এই মাঠ-বন-প্রান্তরে মেঘের ছায়া পড়েছে। ফুটিফাটা জমি সবুজ ঘাসের আশ্বাস পেয়েছে আবার। সে যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া আস্ত একখানা দেশ। সামান্য বৃষ্টির জলের কী মায়া দেখুন, এমন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া মানচিত্রবৎ মাটিকেও সে শুশ্রূষা দিতে পারে। ঘাসেরা এমন দিনে মাথা তুলে দাঁড়ায় মেঘের ছায়া মাখবে বলে। বৈশাখ ফুরিয়ে জৈষ্ঠ্য এলো, গাছ পাতা ফুল ফলে এমন দিনে অরণ্য ষষ্ঠীর বার্তা এসে পৌঁছায়।

আমে রঙ ধরে, লাল টুকটুকে কাজু বাদামের ফল মাটির সঙ্গে শরীরের গন্ধ বিনিময় করে। মাঠে মাঠে ধান কাটা ফুরালো বুঝি। তিলের খেতে, খসটার খেতে এখন শেষ প্রহরের সজ্জা। দু’একটা তিল ফুল ভোরের আলোয় শ্রীরাধিকাকে মনে করায়। ওর নরম পেলব রঙ,সুকুমার গড়ন। সেই যে কে যেন কবে লিখেছিলেন, ‘তিল ফুল জিনি নাসা…’ সেইসব ভেবে ভেবেই বুঝি এখনও ভোরের নরম রোদ যখন তিলখেতের উপরটিতে এসে পড়ে, তখন আস্ত একখানা রস কীর্তনের আখর বার বার বেজে ওঠে কী অপূর্ব মূর্ছনায়। গাছে গাছে এখন নিমের ফল পেকেছে, পিয়াল পেকেছে। রোদ্দুর পিছলে পড়া শালের পাতায় কী শোভা! মানুষেরা এসব দেখে বৈকি! মাঠ ঘাট কাঁদড় পেরিয়ে যারা প্রতিদিন জল জঙ্গলের কাব্য লেখেন!
তাঁরা তো এমন ছবির মধ্যেই ডুবে যান নুনের পুতুলটি হয়ে। মিশে যেতে যেতে তাঁরা টের পান এই চিরচেনা পৃথিবী কী আশ্চর্য রকম বাঙ্ময় হয়ে উঠতে চায় প্রতিদিন। শুকিয়ে আসা পুকুরের জলে, খালবিল বিলানে এখন কেবল জলের আকাঙ্খা। মাছেদের এখন যৌবনের মাস। কে বলে, বসন্তেই কেবল ফুল ফোটে, পাখি ডাকে! আকাশের ধারা জলে মাটির ভিতরে জমে থাকা প্রাণ জেগে ওঠে। চোত বোশেখের দিন পেরিয়ে এখন জল জঙ্গল আর মাটির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। কই মাছের ঝাঁক এখন ডিমের ভারে পৃথুলা। আম কাসুন্দির বয়মখানা এখন যেন কস্তুরী মৃগের শরীর হয়ে উঠছে দিনে দিনে।

কাজ ফুরানো বিকেলে মানুষেরা আমতেল দিয়ে দুটি মুড়ি খাবে, মরিচ খাবে, তবে না! দুপুরের রোদ্দুর মাথার উপর উঠলে মানুষের পিপাসা জন্মায়। এই মাঠে মাঠে আগে কি আখের চাষ কম হতো! গ্রামে গ্রামে আখের শাল হতো কত! ছেলেপুলেরা বাড়ি থেকে লঙ্কা লেবু তুলে এনে আখের ভিতরে পুরে পেষাই করে খেতো। ঘরে মানুষ এলে আর কিছু না হোক তালের পাটালি কি এক খাবলা আঁখের গুড় দিয়ে এক গেলাস জল বাড়িয়ে দিত মানুষ। এখন সেসব আঁখের তৃষ্ণা মেঘের ছায়ার মতো চিদাকাশে ভেসে ভেসে ভেসে বেড়ায়। নিভু আঁচে পোস্তর বাটিখানা বসিয়ে দিয়ে,নাইতে গেছে মেয়ে। এমন গরম দিনে স্বর্ণ চালের ভাতে মরিচ ডলে বাটি পোস্ত খেতে যে কী সুখ!

মরে আসা মজা নদীর মতো গাঁয়ের প্রান্তে ওই একখানা কাঁদড়। এমন শেষ গ্রীষ্মের দিনে সাপের ভয়ে ওদিকে বেশি লোক যায় না। কেবল এ পাড়ার দস্যি ছেলের দল তালের শাঁস নামায় গাছ থেকে, গুটি আম পেড়ে পেড়ে চিকচিকি ভরে তোলে। পাখি, মাছ আর সবুজ ফড়িঙের দল এসব যে কত কত দিন ধরে দেখছে! এমন গুটি আমে গুড় মাখিয়ে রোদ্দুরে জারিয়ে নেবেন নতুন খুড়িমা। শুকনো চটচটে গুড় আম।
এমন নরম নরম পুঁই ডগা দিয়ে মানুষেরা এমন গুমসুমি গরমের দিনে খসটার চচ্চড়ি রাঁধে। নতুন তেঁতুলের গন্ধে কই মাছ রাঁধে। আমার ঠাকুমা বলতেন, চওড়া না হলে কই মাছে কি স্বাদ হয়! সেইসব ভেবে ভেবে বটি পেতে বসি। বসে বসে তেঁতুলের বীজ ছাড়াই। নতুন তেঁতুলের গন্ধে শৈশব ঘুম ভেঙে উঠে পড়তে চায়।
যাঁদের ধৈর্য কম তাঁরা অবশ্যি গুড় দিয়ে আমের ঝোল রাঁধবেন, টক রাঁধবেন। এই গাছ, মাটি আর অনন্তলতা কী আশ্চর্য আটনে বেঁধে রেখেছে মানুষের রান্নাঘরটিকে। গ্রাম জীবনের জলচৌকিখানা ওই ফুটিফাটা মাঠের মতো চৌচির হয়ে গেছে, এও কি হয়! মেঘের আশ্বাসে তার ভিতরে কি আবার ঘাসের জাজিমখানা ফুটে উঠবে না! আস্তাকুঁড়ের পাশটিতে পুঁইলতাখানা তাই বুঝি ওর নরম ডালখানি বাড়িয়ে দিয়েছে নুয়ে পড়া বেতগাছের দিকে। ও কি জানে, বেতের লতায় জলের আশ্রয় আছে? জানে হয়তো বা।

এমন নরম নরম পুঁই ডগা দিয়ে মানুষেরা এমন গুমসুমি গরমের দিনে খসটার চচ্চড়ি রাঁধে। নতুন তেঁতুলের গন্ধে কই মাছ রাঁধে। আমার ঠাকুমা বলতেন, চওড়া না হলে কই মাছে কি স্বাদ হয়! সেইসব ভেবে ভেবে বঁটি পেতে বসি। বসে বসে তেঁতুলের বীজ ছাড়াই। নতুন তেঁতুলের গন্ধে শৈশব ঘুম ভেঙে উঠে পড়তে চায়। এই মাঠ নদী আর অনন্তলতার রূপকথা শুনিয়ে তাকে আর কতকাল ঘুম পাড়িয়ে রাখবো বলো!
খসটা দিয়ে পুঁই চচ্চড়ি
উপকরণ : খসটা (না পেলে সাদা তিল), পুঁই পাতা, সর্ষের তেল, নুন, মিষ্টি, শুকনো লঙ্কা, কাঁচালঙ্কা আর পাঁচ ফোড়ন।

প্রণালী : খসটা ভালো করে ঝেড়ে বেছে একটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে বেটে নিন। বেশ মাখা মাখা চচ্চড়ি হবে, সেই অনুযায়ী খসটা নেবেন আন্দাজ মতো। পুঁই পাতাগুলি ধুয়ে জল ঝরিয়ে নিন। গোটাই থাকবে। শুধু পাতাই নেবেন, ডাঁটা নেবেন না। কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম হলে পাঁচফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন। ফোড়নের গন্ধ বেরোলে পুঁই পাতাগুলি দিয়ে নেড়েচেড়ে পরিমাণ মতো নুন দিন। অল্পক্ষণ ঢাকা দিয়ে শাকগুলি নেড়ে দিন। জল বেরিয়ে শাক নরম হয়ে এলে খসটা বাটা দিন। সামান্য মিষ্টি দিন। যদি প্রয়োজন হয় জলের ছিটে দিতে পারেন। এবারে একটু রান্না হতে দিন। ক্রমে জল শুকিয়ে এলে খুন্তি দিয়ে উলটে পালটে দিন। বেশ ভাজা ভাজা ভাব হলে তেল ছেড়ে দিলে রান্না শেষ করুন।
নতুন তেঁতুলে ডিম ভরা কই
উপকরণ : কই মাছ ( ডিম ভরা হলে খুব ভালো), অল্প তেঁতুল (পুরনো তেঁতুল না হলেই ভালো) , জিরে গুঁড়ো বা বাটা, গোটা দারচিনি, সর্ষের তেল, নুন, লঙ্কার গুঁড়ো, হলুদের গুড়োঁ, অল্প গুড় আর কাঁচালঙ্কা।

প্রণালী : তেঁতুল ভিজিয়ে রাখুন। জিরে বেটে নিন। জিরের গুড়োঁ ব্যবহার করলে অল্প জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখুন। কইমাছগুলি ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। মাছে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। কড়াইয়ে সর্ষের তেল গরম করে মাছগুলি ভেজে নিন। খুব কড়া করে না ভাজলেই ভালো। এবারে, কড়াইয়ের অবশিষ্ট তেলে দারচিনি ফোড়ন দিন। সুগন্ধ বেরোলে আঁচ কমিয়ে জিরে বাটা, নুন, হলুদ, লঙ্কার গুড়োঁ দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিন। মশলা কষে গেলে তেঁতুলের মাড়ি দিন পাতলা করে জলে গুলে। ঝোল ফুটে উঠলে মাছ ছাড়ুন। ঢাকা দিয়ে প্রয়োজন মতো সেদ্ধ হতে দিন। মাছ একবার উলটে দেবেন। এবারে ঢাকা খুলে ঝোল ঘন হতে দিন। অল্প গুড় দিন। নুন ঝাল টক মিষ্টি স্বাদ হবে। ঝোল বেশ গা মাখা হয়ে গেলে চেরা কাঁচালঙ্কা দিন। উপর থেকে সর্ষের তেল ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। ঢাকা দিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Indiamart
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
3 Responses
বৃষ্টি ভেজা গন্ধ, অথবা শিউলি মাখা সুবাস, অথবা দুয়ের যুগল।
খুব সুন্দর লিখেছিস।
কবির হাতে পড়লে কাজের কথা কেমন সাজের-কথা হয় তার উপযুক্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে এই লেখাগুলি। খুব মিষ্টি লেখা।