়েম করে বেটে নিন। পেঁপে সেদ্ধ হয়ে এলে কলমির ডাঁটি গুলি দিয়ে দিন। সব বেশ ভাল করে সেদ্ধ হবে কিন্তু গলে যাবে না, এমন অবস্থায় বেটে রাখা তিল অল্প জলে গুলে দিয়ে দিন। এক চিমটে চিনি, এক ফোঁটা ঘি দিয়ে রান্না শেষ করুন। তিলবাটা দিয়ে খুব বেশিক্ষণ ফোটানোর দরকার নেই। হেমন্তের দিনে এই স্নিগ্ধ শুক্তো পরিবেশন করুন দুপুরে, ভাতের প্রথম পাতে।

হাতে মাখা হলুদের ফুল, মাছ দিয়ে
উপকরণ – হলুদের ফুল, এক বা দুই টুকরো মাছ (পোনা বা ল্যাটা বা আপনার পছন্দ মতো কম তেলের কোনও মাছ), নুন, শুকনো লঙ্কা, কাঁচালঙ্কা, সর্ষের তেল, লেবু, পেঁয়াজ।

পদ্ধতি – হলুদের ফুল গুলি ভাল করে বেছে নিন। ভিতরের অংশ গুলি ফেলে পাপড়ির মতো করে খুলে নিন। খুব ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। মাছে নুন হলুদ মাখিয়ে ভেজে নিন। ভাজা মাছের কাঁটা বেছে নিন। এবারে খুব মিহি করে পেঁয়াজ কুচিয়ে নিন, কাঁচালঙ্কা কুচিয়ে নিন। শুকনো লঙ্কা ভেজে তুলুন। নুন লঙ্কা পেঁয়াজ লেবু ভাল করে মেখে মাছ মেশান। হলুদের ফুল গুলি হাত দিয়েই সরু সরু করে কেটে নিন। অপূর্ব গন্ধ এই ফুলের।

সব শেষে মাছের মিশ্রণে হলুদের ফুলগুলি মিশিয়ে নিন। স্বাদ পরীক্ষা করে আরেকটু নুন বা লেবু বা লঙ্কা যোগ করতে পারেন। কার্তিকের দিনে হলুদ ফুলের ঔষধি গুণের শেষ নেই। গরম ভাতে পরিবেশন করুন এই মাখাটি। আপনারা চাইলে মাছ বাদ দিয়েও করতে পারেন একই ভাবে।
ছবি সৌজন্য: লেখক , Bing.com
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
2 Responses
Awesome writing, mouth watering dishes. Nostalgic
Amrita di can portray vivid landscape with her words, just as awesome as her delicacies.