(Spring) বসন্তের নিজের একটা ভাষা আছে। সে তো সবারই থাকে, নিজের মতো করে। কিন্তু কথা হলো – সকলে কি আর সেই ব্যক্তিগত ভাষাটুকু প্রকাশ করতে পারে প্রাণ ভরে! বুকের ভিতরে যে সুর গুনগুনিয়ে ওঠে তাকে কথার মালায় গেঁথে বক্ষহারে দোলানোর ব্যকুলতা তাই ফুরোয় না। বসন্ত কিন্তু নিজের মতো করে রপ্ত করেছে সেই সুরখানি। সেই সুরে তুঁত ফলের পাতাঝরা ডাল কচিপাতায় সেজে ওঠে, অশোক মঞ্জরীর রঙে নেশা লাগে আকাশের। ফাগের খুশি হয়ে সে সুর ধরা দেয় জানালায় বিছানায় রান্নাঘর থেকে না-মানুষী যাপনেও। (Spring)

আসলে রঙেরও তো নানা যাপন আছে! কড়ি কোমলের স্বরে সেও ধরা দেয় স্বাদে আর গন্ধে। রান্নাঘর সেসব জানে হয়তো। না জানলে তার চলবেই বা কেমন করে। এই জানা তো নিছক আকস্মিক নয়! এই জানায় কত না বসন্ত পেরিয়ে আসার গল্প মিলেমিশে আছে। নিমেরা যেমন পাতা ঝরিয়ে দেয় অবিরাম! হাওয়ায় হাওয়ায় সেই পাতারা পাক খেয়ে খেয়ে মাটিকে ছুঁতে চায় নির্মোহ ভঙ্গিতে। একে তুমি মৃত্যু বলতে চাও! কবিতার মতো ওর ঝরে পড়ার মুহূর্তটি। ঠিক যেমন করে কুন্দ ওর ফুল ঝরিয়ে দেয়! সাদা সাদা ফুলে ভরে থাকে ওর মাটি! (Spring)

কে বলে বসন্তের মধ্যে এই আশ্চর্য বিষাদ মিলেমিশে নেই? বিষাদের কাজ কি কেবল করুণ রসের সাধনা? এই পুরনো পৃথিবীখানা কিন্তু সেকথা বলে না। এই পৃথিবীতে তাই বিষাদের বসন্তেরা ফুল ফোটায়, আসলে তারা ফুল ফোটাতে জানে ঠিকই কিন্তু ঝরাতেও তার দ্বিধা নেই। তাই দ্যাখো না, কেমন লাল জাজিমখানি বিছিয়ে থাকে শিমূলের তলায়। খুব কচি কোমল কুঁড়ি কুড়িয়ে এনে মানুষেরা ভাজি করে ছেঁচকি করে। রঙ কি কেবল আকাশে বিলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে? মানুষের ভাতের থালায় সে সাধনা সেই কবে থেকে প্রাণ পেয়েছে ঋতুতে ঋতুতে। সজনের ফুলেরা তাই কুরুশের ফুলের মতো তলা বিছিয়ে পড়ে। ওর মিঠে গন্ধে রান্নাঘরেরও বুঝি মৌতাত লাগে একেকদিন। রান্নাঘর সেকথা কখনও কাকে বলেছে কিনা জানি না, কিন্তু বলতে চায় হয়তো। (Spring)

বসন্তের হাওয়ায় তার উনোনের আঁচ এলোমেলো হয়ে গেলে ওর এক চিলতে জানলার ওপারের পৃথিবীখানা এই রান্নাঘরকে ডাকে। কচি কচি পাতাবাদামের সবুজ গায়ে রোদ্দুর পিছলে যায়। গিরিপুষ্পের ফুল অবিরাম ঝরে, কেবলই ঝরে পড়ে। মনে হয় সে যেন কোন শ্রাবণবেলা। জীবন তো ফুরিয়ে ফেলতে জানে না! নিত্যদিন কেবল তার যাপনের উচ্ছ্বাস। বুড়িয়ে আসা শিমের লতায় এই যে মানুষের আঁচল ভরিয়ে তোলে শেষ শীতের গন্ধখানি নিয়ে, সে কি কম হলো! রান্নাঘর ওকে পুরনো বলেই তো চেয়েছে এই বসন্তের দিনে। কী আশ্চর্য এই রান্নাঘরের দর্শনখানি। ভাবলেও অবাক লাগে। (Spring)

বুড়িয়ে আসা শিম কুটে বেছে গাঁয়ে গঞ্জে মানুষেরা শুকনো মাছ দিয়ে চচ্চড়ি খাবে, খাবে নিম শিম। সজনে ফুলের মিলমিশে গা মাখা তরকারি বানাবে তিল পিটুলি দিয়ে। কেউ কেউ তাকে শুক্তো বলতে চাইলেই বা ক্ষতি কি! এই বসন্তের দিনে সামান্য নাম নিয়ে এই মনোমালিন্য কি মানুষের সাজে! অথেনটিক রান্নার হিসেব মিলাতে রান্নাঘরের বয়েই গেছে। সে কেবল এমন বসন্তের দিনে বুড়ো কাঠ শিম থেকে বুড়িয়ে আসা বরবটি আর মুলোর বীজদেরও আশ্রয় দিয়েছে জীবনের বিশ্বাসে। চিনেছে ওদের অন্তরের সৌন্দর্যটিকে। একেকদিন ওই কাগজ ফুলের মাথার উপর দিয়ে যখন ফাল্গুনের চাঁদ ওঠে! এই রান্নাঘরের জানলা দিয়ে জোছনা এসে পড়ে। সেই জোছনা পেরিয়ে শুকিয়ে আসা কপির পাশে কচি ছোলার গাছ গড়াগড়ি যায়। (Spring)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯]
রান্নাঘর, তুমি কি কখনও রবীন্দ্রনাথ পড়েছো? অরূপরতন পড়েছো? বসন্তের গল্পে আমার বিষ্ময় আর কাটে না। বরং ওই উঁচু লতার নীচটিতে ঘুরে ঘুরে কাঠশিমের বীজ কুড়াই একা একা। কে বলে, রান্নাঘর কেবল রান্নাই করে? রান্নাঘরের কত যে কাজ! এমন করে কত বসন্ত পেরিয়ে তার পথচলা পর্যাপ্ত থেকেছে। এই তো ফাগ ওড়ানোর সুখ! আপনারা আশাকরি হলুদ আর মরিচের গুঁড়ো বলে খাটো করবেন না। জীবনের গল্পে কত পলাশ ঝরানো দিন দেখেছে এই রান্নাঘর! দেখেছে রুদ্রপলাশের রঙ। ও হে রাঁধুনি, রান্না কি কেবল তেল নুন লকড়ি! ওসব ছেড়ে খানিক ফুল কুড়াই চলো। (Spring)

কাঁচা ছোলা বাটা
উপকরণ : কাঁচা ছোলা, কাঁচালঙ্কা, এক-দুই কোয়া রসুন, নুন ও সামান্য মিষ্টি।
পদ্ধতি : এই সময়ে, বসন্তের শুরুতেই কেবলমাত্র কাঁচা ছোলা ওঠে বাজারে। ছোলাগাছ সহই বিক্রি হতেও দেখা যায়। খোলা থেকে মটরশুঁটির মতো ছোলাও ছাড়িয়ে নিন। বেছে নেওয়া ছোলা ধুয়ে জল ঝরিয়ে রাখুন (না হলে বাটাটা বেশি জল জল হয়ে যাবে)। এবারে ছোলা, কাঁচালঙ্কা (স্বাদ মতো), নুন, চিনি ও এক দুই কোয়া রসুনসহ শিলে ভালো করে বেটে নিন। মিক্সার গ্রাইণ্ডারেও করতে পারেন যদি একান্তই উপায় না থাকে। এই বাটায় সর্ষের তেল দিয়ে গরম ভাতে পরিবেশন করুন। শীত শেষে আসন্ন গরমের দিনে খুবই উপাদেয় এই ছোলা বাটা। (Spring)

শিম দিয়ে সজনে ফুলের শুক্তা
উপকরণ : কয়েকটি শিম, এক মুঠো সজনে ফুল, সাদা তিল, রাঁধুনি (ফোড়নের মতো), অল্প দুধ, সামান্য ঘি, নুন, মিষ্টি, কাঁচালঙ্কা।
পদ্ধতি : শিম এখন প্রায় শেষবেলায়। তাও যতটা সম্ভব আঁশবিহীন শিম বেছে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন। আঁশ ছাড়িয়ে শিম গোটাই রাখবেন। সজনের ফুলেও অনেক সময় ধুলো-ময়লা থাকে, সেগুলিও ধুয়ে নিন। আলাদা আলাদা করে শিম এবং সজনে ফুল ভাপিয়ে নিন। এবারে কড়াই বসিয়ে সামান্য ঘি দিয়ে রাঁধুনি ফোড়ন দিন। ফোড়নের গন্ধ বেরোলে ভাপিয়ে রাখা শিম আর সজনে ফুল দিয়ে অল্প নাড়াচাড়া করুন। ঘেঁটে যাবে না। দুধে জল আর তিলবাটা মিশিয়ে কড়াইয়ে ঢেলে দিন। আর ঢাকা দেবেন না। দু-একটা বোঁটা সহ কাঁচালঙ্কা দিন। বেশ মাখা মাখা হয়ে এলে সামান্য মিষ্টি দিন। খুন্তি দিয়ে কাঁচালঙ্কাগুলো একটু ভেঙে দিতেও পারেন। আরেকটু ঘি ছড়িয়ে রান্না শেষ করুন। এই শেষের ঘি-টুকু চাইলে নাও দিতে পারেন। (Spring)

টমেটো-জামিরলেবু দিয়ে মাছের খাট্টা
উপকরণ : পোনামাছের কয়েক টুকরো – শুধু মুড়ো, ল্যাজাও নিতে পারেন, সর্ষের তেল, একটু বেশি পরিমাণে টমেটো, জামির লেবু (অন্যথায় যেকোনো টক লেবু), মিহি করে কুচিয়ে নেওয়া পেঁয়াজ খানিকটা, কাঁচালঙ্কা, লঙ্কাগুঁড়ো, হলুদগুঁড়ো, ধনেগুঁড়ো, স্বাদমতো নুন, ধনেপাতা। (Spring)

পদ্ধতি : মাছগুলি প্রথমে ভেজে নিন। মাছ ভাজা হয়ে গেলে কড়াইয়ে অতিরিক্ত তেল তুলে নিন। অল্প অল্প করে ভাজলে কম তেলেই ভেজে নিতে পারবেন। এই তেলে পেঁয়াজ কুচি দিন। পেঁয়াজ ভেজে বেশ গোলাপি ভাব ধরলে, কাঁচা গন্ধ চলে গেলে নুন, হলুদ, ধনের গুঁড়ো এবং লঙ্কার গুঁড়ো দিন। সামান্য কষিয়ে এর মধ্যে একটু বেশি পরিমাণে পাকা পাকা টমেটো দিন। টমেটো গলে গেলে জল দিয়ে ফুটতে দিন। ফুটে উঠলে মাছ দিন। মাছ সেদ্ধ হয়ে গেলে একটি বা দুটি জামিরলেবুর রস দিন। বেশ কিছুটা ধনেপাতা ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে রান্না শেষ করুন। এই রান্না টকই হয়ে থাকে, মিষ্টি দেওয়া হয় না। ভাতের পাতে, বলা ভালো শেষ পাতে এই খাট্টা খেতে ভালো। কেউ চাইলে মাছ ছাড়াও করতে পারেন। (Spring)
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, Flickr
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।