“চার দেয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে/সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে…”
আমার ছোটবেলার গান। মান্না দে। হঠাৎ সত্যি হয়ে গিয়েছে, আমরা না চাইতেও। এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অরগানিজ়মের তাড়নায়। সে নিজে নিষ্প্রাণ। সক্রিয় হতে তার প্রয়োজন অন্যের সাহায্য, মানুষের সাহায্য। আর মানুষ তার এই অনাহুত অতিথির হাত থেকে বাঁচবার জন্য ঘরের কোণায় গিয়ে লুকিয়েছে। ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি রব চতুর্দিকে। স্কুল কলেজ, দোকানপাট সব বন্ধ। বন্ধ মল, সিনেমা হল, রেস্তোরাঁও। পৃথিবী এখন কিছুকালের জন্য অচল। অন্ততঃ যে ভাবে আমরা তাকে দেখতে অভ্যস্ত, সে ভাবে আপাতত দেখা যাচ্ছে না। সারা পৃথিবীর গায়ে কারা যেন তালা ঝুলিয়ে চলে গেছে– টেম্পোরারিলি ক্লোজ়ড। উইল রিটার্ন সুন্।
রিটার্ন তো বুঝলাম। কিন্তু কোথায়?

করোনা ভাইরাসের আড়ালে অন্য যে ভাইরাসটা লুকিয়ে বসে আছে, সে তো বহুদিন ধরে মানুষকে আক্রান্ত করে রেখেছে! সে শরীরে মারে না। মনকে ঝাঁঝরা করে ফেলে, ধীরে। খুব ধীরে। অসুস্থ মানুষ চায় একটা ছোট্ট, নিজস্ব পৃথিবী তৈরি করতে, যেখানে থাকবে শুধু তার পরিবার, তার ধর্ম, তার জাতি। প্রতিবেশীকে সেই পৃথিবী থেকে বহিস্কার করতে সে বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না, যদি সে প্রতিবেশী অন্যধর্মী হয়। এই মানুষ স্বার্থপর। নিজের আখের গুছোতে সদাব্যস্ত। করোনা ভাইরাসের ভয় ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই বাজার থেকে উধাও পণ্য, ওষুধ। অল্প কিছু লোক কিনে নিতে চায় পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, বাঁচার রসদ। ভুলে যায় পাশের বাড়ির শিশুটিরও দুধের প্রয়োজন। সেখানেও থাকতে পারে অসুস্থ মানুষ। বোঝে না, যে শেষমেশ একা বেঁচে থাকা যায় না। বেঁচে গেলে দশা হতে পারে সেই ২০০১ স্পেস ওডিসির ডঃ ডেভিড্ বোম্যানের মতো, যে একা একাই কাটিয়ে দেয় তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়। জীবিত কিন্তু সঙ্গীহীন।
এই মানুষই অনায়াসে নিজের অসহায়তার দায় চাপিয়ে দেয় অন্যের উপর। জন্ম দেয় কনস্পিরেসি থিওরির যা প্রমাণ করবার চেষ্টা করে, এই ভাইরাস আসলে চিন দেশের সৃষ্টি, পৃথিবীর কর্তৃত্ব দখলের উপায় মাত্র। এ জন্য তারা নিজের দেশের মানুষকে বলি দিতেও প্রস্তুত! আবার এই মানবজাতিই বিশ্বাস করে, করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে চিন দেশে বাদুড়ের মাংস খাবার অভ্যাস থেকে। পৃথিবীর কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছে চিন এবং এশিয়ার নাগরিকদের প্রতি বিদ্বেষ। সে বিদ্বেষের সঙ্ক্রমণ ঘটছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দোকান-পার্ক-রাজপথে। মানুষের ক্যামেরাতে এখন শুধুই নিজস্বী।
করোনা ভাইরাসকে ঠিক প্রকৃতির প্রতিশোধ বলা উচিত হবে কিনা জানি না। কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে যে পরিবেশকে ধর্ষণ করে এসেছে মানুষ, সে পরিবেশের চেহারাটা গত কয়েক দিনে পালটে গেছে আমূল। হাঁসেরা হাঁটতে বেরিয়েছে খোলা রাস্তায়। বিমানবন্দরের টার্ম্যাকে, গাছের পাতায় সবুজের ঘেরাটোপ, নদীর জলে আবার মুখ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার! যে বাতাস কিছুদিন আগেও ছিল দূষিত, বিষাক্ত, তাতে এখন ফুসফুস ভরা অক্সিজেন। জানলার গরাদে মুখ লাগিয়ে এই পৃথিবীকে দেখছে মানুষ, যেমন দেখে চিড়িয়াখানার বাঘ।

করোনা ভাইরাসের মুখ্য প্রতিষেধক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা আগে ছিল মানুষের স্বেচ্ছাকৃত। সোশ্যাল মিডিয়াতে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, কিন্তু মনের কথা বলে কি? কে বন্ধু, তার মাপকাঠি হয়েছে কে আমার পোস্টে কটা লাইক দিল, কে আমার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত। যে আমার বিরোধিতা করল তাকে আমার ভার্চুয়াল ঘর থেকে বার করে দিতে আমার কোনও অসুবিধে নেই। আমার দূরত্ব আমি নিজেই তৈরি করি।
একটা ধারণা অবশ্য আছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য মানুষ ফিরে পেয়েছে তার ছোটবেলার বন্ধুদের। দুনিয়াটা হয়ে গেছে ছোট্ট। এসে গিয়েছে হাতের মুঠোর মধ্যে, আক্ষরিক অর্থে। আসলে এটা কথার কথা। তিরিশ বছরের হারিয়ে যাওয়া অতীতের সঙ্গে কিছু ছোটবেলার ছবির বিনিময়, ছ’মাসের উত্তেজনা। তারপর আবার নিজের জগতে ফেরা। ফেসবুকে পাঁচশো, হাজার বন্ধু ঘিরে আছে সবসময়। তবে তো আর একা থাকার ভয় নেই। নেই? একটা হিসেব দিই। অ্যামেরিকাতে ২০১৪ সালে আত্মহত্যার হার ছিল প্রতি লক্ষে তেরো জন, যা ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। ১৯৯৯ থেকে ২০১৪ র মধ্যে এই হার বেড়েছে ২৪ শতাংশ। ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে পরিসংখ্যান আরো চিন্তাজনক (শুধু ২০১৫ সালেই এই সংখ্যাটা ৫০০০ এর বেশি, মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ)। এই চেহারা সারা বিশ্বের। ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অরগানাইজেশানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ তে আত্মহননের শিকার হবে ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ। গবেষকদের মতে, এর পিছনে এক বড় অবদান ইন্টারনেটের। বা আরও বিশদে বলতে গেলে সোশ্যাল মিডিয়ার, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।
তাহলে কী দাঁড়াল? সোশ্যাল মিডিয়া কাছে টানল না দূরে ঠেলল?
সবাই এখন লকডাউনে। শহরে কারফিউ। বাড়ির দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাইরে থেকে কারও প্রবেশ নিষেধ। বাইরে যখন অন্ধকার, তখন সময় ঘরের ভিতরে আলো জ্বালবার। নিজের চারপাশটা একবার ভালো করে দেখবার। যে বইটা তাকের উপর ধুলো মেখে পড়ে আছে অনেকদিন, সেটা নামিয়ে পড়বার। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে জিজ্ঞেস করার, – “কেমন আছিস?” চল্লিশ বছর আগে মায়ের যে কথায় অভিমানে বুকটা ভরে গিয়েছিল, সেটা মাকে জানাবার। যে ছেলে গত বহু বছর ধরে খেলতে চেয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে এখন চুপ করে গিয়েছে, এখন সময় হয়েছে তার সঙ্গে দাবা খেলতে বসবার, নিয়মগুলো ভালো না জানলেও। ছোটবেলার যে গানটার সুরটুকু শুধু মনে আছে, তার কথাগুলো খুঁজবার সময় এসেছে এবার।
যদি চাও তবে ছুঁয়ে দিতে পারো মন
কারফিউ নেমেছে আজ শহরাঞ্চলে
শিল্পী নিরুদ্দেশ, ফাঁকা রবীন্দ্র সদন
এসো মুখোমুখি বসি রাত বেশি হলে ।
করোনা ভাইরাস একসময় চলে যাবে। সেরে যাবে এ সাময়িক জ্বর। কিন্তু পৃথিবীর যে গভীরতর অসুখ এখন, তাকে মোকাবিলা করার কিছু পাথেয় কি এই ভাইরাস শেখাতে পারবে? দেখা যাক। আশা রাখতে দোষ কোথায়? আশাই তো। আশা ছাড়া মানুষ বাঁচেই বা কী ভাবে?
ডঃ আনন্দ সেনের জন্ম কলকাতায়। হিন্দু স্কুল ও পরে সেন্ট জেভিয়ার্সে স্কুলজীবন কাটিয়েছেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে স্নাতকস্তরের পড়া শেষ করেই পাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই বাসা। পেশায় ডেটা সায়েন্টিস্ট হলেও কবিতা লেখা আজও প্যাশন। আরও এক প্যাশন বাংলা থিয়েটার। প্রবাসে থেকেও নিয়মিত থিয়েটারের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত আনন্দ। নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন ই-পত্রপত্রিকাতেও।