১.
আমার কথা ওরা কেউ বুঝতেই পারে না
মুখ টিপে হাসে, কিছুক্ষণ পর তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দেয়– এবার চুপ করুন।
বিস্ময়ে বলে উঠতে চাই– কেন!
শব্দের উচ্চারণ ফেলে রেখে এসেছি সম্ভবত কোন এক দূরের গুহায়
তাড়াহুড়োয় নিয়ে আসতে ভুলে গেছি হয়ত
এসব মামুলি মনে রাখার চেয়েও আরও কত কিছু আছে
এসব বোঝাব কাকে! করুণা করতে ইচ্ছে হয় ওদের বোধ আয়তনের দৈন্যকে
চুপ হয়ে যাই। বাঙ্ময় শব্দশূন্যে কেঁপে ওঠে স্তরীয় প্লবতা
গাছের নাম অর্জুন হলেও তা থেকে খসে যাওয়া পাতাকে অপেক্ষমান হাওয়া
উড়িয়ে নিয়ে যায় উদ্দেশ্যবিহীন, ঠিকানাহীন সাকিনে বনজ বলয় গড়ে ওঠে
তুমি হেঁটে এলে সে পথে মর্মর বেজে উঠতে পারে
আসছ?
২.
এক ঝাঁক দেবশিশু একসাথে হলে যে আলোর অতিরেক, কোনওদিন তাকিয়ে দ্যাখোনি
রোদ্দুরের কমলা রং থেকে উড়নির রাঙিয়ে ওঠা একমাত্র আমিই দেখেছি
এরপর সিঁড়িভাঙা অঙ্কে রাখা মেঘবেলা, আকুল পারানি কিংবা প্রথামাফিকের মত দাগ
এক আকাশ ক্যানভাসে তোমার হাতখোঁপা রাখলেই যে ছবির পিক্সেলে সুর খেলে গেছে
আমি তাকে বঁড়শিতে গেঁথে নিই মহার্ঘ্য চারের আদলে
বসে থাকি ধৈর্যের এপাড়… অনিবার্য হেরে যেতে হয় এরপর
ফিরে আসবার পথে দেখি, সম্পর্কের দায় থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে গোত্রহীন পরিখার ঘুমজলে অনাত্মীয় টান
যুযুধান নিজের সাথেই প্রশ্নরা
আমাকে রেখে চলে আসার সময় আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলে
কে যেন তোমার কাঁধে হাত রেখেছিল…
ততক্ষণে ধিকিধিকি পোড়ানোর খেলা শুরু করে দিয়েছ, ও চাঁদ!

৩.
লেবুপাতা থেকে পিছলে যাওয়ার সময় রোদ্দুরেও লেগে রইল মিহি গন্ধের অনায়াস
এ পাঁচিল থেকে ও পাঁচিলে লাফ দেওয়ার আগে শূন্যের মাপ নিল বিষয়ী মার্জার
কেন ‘গৃহস্থের খোকা হোক’ পাখিটার ডাক শুনে তুমি খুব কষ্ট পেয়েছিলে, আমি জানি
মনের ভেতর ডুবুরি নামালো যারা, কেন ওদের নিরস্ত করনি, তুমি জানতে না
আমাদের মাঝখানে আজ অনতিক্রম্য ফাঁকগুলো একদিনে তৈরি হয়নি?
কাঙ্খিতের সম্মোহে কতবার হারিয়েছে সব ইয়ত্তা নেই
চল, এই শেষ বার ঝুঁকি নিই, ওই সাঁকোটিতে যাই
যার নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে লাভা নদী… ওপরে মাংসাশী পাখি… এপাশে লকলকে জিভ… ক্রুদ্ধ শলাকা ওপাশে
মুহূর্তের ক’কোটি ভাগের এক ভাগ ত্রুটিও বিপর্যাস ঘনিয়ে তুলতে পারে, দেখি কে পিছলে যায়, যাবে?
সম্পর্কে দ্বন্দ্ব থাকে আচারের মত তীব্র স্বাদে, তবে সে স্বাদ নিত্য নয়, এ কথা তোমার আমার চেয়ে ভাল কে জানে!
যা কিছু অসীম, তাকে মুঠোয় রাখতে চেয়ে আমাদের মধ্যে প্রলম্বিত হয়ে ওঠে অপসরণের ঘোর জাঁক
অবশেষ থেকে খুঁজে পাওয়া যায় গ্রিনরুমের হাসিকান্না, মেকআপের পেছনে যে তিরতির বয়ে যাওয়া নদী
৪.
প্রস্তাবিত মাপমাত্রা ধরে নাও সত্যি হয়ে গেল একদিন
বাবুইয়ের বাসাটি ঝড়ে উড়ে গেলেও দুটো ডিম দু’শাখার মাঝখানে নিয়তির মত ঝুলে রইল
পরিপাটি করে দেওয়ার পর মা পাখির দুই চোখে না-পেরিয়ে-যাওয়ার অব্যক্তে কী যেন ছিল!
নিরীহ হরিণের টাটকা রক্তে ঘাসেরাও সাক্ষী রইল পৃথিবীতে খিদেই নির্ণায়ক।
চালতে চালতে শস্যের দানা থেকে গুঁড়োপাথর আলাদা হয়ে এলে পরিযায়ী প্রবৃত্তির কাছাকাছি এল শীতঋতু
আচ্ছা, দুই বিপ্রতীপের কাছাকাছি আসার ঘটনাও তো ঘটে। সেভাবেও কি…
তুমি সাড়া দেবে না জেনেই বেরিয়ে এসেছি রাত্রির তৃতীয় প্রহরে
পড়ে রইল রিপুর তাড়না, সঙ্গোপনে অর্জিত স্থাবর, বিলাসবাঞ্ছা– এসব আমার নয়
মুক্তিবেগ– শ্লথ ভৌমজল নামছে নীচের দিকে।
আত্মীয়তার বৃথা চেষ্টা পড়ে আছে ফাঁকা শামুকের খোলসের মতো।

৫.
অন্তর্লীন পরিমিতি বোঝানো গেল না বলে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল বিস্ফোরণ
এ যে কী যন্ত্রণা! বিদীর্ণ–উন্মুখ সূচীমুখ থেকে কিছুতেই উৎসারিত হচ্ছেনা কাঙ্ক্ষিত বর্জ্যের তোড়
এই দোলাচলে থাকতে থাকতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আসার কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে
একটা বিরাট শূন্য ক্রমশঃ গিলে নিচ্ছে এযাবৎ অর্জন, দগদগে ঘা-এর ওপর এসে বসছে মাছি
এবার নিজের দিকে তাকাও ভেতরে…
বাসনাতরণী কতদূর চলে গেলে পিছুডাকও পৌঁছয় না ততদূর
এরপর সম্পর্কের সুতো আলগা হয়ে আসার কথা…
ভালবাসা দীর্ঘদিন ধরে একই পাত্রে ঢেলে খেতে খেতে স্বাদ হারায়
তার চেয়ে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা থাক
আসা ও যাওয়ার সব নিক্ষেপ অভিক্ষেপ হেলায় হারিয়ে মন তার বাস্তুভিটে ছেড়ে কোত্থাও গেল না
ব্যূহের অন্তরে অবাঙমনসগোচরে কী হিল্লোল! কী হিন্দোল! ব্যথাও ছাড়িয়ে যায় বিস্মৃতিপুর
আদৌ কি আশা করেছিলে? ভরসা রেখেছিলে? তোমার কি লেশমাত্র বিশ্বাস ছিল আবার আগের মতো…
এইসব জানাশোনা আজ বড় জরুরি হয়ে উঠেছে।
জন্ম ১৯৭১ সালে কলকাতায়। বর্তমানে রাজ্য সরকারের কর্মচারী। রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প ও কবিতা দুই বাংলার একাধিক ছোট ও বড় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ পায়।