অর্থনীতির আরেক নাম ডিসম্যাল সায়েন্স। কিন্তু তাই বলে অর্থনীতিবিদরা যে শুধুই নিরাশার মধ্যে ডুবে থাকতে ভালবাসেন একথা ভুলেও ভাববেন না। পাশের ট্যাবে চট করে একবার সার্চ করে দেখুন, আই-এম-এফ এর ওয়েবসাইট থেকে ব্লুমবার্গ পত্রিকা, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ থেকে মর্গান স্ট্যানলির সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র, সর্বত্র অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন সুদিন প্রায় এসেই গেছে। খামোখা মানুষজনকে ভয় যারা পাওয়াচ্ছিলেন তাঁদের জোর ধমক দিয়ে বহু বিশেষজ্ঞ তথ্যপ্রমাণ সহ সাব্যস্ত করেছেন ২০২০-র শেষেই বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা আশাতীত। খোদ আমেরিকাতেই অর্থনীতি W বা L নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথামতন V পথে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ পতন যতটা আকস্মিক ছিল উত্থান-ও প্রায় সমগতিতে এসেছে। ইমার্জিং বা উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতি নিয়ে যারা চর্চা চালান, তাঁরাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন এই দেশগুলিও পিছিয়ে থাকবে না। ২০২১-এ ভারতবর্ষের অর্থনীতি বৃদ্ধি পাবে সাড়ে আট থেকে নয় শতাংশ হারে, মেনে নিচ্ছেন প্রায় সমস্ত বিশেষজ্ঞরাই।
[the_ad id=”270088″]
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ লাইন দু’টো মনে পড়ে গেল, “আষাঢ় এসে ভীষণ জোরে দুয়ারে দিল নাড়া/ শীর্ণ হাতে শিশুরা খোলে খিল”। অতিমারীর দাবদাহের পর নতুন বছরের বারিসুধা যে কালীঘাট থেকে ক্যালিফোর্নিয়া কাউকেই বঞ্চিত করবে না, সে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
টের পাওয়া যাচ্ছে আরো কিছু – পৃথিবী রসাতলে গেলেও নব্য উদারনীতির প্রবক্তা এবং অনুসরণকারীরা তাঁদের সেই একমাত্রিক এবং ভেতরফোঁপরা তত্ত্বের বাইরে গিয়ে ভাববেন না। ২০২০ -তে এসেও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দেখিয়ে একটা দেশের সাফল্য বা ব্যর্থতার খতিয়ান তৈরি হচ্ছে শুনলে ভারী আশ্চর্য হতে হয়।
ব্রিটেনের খ্যাতনামা সংবাদপত্র ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ‘ সম্প্রতি এরকমই কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বেকি জার্ভিস, তিনি ব্রিটিশ দূরদর্শনে স্বাধীন ভাবে কাজ করতেন। বিভিন্ন টিভি শো‘র প্রযোজনায় বেকি জড়িয়ে ছিলেন অতিমারীর আগে। অতিমারীর দরুণ সে সব কাজই গেছে, উপরন্তু বেকি ব্রিটিশ সরকারের কোনো অনুদান-ও পাননি। কেন? কারণ জাতীয় সম্পদ মাপার সূচক বেকির পরিষেবাকে পাত্তা দেয় না। ফলে একত্রিশ বছরের বেকিকে দিনে একবেলা খাবার কম খেতে হচ্ছে, সব বেলা খাবার জোটানোর মতন টাকা তাঁর নেই।
নিজেদের দেশের দিকেই তাকানো যাক। ২০১৮-১৯ এর জাতীয় অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী ভারতের শ্রমজীবী মানুষদের প্রায় ৯৩% অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। কোভিড চলাকালীন এই মানুষগুলির অধিকাংশই খাদ্য,আশ্রয়, অর্থ কিছুই পাননি তাঁদের চাকুরিদাতাদের থেকে। চাকুরিদাতা অবশ্য লেখার খাতিরে বলতে হচ্ছে, বাস্তবে তাঁদের পরিচয় ‘মালিক’। লকডাউনের দরুণ মালিকরা ভারতীয় শ্রমিকদের পত্রপাঠ বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন বলে এঁদের প্রাপ্য পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে দেওয়ার ঝক্কি না নিয়েছিলেন সরকার, না নিয়েছিলেন মালিকরা। লকডাউনের দরুণ এ বছরের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ভারতীয় অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছিল প্রায় তেইশ শতাংশ, তৃতীয় কোয়ার্টারে কিছুটা উন্নতি হলেও কোভিড-পূর্ব অর্থনীতির তুলনায় মোটের ওপর সেই সঙ্কোচনই বহাল ছিল। লকডাউন উঠে যাওয়ার দরুণ এবার ধীরে ধীরে আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা জারি থাকবে। আর সেই সুবাদেই ২০২১-এ ভারতীয় অর্থনীতি আট-ন শতাংশ হারে বাড়বে ধরে নেওয়া হচ্ছে। ধারণা করে নেওয়া যায় বাংলা, বিহার, ছত্তিশগড়ের গরিব খেটে খাওয়া মানুষগুলি আবার রুজির মুখ দেখবেন। কিন্তু অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দিয়ে আসল সমস্যার তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার মাপার জন্য আমরা দেখি উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারমূল্য। কিন্তু সেই বাজারমূল্যের ঠিক কতটা যাচ্ছে মালিকদের কাছে আর কতটা শ্রমিকদের কাছে তা নিয়ে জাতীয় সম্পদ বা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার এই সূচকগুলি টুঁ শব্দ করে না। ফলে পুঁজিবান মালিকপক্ষ ফের সিংহভাগ মুনাফা ঘরে তুলবেন, সরকারের ঘরেও কর হিসাবে কিছু টাকা যাবে কিন্তু অগুন্তি ভারতীয় ন্যূনতম টাকায় আবারও দিন গুজরান শুরু করবেন। এদিকে কোভিডের সময় সরকারি ব্যর্থতায় এবং মালিকপক্ষের উদাসীনতায় এঁদের কতজন যে শুধু দু’ বেলা খাওয়া জোটানোর জন্য স্থানীয় মহাজনদের কাছে ঋণ নিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। ‘আত্মনির্ভর ভারত‘ যোজনাতে বলা হয়েছিল সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ভার নেবে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার। ডিসেম্বরে এসে দেখা যাচ্ছে সরকারি হিসেব অনুযায়ীই মাত্র তেত্রিশ শতাংশ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছেছে। বাকিদের কাছে খাবার পাঠানোর পরিকাঠামো নেই। ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার ধ্বসে পড়া গুদামঘর থেকে ঠিক কী মানের খাবার এই তেত্রিশ শতাংশের কাছে পৌঁছেছে সে নিয়েও সন্দেহ থেকে যায়।

স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রান্তিক মানুষদের এহেন সমস্যা সম্ভবত চিরকালীন। কিন্তু কঠিন দিনের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও, এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার তাঁদের সমস্যা নিয়েও ভ্রূক্ষেপ করে না। এই দুই শ্রেণীর বহু মানুষ আজ *‘গিগ ইকোনমি‘তে শ্রমদান করেন। অর্থাৎ ছোট ছোট একাধিক কাজ করে চলেছেন সারা দিন ধরে। এবং এই অধিকাংশ কাজই কিন্তু উৎপাদন ভিত্তিক নয়, পরিষেবা ভিত্তিক। জাতীয় সম্পদ বা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের আওতায় পরিষেবা আসে না। অতএব, গিগ ইকোনমিতে প্রাণপাত করে যারা বেঁচে থাকতে চাইলেন তাঁদের চাকরি থাকল না গেল তা কিছুই বোঝা যাবে না ওই আট-ন শতাংশের পাটিগণিত দিয়ে। লকডাউনের পরে তাঁদের রুজিরোজগার ঠিক কতটা বাড়ল বা আদৌ বাড়ল কিনা সে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন থেকে যাবে।
[the_ad id=”270084″]
অসংগঠিত ক্ষেত্র, গিগ ইকোনমির পাশাপাশি আরেক গোষ্ঠীর মানুষদের জন্যে সমূহ সর্বনাশ ডেকে এনেছে এই অতিমারী। কাদের কথা বলছি? যাঁরা স্বনির্ভর। আঁকিয়ে হোক কি বার-সিঙ্গার, ফটোগ্রাফার হোক কি ফ্রিলান্স কপি-রাইটার, প্রায় কোনো দেশের সরকারই এদের কথা ভাবছেন না। ব্রিটেনের খ্যাতনামা সংবাদপত্র ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ‘ সম্প্রতি এরকমই কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বেকি জার্ভিস, তিনি ব্রিটিশ দূরদর্শনে স্বাধীন ভাবে কাজ করতেন। বিভিন্ন টিভি শো‘র প্রযোজনায় বেকি জড়িয়ে ছিলেন অতিমারীর আগে। অতিমারীর দরুণ সে সব কাজই গেছে, উপরন্তু বেকি ব্রিটিশ সরকারের কোনো অনুদান-ও পাননি। কেন? কারণ জাতীয় সম্পদ মাপার সূচক বেকির পরিষেবাকে পাত্তা দেয় না। ফলে একত্রিশ বছরের বেকিকে দিনে একবেলা খাবার কম খেতে হচ্ছে, সব বেলা খাবার জোটানোর মতন টাকা তাঁর নেই। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির সাহয্যে হয়ত ক্রিসমাসের সময়টুকু তাঁর চলে যাবে, তারপর কী হবে কেউ জানে না। বলা বাহুল্য এহেন নৈরাশ্যে ডুবে যেতে যেতে অজস্র দেশের অসংখ্য মানুষ তাঁদের জীবন নিয়ে সবথেকে কঠিন এবং ভয়াবহ সিদ্ধান্ত প্রতি দিন নিয়ে চলেছেন।
মনে রাখা ভাল বিশ্ব অর্থনীতি আপাতত ঘোরতর মন্দার মধ্যে দিয়ে চলছে। এবং অক্সফোর্ড বা ফাইজার পরীক্ষামূলক ভাবে করোনাভাইরাসের টীকা নিয়ে এলেও সামনের চার -পাঁচ মাসের মধ্যে কোভিড সন্ত্রাস থেকে মুক্তি নেই। বিল গেটস জানিয়েছেন ক্রিসমাসের সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে যে শিথিলতা দেখা দেবে তার দরুণ সামনের বছরের প্রথম চার-পাঁচ মাসে কোভিডের প্রকোপ ঘোরতর হবে। গেটস ফাউন্ডেশন এহেন অতিমারীর কথা জানিয়েছিল সেই ২০১৫ সালেই, এবং তাঁদের অর্থানুকূল্যে বহু বিজ্ঞানী করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক বার করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অতএব, বিলের কথাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি কোন জায়গায় পৌঁছতে পারে?
[the_ad id=”270085″]
২০২০-র অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি মৃত্যুমিছিল বাড়তে শুরু করলে প্রায় যে কোনো দেশেই লকডাউন অবশ্যম্ভাবী। এদিকে গত ন‘মাস ধরে যে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তার জন্য মাস খানেক, মাস দুয়েক ধরে সব কাজ মুলতুবি রাখাও সম্ভব নয়। উপরন্তু বহু দেশের সরকারকে শেষ কিছু মাসে এত ভর্তুকি দিতে হয়েছে যে কর বাড়ানো ছাড়া তাঁদের হাতে উপায় নেই। রাজকোষ ভরানোর জন্যও অর্থনীতিকে সচল রাখতেই হবে। কোভিডের প্রকোপ বাড়লে তাই ছোট ছোট সময়সীমার মধ্যে লকডাউন জারি রাখতে হবে। অথবা সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে সম্পূর্ণ লকডাউন জারি করে বাকি এলাকায় বিপদের স্তরবিন্যাস অনুযায়ী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাজকর্মে বিধিনিষেধ জারি হবে। স্বাভাবিক ভাবেই দেখা দেবে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। কিন্তু সেই অনিশ্চয়তাকে একটা গাণিতিক রূপ দিলে দেখা যাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য অনিশ্চয়তার পরিমাণ বিভিন্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ, অনিশ্চয়তার প্রেক্ষিতেও দেখা দিচ্ছে অসাম্য। এবং একথা বোঝা দুঃসাধ্য নয় যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, গিগ ইকোনমির পরিষেবাকর্মী বা স্বনির্ভর চাকুরিজীবীদের কথা আগে লিখেছিলাম তাঁদের জন্যই অনিশ্চয়তা সবথেকে বেশি। পৃথিবী জুড়েই। এবং এই অনিশ্চয়তার কিছু সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকতে পারে যা শুধু টাকাপয়সার হিসেব দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।
*গিগ ইকোনমি – এমন একটি খোলা বাজার যেখানে অস্থায়ী শ্রমিক অথবা স্বল্প দিনের জন্য নিয়োজিত শ্রমিক কর্মসংস্থান পেতে পারেন।
আগামী সংখ্যায় সমাপ্য – প্রকাশিত হবে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধে ছটা।
প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রিটেনের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক। অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন সংবাপত্রে অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন প্রবীরেন্দ্র। এছাড়াও লিখেছেন একাধিক কল্পবিজ্ঞান ও রহস্যকাহিনী। তাঁর প্রকাশিত বইগুলি হল 'বাইট বিলাস', 'ক্যুইজ্ঝটিকা', 'পরিচয়ের আড্ডায়', 'আবার ফেলুদা, আবার ব্যোমকেশ', এবং 'চার'।
One Response
গুরুত্ববহ লেখা