(Winter) পৌষ ফুরিয়ে এলো। উত্তুরে হাওয়া জানিয়ে দিচ্ছে সংক্রান্তি এসে গেছে। ঘরে ঘরে এখন মকরের স্নানের তোড়জোড়। খুব ভোরে নরম আলোয় কুয়াশার স্তর যখন থমকে যায় নদীর ওপরে! ভারী নরম হয়ে থাকে চরাচর। জবুথবু হয়ে থাকা এই ভোরকে দেখলে তখন মানবী বলে ভুল হতে পারে। কবেকার কোন লোকবিশ্বাসে এমন সংক্রান্তির ভোরে গঙ্গা এসে মিলিত হয়েছিল অজয়ে (নদ)। সেদিন নাকি পদ্ম ফুটেছিল কেন্দুবিল্বের পাশটিতে। হয়তো এসব সত্যি নয়, হয়তো বা মানুষেরা এসব ভেবে নিতে ভালোবাসে জীবনভর। (Winter)

এসব মানুষী ইচ্ছের ভিতরে কবেকার কোন ইন্দ্রিয়াতীত যাপন কবিতার মতো স্থির হয়ে আছে যেন। এমন কবিতার মতো ভোরে মানুষেরা দুয়ারে দুয়ারে মারুলি দেয়। পিটুলি গোলার আলপনা দেয়। নিকোনো উঠোনে ধানের গোলা, সেই যেখানে মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আঁকা! এই লক্ষ্মী কি কেবল মাটি দিয়ে গড়া! কবেকার কোন কৃষিজীবনের গন্ধে ও প্রাণ পায় পৌষের দিনে। ঘরে ঘরে তখন চাল কুটে নেয় মানুষেরা। নরম সবুজ কলাপাতায় ধবধবে সাদা নারকোল জড়ো হতে থাকে। গুড়ের পাত্রখানায় কী মিঠে গন্ধ! মানুষের ঘরে এখন পিঠের মরশুম। (Winter)

কাক চড়াই আর শালিখেরা জানে এসব। ওরা ঠিক টের পায়, আশকে পিঠের সরাখানা ঘষেমেজে ধুয়ে রাখা হয়েছে, রোদ্দুর এসে পড়েছে আতপ চালের নরম শরীরে। গাঁ-গেরামের কৌমজীবন ভেঙে যাক না, যা ভেঙে যাওয়ার তাকে আটকে রাখবে কোন মন্তরে! তবু তো পার্বণের দিনে মানুষ স্মৃতিতে তলিয়ে যায়! তোমাদের স্টুডিয়োয় তোলা ফটোর চেয়ে সে বরং ঢের ভালো। (Winter)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫][৬][৭][৮]
এই না হলে মানুষজীবন! পিটুলি গোলার আলপনায় তাই সে গোলা ভরা ধানের ছবি আঁকে, খুন্তিলতায় ভরিয়ে তোলে দাওয়া থেকে উঠোন। সমস্ত বাড়িখানা নিজেই আস্ত একখানা পৌষের দিন হয়ে উঠতে চায় ক্রমে। তখন সরাপিঠে থেকে মুগসামালি, রসবড়া থেকে গোকুলপিঠে কতই না তার সজ্জা! খেজুরের কাঁটা দিয়ে এঁকে এঁকে যিনি নকশিপিঠে গড়েন মায়াবী হাতে, তাঁকে কি শিল্পী বলতে আমরা কুণ্ঠিত হবো! রবীন্দ্রনাথ ভারী সুন্দর করে অপ্রয়োজনের আনন্দের কথা লিখেছিলেন ওঁর ‘বাজে কথা’ প্রবন্ধে। (Winter)
এই কেজো রান্নাঘরের বাইরে এসে সংক্রান্তির দিন অপ্রয়োজনের আনন্দকে আবিষ্কার করেছে একভাবে। তাই না পুলি পিঠের গায়ে অমন হাতে বোনা নকশা। ওই নকশাটুকুর তো কোনও প্রয়োজন ছিল না! তবু দেখুন পুঁজি আর পণ্যের পৃথিবীতে পৌষের রান্নাঘর কেমন করে হাতে গড়া জীবনের কাছে ফিরেছে। এই ফেরা তো সহজ নয়! তবুও কী সহজ এই ফেরা। নিয়মরক্ষায় আর যাই থাক আনন্দ নেই। কবেকার কোন ফেলে আসা যাপন তার প্রদর্শনীর ছায়াখানি ফেলে রেখে গেছে ভারী যত্নে। (Winter)
পিঠের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে রান্নাঘরের ওপারটিতে। স্মৃতির মাঝে জেগে উঠছে হৃদকমলখানি। জীবন কি কেবলই হারিয়ে ফেলে যা কিছু ব্যক্তিগত তার? নাহ্! সরাপিঠে আর কামিনী আতপের পায়েসে সে জীবনকে ফিরে পেতে শিখেছে।
সেই ছায়াপথ বেয়ে বেয়ে মডিউলার কিচেন মুগের ডাল ভেজে নিচ্ছে। হয়তো মুগের পুলি হবে। মানুষ কি হাত দিয়ে রান্না করে! মোটেই না। মোটেই না। স্বাদ আর স্মৃতি দিয়ে গড়া ওর রান্নাঘরখানি। সে ঘরে তাই মানুষে মানুষে হাজার ফারাক। কেউ ভালোবাসে ক্ষীরসা দিয়ে সাদা নরম পাটিসাপটা, কারো বা পছন্দ ঝাল পিঠে। এতো ব্যক্তিগত এই স্বাদ, এই বিন্যাস – একে অঙ্ক দিয়ে বিচার করবেন কী করে! (Winter)

খুব ভোর ভোর মেটে উনোনখালি লেপে নিয়েছে কেউ। এখন শুকনো কুটো জ্বেলে কেটলি বসাবে। চালের গুড়ায় গুড় আর নারকেল কোরা বিছিয়ে ভাপা পিঠে হবে। রঙ চা দিয়ে মানুষেরা গরম গরম পিঠে খাবে। বেলা বাড়লে ঝুড়ি বিছিয়ে নরম সরুচাকলি ভেজে তুলবেন খুড়ি মা। কে বলে আস্ত পৃথিবীটা একখানা গেরাম বই নয়! আমি কিন্তু বেশ টের পাই – একেকটা ব্যক্তিগত কৌম দিয়ে ঘেরা একেকটা গ্রাম স্বাদ আর গন্ধের কাছে ফিরে যেতে চাইছে স্মৃতির সরণী বেয়ে। (Winter)

বিশ্বায়নের পৃথিবীতে এই বা কম কী! এই পৃথিবীর আগে একখানা মানুষের হাতে গড়া পৃথিবী ছিল। পৌষের সংক্রান্তি সেই পৃথিবীকে ভালোবেসেছে। ভালোবেসেছে বলেই না এমন করে সে ফিরে যেতে চাইছে কেবলই। পাড়ায় পাড়ায় চালের গুঁড়ো বিকোচ্ছে ওই। গুড় আর নারকেল না হলে কি সংক্রান্তি হয়! ব্যস্ত মানুষেরা শান্ত পায়ে ঘরে ফিরবে এখন, দাওয়ায় বসে ভারী যত্নে পিঠে খাবে। হোক না সে ভারী সাধারণ! হোক না সে সামান্য! অজয়ে সেই কবে যেন পদ্ম ফুটেছিল কেন্দুবিল্ব গাঁয়ে। (Winter)

এও কি তারচেয়ে কম কিছু হলো! পিঠের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে রান্নাঘরের ওপারটিতে। স্মৃতির মাঝে জেগে উঠছে হৃদকমলখানি। জীবন কি কেবলই হারিয়ে ফেলে যা কিছু ব্যক্তিগত তার? নাহ্! সরাপিঠে আর কামিনী আতপের পায়েসে সে জীবনকে ফিরে পেতে শিখেছে। কী নিঃশর্ত ওর নিবেদন দেখুন! পদাবলী কীর্তনের আখর হয়ে কী নিপুণ ভাবে ওর ফিরে আসা। এসেছেও। সংক্রান্তির দিনে। (Winter)
সেদ্ধ মুগ সামালি পিঠা
উপকরণ : মুগডাল, চালের গুঁড়ো, গুড়, নারকেল কোরা, ঘি, এলাচের গুঁড়ো, ঝোলা খেজুর গুড়।
পদ্ধতি : মুগের ডাল শুকনো খোলায় ভেজে ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করতে বসান। জল একটু বুঝে দেবেন। ডাল সেদ্ধ হবে, জলও মোটামুটি শুকিয়ে যাবে এইরকম। ডাল খুব বেশি গলিয়ে ফেলবেন না। এই সেদ্ধ ডাল আর নারকেল কোরা বেটে নিন। কড়াই আগুনে বসান, অল্প ঘি দিন। ঘিয়ে ডালবাটা আর গুড় দিয়ে পাক করে নিন। পাক ভালোভাবে কড়াই থেকে ছেড়ে এলে এলাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে ঠাণ্ডা হতে দিন।

অন্যদিকে অল্প জল বসান। জল ফুটে উঠলে চালের গুঁড়ো দিন। জল টেনে গেলে নামিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখুন। হাত সওয়া গরম হলে নরম করে মেখে নিন। এবারে এই মাখা থেকে লেচি কেটে ভিতরে মুগডালের পুর ভরে পুলিপিঠে গড়ে নিন। একটি হাঁড়িতে জল বসান। হাঁড়ির মুখে কাপড় বেঁধে দিন বা জালি বসিয়ে নিন। জল ফুটে বাষ্প বেরোতে শুরু করলে পুলিগুলো সাবধানে সাজিয়ে দিন। মিনিট ১০/১২ পরে পুলিগুলো সুসিদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে ঠাণ্ডা হতে দিন। ঠাণ্ডা ভাপা মুগসামালি ঝোলাগুড় দিয়ে পরিবেশন করুন।
খইয়ের পায়েস
উপকরণ : দুধ, খই, ভালো পাটালি গুড় আর ছোট এলাচের গুঁড়ো (ইচ্ছে হলে তবেই দেবেন)।

পদ্ধতি : ভালো সুগন্ধি চালের খই পেলেই ভালো, অন্যথায় এমনি খই দিয়েই করবেন। প্রথমে খই থেকে ধান বেছে নিন। দুধ জ্বাল দিতে বসান। দুধ ফুটে অর্ধেক হয়ে এলে ঘন দুধে খই দিন। খই সেদ্ধ হবে কিন্তু গলে যাবে না। সেদ্ধ হলে গুড় দিন। গুড় গলে গেলে আরেকটু ফুটিয়ে নামিয়ে নিন। সামান্য এলাচের গুঁড়ো দিতে পারেন। তবে, গুড়ের গন্ধই যদি রাখতে চান তাহলে আর এলাচের গুঁড়ো দেবেন না। এই পায়েস ঠান্ডা অথবা গরম দুই ভাবেই উপাদেয়। বানাতে সময়ও খুব বেশি লাগে না।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, bing, bing
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
One Response
test