Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দিনের পরে দিন: ছাদের স্মৃতি

আলপনা ঘোষ

জুন ২২, ২০২০

Terrace
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

কোভিড-১৯ তখনও এ শহর থেকে দূরে, বহু দূরে! চিনের প্রাচীরের ওদিকে কী নাকি এক অসুখ এসেছে, লোক মারা যাচ্ছে অসংখ্য। খবরের কাগজের পাতায় উহান প্রদেশের নাম বেরুচ্ছে প্রতিদিন, যেখানে এই রোগের প্রথম সূত্রপাত। সেই প্রথম পরিচিতি আমার ‘উহান’নামটির সঙ্গে। এই রোগের প্রথম লক্ষণগুলির শুরু নাকি সামান্য জ্বর, নাক দিয়ে জল পড়া, গলা ও গায়ে ব্যথা ইত্যাদি যাকে সেই ছেলেবেলা থেকে জেনে এসেছি ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’বলে। কিন্তু এই সব লক্ষণ যে এমন প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, সে কথা বিশ্বের মানুষ তো বুঝতেই পারেনি প্রথম দিকে। চিন থেকে কী ভাবে যেন রোগটা ছড়িয়ে পড়ল। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হল ফ্রান্স। একে একে ইউরোপের অন্য সব দেশও। ইতালিতে মৃত্যুর হার ভয়াবহ। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাও ছাড় পেল না। তবু তখন পর্যন্ত আমরা ভারতবাসীরা ভাবছি আমরা নিরাপদে আছি, নিরাপদে থাকব।

এ বছরের শুরুতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটল ভারতের কেরলে। যার শুরু কিন্তু সেই চিনে। একটি দু’টি করে কোভিড-১৯-এর খবর। মহামারী ততদিনে অতিমারীর আকার নিয়েছে। ভারতে লকডাউন যখন শুরু হয়েছিল, নিশ্চিত করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় ৫০০। আমাদের ঘাড়েও মৃত্যুর নিশ্বাস! ২২ এপ্রিল, সারা দেশ জুড়ে একদিনের প্রতীকী লক-ডাউন। তখনও মনে ক্ষীণ আশা, প্রতীকীর ওপর দিয়েই শেষ হবে ব্যাপারটা। আমরা বেঁচে যাব। আরে, সেই কবে কবি লিখে গেছেন, “মণ্বন্তরে মরিনি আমরা/ মারী নিয়ে ঘর করি…”! জীবাণুময় এই দেশে আমরা যদি বেঁচে থাকতে পারি, তা হলে এই সামান্য এই করোনা আমাদের কাবু করবে, এ কথা আমরা সত্যি ভাবতে পারিনি। কিন্তু রেহাই পেলাম না আমরাও। শুরু হল লকডাউন এই বঙ্গভূমিতেও। কাঁধের উপর মৃত্যুর হিমশীতল থাবা। নিমেষে জীবন যেন ওলটপালট হয়ে গেল আপামর শহরবাসীর।

আমার নিজের বাস দক্ষিণ কলকাতার এক আবাসনে। লকডাউনের প্রথম কোপটি পড়ল আমাদের গৃহ-সহায়িকাদের ওপরে। এদের একটি বড় সংখ্যা আসেন নিকটবর্তী এক ঘিঞ্জি বসতি থেকে, যেখানে ইতিমধ্যেই করোনা থাবা বসিয়েছে। গৃহিণীদের মাথায় হাত। সরকারি নির্দেশে অফিস কাছারি বন্ধ। বন্ধ সব বিদ্যায়তন। বারবার সংবাদপত্র, টেলিভিশনে সরকারি নির্দেশের প্রচার- ‘বাড়িতে থাকুন। নিরাপদে থাকুন’। পুলিশও সদা সতর্ক। কবি লিখেছেন “আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে”। চার দেয়ালের মাঝে আটক মানুষ সেই আকাশে মুক্তির-খোঁজে আজ ছাদ-মুখী। বছরের পর বছর যে ছাদকে ভুলে শহরবাসী দিন কাটিয়েছে, করোনা আজ সেই ছাদকে পরম আশ্রয়স্থল করে তুলেছে। খোলা আকাশে নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে ছাদকেই মানুষ বেছে নিয়েছে। নতুন করে ছাদ সাফাইয়ের ধূম পড়ে গেছে নিচু উঁচু সব বাড়িতে। আমার বাড়ির জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি পাশের একতলা বাড়ির ছাদে মানুষের আনাগোনা। দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যরক্ষার কারণে প্রাতঃভ্রমণের নিরাপদ জায়গা এখন ছাদ। সান্ধ্য আসরে মুখোশ পরে খোশগল্পের আদর্শ জায়গাও এই করোনার দিনে সেই ছাদ। কোনও কোনও পাড়াতে আবার ছাদে ঘুড়ি ওড়াবার ধূম পড়ে গেছে। একদিন আমিও এক গোধূলি বেলায় শরণাপন্ন হলাম ছাদের। আকাশে দেখলাম উড়ন্ত রংবেরঙয়ের ঘুড়ির মেলা। কানে ভেসে এল ভো-ও-ও-ও-কাট্টা ধ্বনি। আশ্চর্য ভাবে ফিরে পেলাম আমার ছেলেবেলার প্রায় বিস্মৃত ছাদকে।

Terrace
ষাট-সত্তর দশক পর্যন্ত যখন বাঙালির জীবনের সঙ্গে ছাদের সম্পর্ক ছিল প্রায় অবিচ্ছেদ্য। ছবি সৌজন্য – tumblr.com

একটা সময় ছিল সেই ষাট-সত্তরের দশক পর্যন্ত যখন বাঙালির জীবনের সঙ্গে ছাদের সম্পর্ক ছিল প্রায় অবিচ্ছেদ্য। এখনও মনে পড়ে বালিগঞ্জের একতলা বাড়ির ছাদের কথা। চিলেকোঠায় এক কোণে ছিল আমার পুতুলখেলার জায়গা। ওই ছাদে আমার পুতুল মেয়ের সঙ্গে পাশের বাড়ির উমার পুতুল ছেলের বিয়ের আসর বসেছিল। যৌথ পরিবারের হ্যাপা সামলে এক একদিন সন্ধ্যেবেলায় মাদুর পেতে মা ছাদে গিয়ে বসতেন। পাড়ার গিন্নিরা এসে যোগ দিতেন আসরে। পাড়ার যত খবর আর তাতে রং চড়িয়ে গল্প বানাতে জুড়ি ছিল না মুখুজ্জে গিন্নির। সে সবের ছিঁটেফোঁটা আমাদের কানে পৌঁছবার আগেই কচিকাঁচাদের বিদায় নিতে হত মায়েদের ছাদ-আড্ডা থেকে। মা-ঠাকুমারা ছাদে বড়ি দিতেন, নানা মশলা দিয়ে নিজেদের হাতে প্রস্তুত বোতল-বন্দি আচার মজাতে সারি সারি বোয়াম রেখে দিতেন ছাদের রোদ্দুরে। বিয়ের মরশুমে বাড়ির ছাদে ম্যারাপ বেঁধে একদিকে ভিয়েন বসত আর অন্যদিকে পাত পেড়ে অতিথি সৎকারেরর আয়োজন। তখন ‘বিয়েবাড়ি’ভাড়া নিয়ে বিয়ে বা ক্যাটারারের হাতে অতিথি সৎকারের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা বাঙালির কল্পনার বাইরে ছিল। আমার ছোটপিসির বিয়ে হয়েছিল ষাটের দশকে এক বৈশাখের দিনে। মনে আছে বাড়ির ছাদ ঢেকে দেওয়া হয়েছিল বাঁশের ম্যারাপ বেঁধে। ভিয়েন বসেছিল সেখানে। ঠিক বিকেল থেকে কালবৈশাখি ঝড় উঠেছিল। বাঁশের ওপরে বাঁধা ত্রিপল ঝড়ের দাপটে উড়ে যাওয়ার জোগাড়। কাকারা ও পাড়াতুতো দাদারা দৌড়ঝাঁপ করে বাঁশগুলোকে নতুন করে বেঁধে সে যাত্রা বিয়েবাড়ির ভোজ পন্ড হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। ছাদে ছাদে ছেলে-মেয়ের প্রেমও কিছু কম হত না। সেই প্রেম-কাহিনি নিয়ে কত গল্প, কত কবিতা। কত প্রেম ভাঙা-জোড়ার সাক্ষী হয়ে থেকেছে সে দিনের ছাদ। এসব গল্প অবশ্য আজ বিলীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে।

Terrace
একমুঠো সবুজের জন্য এখন শহরবাসী ছাতেই আশ্রয় খোঁজে। ছবি সৌজন্য – bangla.tribune.com

ছাদ নিয়ে আমার মনেও আরও যে কত স্মৃতি! মায়ের শখ ছিল গাছের। মনে আছে সারা সংসারের কাজ সামলিয়ে মা একটা সময় বের করে নিতেন গাছের পরিচর্যার জন্য। ছাদের একদিকটাকে মা বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন। কত রকমের ফুল যে ফুটত- জুঁই, বেলি, কামিনী, জবা। একটা লেবুগাছ পুঁতেছিলেন। মনে আছে তাতে লেবুর ফলন হয়েছিল বেশ। সব গাছই মাটির টবে লাগিয়েছিলেন। মা-পিসিদের সান্ধ্য আড্ডায়, সুগন্ধী ফুলের সৌরভ ছিল এক বাড়তি পাওনা। তবে বাড়ির পুরুষদের মধ্যে বয়স নির্বিশেষে ছাদের মাহাত্ম্য বৃদ্ধি পেত বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটিতে। বাবা, কাকা, দাদা সবাই মিলে দিনভর ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ঘুড়ি ওড়াতে। সে দিনটিতে সারা আকাশ জুড়ে রংবেরং ঘুড়ির মেলা আর ভোঁ-কাট্টা বলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতাতে সামিল হওয়া। কার ক’টা ঘুড়ি কাটা পড়ল তা নিয়েও বাকবিতণ্ডা কম হত না। দোলের দিনে আমাদের বাড়িতে খুব ঘটা করে আবির দিয়ে রং খেলার রীতি ছিল। রং খেলার জায়গাও ছিল সেই ছাদ। সন্ধ্যেতে ফরাস পেতে ছাদেই বসত গানের আসর সেদিন, সঙ্গে ভুরিভোজ। আমার ঠাকুর্দা, ছোড়দাদুর গানের গলা ছিল দারুণ। দুই ভাই হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। এস্রাজে তান তুলতেন আমার মণিপিসি আর তবলায় ঠেকা দিতেন ছোড়দাদুর ছেলে আমাদের রাঙাকাকু। বাবা আবৃত্তি করতেন রবীন্দ্রনাথের ‘হোরিখেলা’।

শীতের আগে আমাদের বাড়ির ছাদে ধুনুরিরা এসে বসত, ওদের ধোনাই যন্ত্র নিয়ে। এখনও যেন কানে শুনতে পাই সেই একটানা ধুনুরির শব্দ। গৃহস্থের ফরমাশ মতো পুরনো লেপের তুলো ধুনে, তার সঙ্গে খানিকটা নতুন তুলো মিশিয়ে নতুন কাপড়ের মোড়কে ওঁরা তৈরি করে দিতেন কম খরচের লেপ। কখনও আবার নতুন তুলো দিয়ে একেবারে আনকোরা নতুন লেপ। সরু বাঁশের ঝাঁ চকচকে একটা লাঠি থেকে ঝুলতো লাল কাপড়ের একটা পুঁটলি। সেই লাঠির ছড়ে অদ্ভূত শব্দ তুলে ধুনুরিরা এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বেড়াত। ওই আওয়াজ কানে এলেই ঠাকুরমা ডাক দিতেন ধুনুরিকে। ছাদে এসে ধুনুরি যখন বসত, আমরা ছোটরা অপেক্ষায় থাকতাম পুঁটুলি খোলার। তার মধ্যে থেকে বেরুত পাটে পাটে রাখা বালিশ, লেপ তৈরির শিমুল তুলো, খোপকাটা কাপড় বা লাল শালু। ছাদে স্তুপাকার করা জমাট তুলো ধোনার সুরেলা শব্দ আর ছাদময় উড়ন্ত পেঁজা তুলো জানান দিত “এল যে শীতের বেলা”। শীতের আগে ট্রাঙ্ক থেকে বেরুত শীতের জামাকাপড়, সিন্দুক থেকে লেপ-কম্বল। ন্যাপথিলিনের গন্ধমাখা সেসব শীত-সামগ্রী রোদ খাওয়াতে ছাদে যত্ন করে ফরাসের ওপরে বিছিয়ে দিতেন বাড়ির মেয়ে বৌয়েরা।

Terrace
সেখানে মেয়েরা বসত পিতলের গামলা-ভরা কলাইবাটা নিয়ে। ছবি সৌজন্য – bangla.jagoroniya.com

ছাদ প্রসঙ্গে মনে এল রবি ঠাকুরের ‘ছেলেবেলা’গ্রন্থে তাঁর লেখার অংশবিশেষ– “বাড়ি-ভিতরের এই ছাদটা ছিল আগাগোড়া মেয়েদের দখলে। ভাঁড়ারের সঙ্গে ছিল তার বোঝাপড়া। ওখানে রোদ পড়ত পুরোপুরি, জারক নেবুকে দিত জারিয়ে। সেখানে মেয়েরা বসত পিতলের গামলা-ভরা কলাইবাটা নিয়ে। টিপে টিপে টপ্‌ টপ্‌ করে বড়ি দিত চুল শুকোতে শুকোতে। দাসীরা বাসি কাপড় কেচে মেলে দিয়ে যেত রোদ্‌দুরে”। নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে শোকার্ত রবির একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল সেই ছাদ। এই প্রসঙ্গে চিত্রকর, লেখিকা এবং কবির স্নেহধন্যা রানী চন্দের কাছে কবির কিছু কথা– “সে সময়ে আমি গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে পায়চারি করেছি আর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছি, ‘কোথায় তুমি বৌঠান, একবার এসে আমায় দেখা দাও”। কতদিন এইভাবে সারা রাত কাটিয়েছেন কবি আর গেয়েছেন তাঁর প্রিয় গান, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে / বসন্তের বাতাসটুকুর মত/ সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে-/ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত/ সে চলে গেল, বলে গেল না”…।

Author Alpana Ghosh

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

Picture of আলপনা ঘোষ

আলপনা ঘোষ

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
Picture of আলপনা ঘোষ

আলপনা ঘোষ

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

One Response

  1. পড়লাম। সুন্দর স্মৃতি। ধনুরিদের বিশেষ আওয়াজটা আমিও দিব্যি শুনি মাঝে মাঝে। তবে আমাদের ছাদটা অন্য লোকের ছিল। এরকম আরও নানা স্মৃতি ভীড় করে আসে। সেসব নিয়ে মাঝে মাঝে লিখেছি। লোকগুলো কোথায় মিলিয়ে গেল। একতলার বারান্দায় মাঝে মধ্যে মা বড়ি দিতেন। পিসি টিসি ছিল না। সেসব গল্পগুলো লিখতে হবে। মার তেঁতুলের আচারটা বড় ভাল ছিল।

    রবি ঠাকুর যে ঐ গানটাই গাইতেন জানতাম না। গানটা শক্ত। খুব কষ্ট করে তুলেছি। কাদম্বরী ছাড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস