চারিদিকে “বাড়িতে থাকার” এই সাবধানবাণী শুনতে শুনতে মন আচ্ছন্ন হয়ে এল সেই তাঁদের কথা ভেবে, যাঁরা বাড়ি ছেড়ে বহুবছর ধরেই এক মানসিক আবাসে। অন্তরা সাইকায়াট্রিক সেন্টার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, গোবিন্দপুর।
গত আঠারো বছর ধরে আমি যুক্ত এই সংস্থাটির সঙ্গে। নানা অসুবিধে, ঝড়বৃষ্টি, সাইক্লোন বা প্রিয় প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আঙ্কল জনের মৃত্যু- কোনও অবস্থাতেই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়নি কোনও থেরাপি ইউনিট। কর্মকর্তারাই সামলেছেন সব সঙ্কট। এই প্রথম জারি হল এক যুদ্ধকালীন নিষেধ। আপাতত বন্ধ আমাদের শনিবারের ক্লাস- এস্থেটিক থেরাপি ইউনিটও। আবাসিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কথা ভেবেই। কারণ আমরা, যারা না-আবাসিক এবং বাইরে থেকে যাই, তারা তো না জেনেই বাহক হতে পারি ওই মারণ ভাইরাসের! একজনের বহন তখন শতজনের ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সে সঙ্কট সামলানোই যে এক নিদারুণ সঙ্কট হয়ে দেখা দেবে।
অ্যাকিউট (Acute), রিহ্যাবিলিটেশন বা রিহ্যাব (Rehab) এবং লিভ (leave)- এই তিন পর্যায় শেষ হলে তবেই ডিসচার্জ। এই নিয়মে এক দীর্ঘ সময় ধরে চলে নানা ওয়ার্ড। এমনকী শিশুদের ওয়ার্ড এবং কেমিক্যাল ডিপেন্ডেনসি ওয়ার্ডও। আর এর সঙ্গে আছে কিছু দুঃস্থ মানুষ যাঁদের কেউ কোত্থাও নেই। না কোনও স্বজন, না আত্মজন। আর আছে পুরুষ এবং মহিলা গ্রুপ হোম। এই গ্রুপ হোমে তাঁরাই থাকেন যাঁদের বাড়ির লোকেরা মনোরোগীর ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত করতে গ্রুপ হোমকে মনে করেন এক নিরাপদ আশ্রয়। বাড়ি নামক আর এক “বাড়ি”। এখন কোথায় যাবে এই মানসিক অবসাদগ্রস্ত মানুষগুলি? বিশেষত দুস্থ স্বজনহীন আর গ্রুপ হোমের একদল ছেলেমেয়ে? এটাই তো তাঁদের বাড়ি। আর শিশু ওয়ার্ডের এক ঝাঁক শিশু, তারা? ডে-কেয়ারেও আসেন বহু রোগী, যাঁরা প্রতিদিন যাতায়াত করেন এবং সারাটা দিন বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকেন মনের চিকিৎসায়। এঁরা সকলেই এক একটা ওয়ার্ডে দল বেঁধে থাকেন, দল বেঁধে খান, দল বেঁধে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন ক্লাসে ক্লাসে। কেয়ার গিভারদের সজাগ তদারকিতেই ঘড়ি ধরে যাঁদের জীবনে বাঁচা আর অবসাদমুক্তি। তাঁদের দিনাতিপাতে এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (isolation) তো এক মর্মান্তিক পরিস্থিতি!
এমনিতেই তাঁরা এই হাসপাতালের আবাসিক হিসেবে বছরের পর বছর শুধু পরিবার বিচ্ছিন্নই নন, বিচ্ছিন্ন সমাজের মূলস্রোত থেকেও। আর ব্যক্তিগত ভাবে নিয়মিত তাঁদের কাছে কতজনই বা আসেন! তবু এই রকম একটা অঘটনে বন্ধ করে দিতে হল হাসপাতালের দরজা। শুধু যে পরিবার পরিজনদের ওপরই রাশ টানা হল তাই নয়, রাশ টানা হল নানা হাসপাতাল থেকে যে শিক্ষানবিশরা বাস ভর্তি হয়ে প্রতিদিন আসেন কেস-স্টাডি করতে, তাঁদের ওপরেও। ভিন রাজ্য এবং বিভুঁই থেকে হস্টেলে থাকতে আসা দেশি-বিদেশি গবেষক ও ছাত্রদের ওপরেও। আর কমিউনিটি এক্সটেনশন প্রজেক্ট-এর (Community Extension Project) কারণে ইস্কুল কলেজের যে ছেলেমেয়েরা তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে আসে, তাদের ওপরেও।
এই এতরকম মানুষের আনাগোনায় এখানকার আবাসিকরা কিছুটা হলেও একাকিত্বের ভার থেকে মুক্ত থাকেন। তাঁরা যে দুনিয়ার বার নন, এই বোধ তাঁদের আনন্দ দেয়। ক্রমাগত লোক চলাচলে এতটাই সজীব থাকে এই “অন্তরাগ্রাম” যে এখানে ঢুকে, চারিদিক দেখে মনেই হয় না যে এটা কোনও মনের অসুখ বা নেশা ছাড়ানোর চিকিৎসাকেন্দ্র। শুধু গাছ-ফুল-খরগোশ বা হাঁসই নয়, এখানকার সকলেই অভিবাদনপ্রিয় এবং সহজ। তাই এখানকার রোগীরা তথাকথিত পরিবার এবং চেনা জীবনের ছন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও আর এক বৃহৎ পরিবারের অংশ বলেই নিজেদের মনে করেন। কিন্তু সেই বোধে এক চরম আঘাত হেনেছে আজকের এই ঘোর দু:সময়ের isolation। একটা মস্ত চত্বরে দল বেঁধে থাকাই যায়। কিন্তু এতজনে মিলেও যাঁরা একা এবং আপনজনের সঙ্গহীন তাঁদের ক্ষেত্রে ‘সঙ্গ’ই যে সব চেয়ে বড় আশ্রয়! একদিকের সঙ্কট যেমন এতজনে একা কী করে হবে? অন্য দিকের ভাবনা, যে এই সংশ্রবহীনতার ফল কী দাঁড়াবে! অথচ অন্য কোনও বিকল্পও তো আর নেই! আর নেই বলেই ক্রমান্বয়ে সকলে মিলে ভাববার!
আমরা কয়েকজন যে সপ্তাহে একদিন যাই এস্থেটিক থেরাপি নামে একটি বিভাগ চালাতে, সেও তো নতুন নতুন ভালোলাগা নিয়েই ফিরি। দু’ঘন্টা ধরে মেতে থাকি রবীন্দ্রনাথের গান আর নাচে। কত আগ্রহ আর অপেক্ষা ওদের। আগ্রহ আমাদেরও। পরষ্পরে শোনবার এই ইচ্ছেটাই তো আসল শুশ্রূষা। কত পরিশ্রমে তিল তিল করে মনের আনাচে কানাচে সুর ঢোকে, কথা জেগে ওঠে। ঘুমের ওষুধ খাওয়া ভারী অপটু শরীরে নাচ বসে। অসংলগ্ন আঙুলে মুদ্রা, ক্লান্ত উদাসীন চোখে ভাব- নবরস। দু’পক্ষের আগ্রহী উপস্থিতিতেই তো এই সব শুশ্রূষা। এ কি ওয়র্ক ফ্রম হোমের বিষয়? ইস্কুল কলেজ বা অফিসে তবু যদি বা চলে, এই সব ক্লাসে তা কখনওই সম্ভব নয়। সক্ষম আর অক্ষমের ক্ষেত্রে যে কোনও বিনিময়েই সপ্রাণ উপস্থিতি এক নি:শর্তের শর্ত, যার কোনও বিকল্প নেই। বিকল্প হয় না। আমাদের Home ব্যক্তিগত। আর ওঁদের Home দলবদ্ধ। আমাদের Home আমাদের পছন্দ ও অপছন্দ নির্ভর। আর ওঁদের Home অসুস্থতা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয়। যেমন, ওঁদের কোনও ঘরেই আয়না নেই। কারণ কাচ ভাঙলে বিপদ । না, কোনও বাথরুমে ছিটকিনিও নেই। ভেজানোর দরজা শুধু আছে। আমাদের Home সুরক্ষা আর স্বাচ্ছন্দ্য। ওঁদের Home নিরাপদ আর স্বাস্থ্যসম্মতভাবে নিয়মানুবর্তি। আমাদের Home ইচ্ছে মতো দিন, ইচ্ছে মতোই রাত এবং রাত জাগা। ওঁদের Home নিয়মিত ঘুমের ওষুধ আর অসুস্থতায়, দিনেরাতে ঘুমিয়ে থাকা। আমাদের Home উৎকন্ঠাবিহীন। ওঁদের Home প্রতি মুহূর্তে সজাগ- কেয়ারগিভারদের নিয়মিত নাইট শিফট আর বিনিদ্র উৎকন্ঠায়। Home শব্দ দিয়ে আমরা যা বুঝি, এখানে তার প্রয়োগ, সেটা থেকে বহু বহু কঠিন। এই রকম Home আছে বলেই এই তথাকথিত আমাদের জীবন এত সহজ। এই মনোরোগ আক্রান্ত একটি মানুষকেই যখন বাড়িতে রেখে আমরা শুশ্রূষা দিতে পারি না, এঁরা তখন কয়েকশো মানুষের দায়িত্বে। তাই Home কথাটাও এখানে সদা সতর্কতার এবং এক অন্যরকম আয়োজনের।
আর এখানকার অফিসকর্মী, মালি, রাঁধুনি, সাফাইকর্মী, ডাক্তার, সমাজকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালক- বিশেষত যাঁরা ওখানেই কোয়ার্টারে থাকেন, তাঁরাই বা হঠাৎ করে কে কোথায় যাবেন! আর চলে গেলে কী ভাবেই বা চলবে ওই অসহায় রোগীদের! আউটডোর খোলা রাখতেই হচ্ছে কিন্তু সেও এক চূড়ান্ত সতর্কতায়। দূর দূরান্ত থেকে যে মনোরোগীরা আসেন পরিষেবা নিতে, তাঁদের কী হবে! কতজনকে না, বা কতদিন না, এবং কী কারণে না! কে বোঝাবে আর কে বুঝবে!
আর এক দিকে আবাসিকদের ভিজিটর আসাতেও রাশটানা হয়েছে। কারণ নানা রাজ্যের মানুষ এখানে আবাসিক। কে কোথা থেকে সংক্রমণ বয়ে আনবেন হয়তো চিহ্নিতই করা যাবে না! আর এর সঙ্গে আছে আগাম মজুতের ভাবনা! কতই বা মজুত করা যাবে ওষুধ, খাবার ও অন্যান্য না-হলেই-নয় জিনিসগুলি! মেডিক্যাল কিট, কমিউনিটি কিচেন এবং সাধারণ ক্যান্টিন চালাতে যে সব সংস্থার সঙ্গে যোগানের ব্যবস্থা করা আছে সেখানে টান পড়লে দুম করে যে অন্য কোনও দোকান থেকে কিনে নেওয়া যাবে এমনও নয়! প্রায় পাঁচশো মানুষের, প্রতিদিন চারবেলার সংস্থান মজুত এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা হঠাৎ করে বাড়িয়ে রাখা কি সোজা কথা! আর তার সঙ্গে উদ্বেগ ও দায়বদ্ধতা? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি তবু পারে। পারে না স্বেচ্ছাদান ও অনুদান নির্ভর এই সেবামূলক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি।
ওই বিশেষ মানুষগুলি আমাদের ভাষায় ‘পাগল’ হলেও আসলে চরম সহিষ্ণু। দিশেহারা হয়ে উত্তেজনা জানাবার অবস্থাতেও তাঁরা নেই। কথায় কথায় আপডেট দিতে তাঁরা পারবেন না। এখানে থাকা, তুলনায় সুস্থরা যদিও খুবই সচেতন। তাঁরা নিয়মিত কাগজ পড়ছেন, খবর দেখছেন। কিন্তু তাঁদের মনের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, তার খেয়াল রাখছেন ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা মানুষগুলি আর ডাক্তাররা। আবাসিক চিকিৎসকদের দিন রাত এক হয়ে গেছে উদ্বেগে।
এদিকে এই আমরা তো কত কী করছি। সেসব দেখে মনে হচ্ছে, ছুটি না সংক্রমণ তা যেন বুঝে উঠতে পারছি না! ‘আমি’ আর আমার হাতপা-সম পরিবারের গুটিকয় জন নিরাপদ কিনা ভেবেই চলেছি। কে আমায় কী কী সুবিধে দিয়ে গেল, আমি কেমন কতখানি বেনিয়ম করতে পারি, আর কী কী আমার ছুটির উপকরণ, এসবেই মজে আছি। একটু যদি অন্যভাবে দেখা যায়, ভাবা যায় সেই পরিবার-উদ্বৃত্ত মানুষগুলির কথা, যাঁদের জীবন এবং যাপন সবটাই দলবদ্ধ এবং তা যে শুধু সেবানির্ভরই নয়, অনেকখানি পরনির্ভরও বটে! যদি একটুকুও ভাবা যায় সেই সমস্ত চিকিৎসক, সেবিকা এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা মানুষগুলির কথা যেখানে ওয়র্ক ফ্রম হোম একেবারেই চলবে না, যেখানে অর্থও সুরক্ষা দিতে পারবে না! যেখানে চলবে না পরষ্পরে দোষারোপ করে দায় এড়ানো। যেখানে এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক মৃত্যুতেও জনরোষ এবং নানা প্রশ্নের জবাবদিহি দিতে হতে পারে! তাহলেই বোঝা যাবে সামাজিক দায় কী এবং কেন।
অন্তরা নামক এই মানসিক আবাসটি আমার পরিচিত এবং এদের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে আমি যুক্ত বলেই এতসব জানতে পারছি। হাসপাতাল পরিষেবায় যুক্ত সকলকে সচেতনভাবে সক্রিয় রাখতে কী ভাবে তৈরি হয়েছে আপৎকালীন ওয়াটস্যাপ গ্রুপ। ভাবা হচ্ছে এই সেন্টারেই ডিসপোজেবল মাস্ক আর দস্তানা তৈরির কথা, ভাবা হচ্ছে আরও কত খুঁটিনাটি। কারণ, কোনও অবস্থাতেই পরিস্থিতি না হাতের বাইরে চলে যায়। আজ, এ তো যে কোনও চিকিৎসাকেন্দ্র, এমনকি সংশোধনাগারেরও ছবি, যেখানে স্বনির্বাচনের সুযোগ নেই বললেই হয়। কিন্তু মনোরোগীদের ক্ষেত্রে তা আরও নিদারুন, কারণ তাঁদের ভয় পাওয়ার মনটাই তো বিবশ, আচ্ছন্ন এবং আংশিক হলেও ঘুম পাড়িয়ে রাখা। আমার যেন বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন হল এই প্রান্তিকে থাকা মানুষগুলির সংস্পর্শে এসে। এদের জড়িয়ে আমাদের জীবনযাপনে সতর্কতা জারি করা সময়ও আজ এক কতবড় দুঃসময়!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই কবে লিখেছিলেন,
“সুন্দরের মন খারাপ, মাধুর্যের জ্বর।”
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
3 Responses
?????????? ?? ??? ?????? ????!
Sunrise is not locked down,
Love is not locked down,
Family time is not locked down,
Kindness is not locked down,
Creativity is not locked down
Learning is not locked down
Conversations are not locked down
Imagining is not locked down,
Reading is not locked down
Relationships are not locked down
Praying is not locked down
Meditation is not locked down,
Sleeping is not locked down
Work from home is not locked down
Hope is not locked down
Self-time is not locked down
Cherish what you have.
?????? ???? ?? ?? ??????????? ?? ?? ???? ??? ?????? ??????!
From Mr.Thomas John -CEO Antra
সত্যি, এই অন্যরকম মানুষরা কি করবে? লেখাটি সময়োপযোগী, কিন্তু সমাধান কি?
অন্য জায়গার কথা জানিনা, এখানে নানা রকম ব্যবস্থা অতি তৎপর ভাবে নেওয়া গেছে এবং সমানেই নেওয়া হছে, যা খুবই আশা ব্যঞ্জক। আর সকলেই সবরকম ভাবে সাহায্য করছে।