বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর ছোট্ট সংসার। আস্তে আস্তে তিলে তিলে তাকে সাজিয়ে তোলা। বছর দু’-তিন-এর অপেক্ষা, আর তার পরই আগমন সেই মানুষটির,যাকে ঘিরে স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা। সেই তো তখন সংসারের মধ্য়মণি। বাড়ির এই নবতম সদস্য়কে নিয়েই তখন যাবতীয় ব্য়স্ততা। স্বামী-স্ত্রী থেকে বাবা-মা হওয়ার এই যাত্রাপথ যে কতটা আনন্দ দেয়, তা বোধ হয় যে কোনও দম্পতি এক বাক্য়ে স্বীকার করে নেবেন। হঠাৎ করেই যেন জীবনের গতিপথ বদলে যায়। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়। সংসারের ওঠাপড়া, নিত্য় দিনের অশান্তি, টানাপড়েন, অভিমান, মনোমালিন্য়ের মাঝে সন্তানই তখন হয়ে ওঠে এক সঙ্গে থাকার অবলম্বন। তার এক গাল হাসি, তার বায়না, মন ভাল করা আধো বুলি নিমেষে সমস্ত স্ট্রেস দূর করে দিতে পারে।
স্বামী-স্ত্রী- সন্তান এই মিলিয়ে তো ছোট্ট পরিবার, সুখী পরিবার। অন্তত এমনটাই আমরা দেখে এসেছি, জেনে এসেছি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তো সব কিছুই পাল্টায়। আমরাও বদলেছি। আমাদের খাওয়াদাওয়া, পোশাকআশাক, সমগ্র জীবনযাত্রার ধরনই এখন বদলে গেছে। সেই সঙ্গে আমরা নতুন ভাবে ভাবতেও শিখেছি। প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্য়ান ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, সব কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। সুখী পরিবারের যে ছবিটা দেখতে আমরা অভ্য়স্ত, তা কোথাও হলেও একটু ধূসর হয়েছে। এখন অনেকেই মনে করেন যে শুধু স্বামী-স্ত্রী মিলেও পরিপূর্ণ সংসার গড়ে তোলা যায়। আগে যেখানে সন্তান ছাড়া সংসার সম্পূর্ণতাই পেত না, সেখানে আজ এমন অনেক দম্পতি আছেন, যাঁরা স্বেচ্ছায় সন্তান নিতে চান না। নিজেদের মতো, নিজেদের শর্তে বাঁচতে চান। যাঁরা সাবেকি ধারণায় বিশ্বাসী, তাঁরা অবশ্য় কটাক্ষ করতে পারেন। এমন দম্পতিদের স্বার্থপরের তকমাও দিতে পারেন।
কিন্তু সত্য়ি করে ভেবে দেখুন তো, সন্তান নিতেই হবে, এমন কি কোনও নিয়ম আছে? সন্তান চাই বা চাই না, এ তো একেবারেই দম্পতিদের ব্য়ক্তিগত সিদ্ধান্ত। সেখানে আমি, আপনি কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারি না। এই নিয়ে অনেক আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে, কিন্তু বাস্তবে সন্তান না চাওয়ার ঘটনা কিন্তু ক্রমশই বাড়ছে। ‘ডিঙ্ক’ অর্থাৎ ‘ডাবল ইনকাম নো কিডস’ কথাটা যে কতটা প্রচলিত, তা আপনি চোখ-কান খোলা রাখলেই বুঝতে পারবেন। কোনওরকম ভাল-মন্দের বিচারে না গিয়ে কারণগুলো আসুন একটু বিস্তারে আলোচনা করি।
শুধু সংসার নয়, কেরিয়ারও গুরুত্বপূর্ণ
স্বামী আয় করছেন আর স্ত্রী সংসার সামলাচ্ছেন, এই দৃশ্য়টা এখন আর অতটা দেখা যায় না। দু’জনেই নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে প্রচণ্ড ব্য়স্ত। আজ মিটিং কাল প্রেজেন্টেশন, পরশু ট্য়ুর, সময়ের বড় অভাব। আবার এমন অনেক দম্পতিও আছেন যাঁরা কেরিয়ারের স্বার্থে ভিন্ন শহরে থাকেন। এ হেন পরিস্থিতিতে সন্তান পালন করতে যতটা সময় দেওয়া প্রয়োজন, তা তাঁদের কাছে প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁদের কাছে পদোন্নতি কিংবা নিজের কেরিয়ার গড়ে তোলাটাই প্রধান। এবং নিজেকে গুরুত্ব দিয়ে সেই চাহিদাটা কিন্তু অন্যায় নয়। সে ক্ষেত্রে সন্তানের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারার না আছে সুযোগ আর নাই সময়। তাই তাঁরা সন্তানের কথা ভাবতে চান না। ভাল করে ভাবলে, কিন্তু এর মধ্য়ে কোনও অন্য়ায় নেই। সন্তান এনে তাকে অবহেলা করার চেয়ে ঢের ভাল নিজেদের শর্তে জীবন কাটানো।
নিজের জন্য় সময়
শুধুই কেরিয়ারে ব্য়স্ততা কিন্তু সন্তান না চাওয়ার একমাত্র সিদ্ধান্ত নয়। অনেকেই সারা দিনের পর যেটুকু অবসর পান, তা নিজের মতো কাটাতে পছন্দ করেন। সেখানে বাচ্চার পিছনে যা পরিশ্রম করতে হয়, তা করতে তাঁরা নারাজ। বরং নিজের সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটানোয় তাঁরা মন দিতে চান। সন্তান থাকলে, দায়িত্ব হাজারগুণ বেড়ে যায়। অনেকেই জেনে-বুঝে সেই দায়িত্ব নিতে চান না। বরং ঝাড়া হাত-পা থেকে নিজেদের স্বপ্নগুলো পূরণ করার দিকে মন দিতে চান। হয়তো অনেক দিনের স্বপ্ন একটা একক রোড-ট্রিপে যাওয়ার। বাচ্চার পিছুটান না থাকলে এটা যতটা সহজ, তা সন্তান থাকলে কিন্তু ততটাই কঠিন। অনেকে আবার বাড়তি সময়, নিজের কোনও লালিত ইচ্ছে, যেমন বই লেখা বা ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করতে চান। সন্তানের জন্য সময় দিতে তাঁরা নিতান্তই অপারগ। আর তাই সন্তান না চাওয়াই তাঁদের কাছে সঠিক সিদ্ধন্ত বলে মনে হয়।
বাড়ছে অণু পরিবারের সংখ্যা
দাদু-দিদা, জ্য়াঠা-কাকু, পিসি-মাসি মিলিয়ে জমজমাট যৌথ পরিবারের ছবিটা ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে। হাতে গোনা যৌথ পরিবার এখন খুঁজে পাবেন। সে ক্ষেত্রে আজকাল আর গুরুজনদের ‘’ভাল খবর কবে পাচ্ছি’’ বলার লোকও কমে গেছে। ফলে পরিবারের তরফ থেকে সন্তান চাওয়ার চাপ এখন আর অতটা নেই। এখনকার শ্বশুর-শাশুড়িরাও আগের তুলনায় অনেক বেশি উদারমনস্ক, ফলেও তাঁরাও ছেলে-বউ কিংবা মেয়ে-জামাইকে উঠতে বসতে সন্তানের জন্য় বিব্রত করেন না। আবার অণু পরিবার হওয়ার ফলে সন্তানের দেখাশোনা করার লোকের সংখ্যাও কমে গেছে। অনেক শুধুই আয়া বা ডে-কেয়ার সেন্টারের উপর ভরসা করতে পারেন না। আবার শুধু সন্তানের খাতিরে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে থাকাও সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় তাঁরা সন্তান না চাওয়ার কথাই ভাবেন।
অর্থনৈতিক অবস্থান
অনেকেই হয়তো বলবেন, বাচ্চা মানুষ করতে কী আর এমন টাকা লাগে! বাস্তব কিন্তু অন্য় কথা বলে। বাচ্চাকে একটা সুস্থ, সুন্দর জীবন দিতে ন্য়ূনতম অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন। বাচ্চার স্কুলের অ্যাডমিশন ফি, মাইনে, তার ওষুধপত্র, অন্যান্য খরচের হিসেব কষলে যে সংখ্যাটা তা দাঁড়ায়, তা নেহাত সামান্য নয়। মোটামুটি মাঝারি মাপের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করার পর অনেক দম্পতির কাছে সেই অর্থ না-ই থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা সন্তান না নেওয়ার দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
স্বাধীনতা হারানোর ভয়
সন্তান আসার পর স্বাভাবিকভাবেই তার প্রয়োজনগুলো অগ্রাধিকার পায়। আজ তার ডাক্তারি চেক-আপ, কাল পরীক্ষা, পরশু ক্রিকেট ম্য়াচ, এগুলোই যেন তখন দৈনন্দিন জীবনের ক্যালেন্ডার হয়ে দাঁড়ায়। ভাল করে খেয়াল করলে দেখবেন, কোনও পার্টি বা অনুষ্ঠানে সন্তানসহ দম্পতিরা বাড়ি যাওয়ার জন্য খুব তাড়াহুড়ো করেন। কারণ বাড়িতে যে তাঁদের প্রাণভোমরা অপেক্ষা করে রয়েছে। হয়তো তাকে খাওয়াতে হবে বা পড়তে বসাতে হবে। কারণটা যাই হোক, মোদ্দা কথা তাঁদের স্বাধীনতা অনেকটাই কমে যায়। সেখানে যাঁদের সন্তান নেই, তাঁরা সেই স্বাধীনতা খুব উপভোগ করেন। বাচ্চার দায়িত্ব না থাকায়, তাঁরা নিজেদের মতো করে জীবন কাটাতে পারেন। ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াতে পারেন, নতুন নতুন জায়গায় যেতে পারেন। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেন। তাঁদের কাছে এই মুহূর্তগুলো বেজায় দামি। তাঁরা মনে করেন বাচ্চা থাকলে, এই ভাবে জীবন কাটানো সম্ভব নয়। সেখানে বাচ্চার দায়িত্ব নিতে তাঁরা স্বচ্ছন্দবোধ করেন না।
বন্ধ্য়াত্বের সমস্য়া
আগের মতো এখন আর কুড়ি পেরলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় না। তাঁরা তাঁদের কেরিয়ার গুছিয়ে নিয়ে সংসার পাতেন। এর ফলে বেশি বয়সে বিয়েটা এখন আর কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিন্তু বয়সের সঙ্গে বাড়তে পারে বন্ধ্য়াত্বের সমস্য়া। এর যে চিকিৎসা নেই তা নয়। অন্য পদ্ধতিতেও সন্তানের আগমন সম্ভব, কিন্তু অনেকেই সুস্থ শরীরকে ব্য়স্ত করতে চান না। তাঁরা নিজেদের জগতেই খুশি। অনেকে আবার পোষ্য়কে সন্তানের মতো লালনপালন করেন। সকলের মতো তাঁদেরও বাচ্চা থাকতে হবে, এমন মতে এখন আর অনেকেই বিশ্বাস করেন না।
আজও এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা হয়তো এই মতগুলো মেনে নিতে পারবেন না। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, সমাজের কথা ভেবে, পরিবারের চাপে, সমাজে গ্রহণীয় না হওয়ার ভয়ে সন্তান আনা, কিন্তু তাকে সঠিক ভাবে যত্ন করতে না পারাটা কি অন্যায় নয়? যদি স্বামী-স্ত্রী মনে করেন যে সন্তানকে দেওয়ার মতে তাঁদের কাছে সময়, সুযোগ, অর্থ নেই, তা হলে তাকে পৃথিবীতে আনা কি বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়? বিষয়টা সামাজিকতার মাপকাঠিতে নয়, ক্রমাগত বদলে যাওয়া চারপাশের পরিবেশের ভিত্তিতে, ব্যক্তি স্বাধীনতার কষ্টি পাথরে বিচার করা, ভেবে দেখা দরকার। আমরা কি সত্যিই শিশুর বাসযোগ্য করে একটা পৃথিবী তৈরি করতে পারছি ?
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।