২০০৫ সালের জুলাই বা অগস্ট মাসের এক গুমোট সন্ধ্যা| আকাশে মেঘ দলা পাকিয়ে আছে| বৃষ্টি হব হব করেও হচ্ছে না| দুরু-দুরু বুকে বন্ডেল গেটের কাছে একটি ফ্ল্যাটের দোতলার দরজার সামনে দাঁড়ালাম| বেল টেপার কয়েক মুহূর্ত পর দরজা খুলে যে মানুষটিকে দেখতে পেলাম, তাঁর সামনে যে কখনও এভাবে দাঁড়াতে পারব,আগে ভাবিনি|
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ততক্ষনে তাঁর স্নেহ মাখানো গলায় আমাকে ডাকছেন– ‘আরে, এস এস| তুমি তো কলকাতাতেও বিলিতি টাইম মতো চল দেখি|’ ছোট্ট বসার ঘর জুড়ে বই| এ ঘরে বসেই উনি লেখেন| একদিকে দুটি চেয়ারের একটিতে বসলেন উনি| ঘরের মাঝখানে একটি সেন্টার টেবিল| তার অন্যদিকে আর একটি চেয়ারে বসতে বললেন আমাকে| বৌদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন| ওঁকে বললেন– ‘আমাদের জলখাবারটা দিয়ে যাও এবার।’
আমার নরেন্দ্রপুরের প্রথম দিনের বন্ধু দীপ্র ঝা ‘Music World’-এর প্রথম জেনারেল ম্যানেজার ছিল| সেই সূত্রে ওর শংকরের সঙ্গে পরিচয়| শংকর RPG গ্রুপের দায়িত্বশীল পদে থাকার সুবাদে| দীপ্র আমার কথা ওঁকে কোনও সময়ে বলে থাকবে| তাতে উনি নিজেই আমার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন| সেই সূত্রেই ওঁর বাড়ি যাওয়া|

অথচ এত বড় সাহিত্যিকের উল্টোদিকে বসে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কোনও সুযোগই পেলাম না| মনে হল কতদিনের পরিচিতি ওঁর সঙ্গে| কথা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের ভেতর বৌদি আমাদের প্লেট ভর্তি ধবধবে সাদা লুচি আর গাঢ় সোনালি হলুদ ছোলার ডাল দিয়ে গেলেন| খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেতে খেতে নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন প্রবীণ সাহিত্যিক|
বয়োঃজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাঙালিদের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করে| কী বলে ডাকব এঁকে? কাকু-কাকি, জেঠু-জেঠি, মেসো-মাসি, নাকি দাদা-বৌদি? আমার একটা সোজা হিসেব আছে। আমার সঙ্গে সরাসরি যাঁদের সঙ্গে আলাপ আর যাঁরা আমার চেয়ে বয়সে বড়– তাঁদের আমি দাদা বা দিদি বলি| যাঁদের সঙ্গে আমার বাবা বা মায়ের সূত্রে আলাপ, তাঁদের জন্য তোলা থাকে অন্য গুরু-গম্ভীর ডাকগুলো| এই সূত্রানুযায়ী আমি শঙ্করকে প্রথম দিন থেকে ‘দাদা’ বলে ডাকি| অমায়িক, স্নেহশীল মানুষটির জন্য গুরুগম্ভীর কোনও ডাক হলে বেমানান লাগত|

দাদা নিজের কথা কমই বলেন| আমার কথা, আমার কাজের কথা জানতে চান সেই প্রথম দিন থেকে| সারা পৃথিবীর সেরা বাঙালিদের সঙ্গে দাদার পরিচয় আছে| তার মধ্যে আমার মতো নগণ্য মানুষের কথা জানতে চান, খুব ভাল লাগে | ইংলিশে একেই বলে ‘feeling valued’| শোনেন না শুধু, মনেও রাখেন|
প্রত্যেক বছর কলকাতা গেলে ওঁর সঙ্গে দেখা করি| কখনও ওঁর বাড়িতে| কখনও ভিক্টোরিয়া হাউসে ওঁর বিরাট অফিসে| খেয়াল করি, আমার আগের বলা কথা সব মনে রাখেন| সেই প্রসঙ্গে কথা বলেন| আরও নতুন কথা জানতে চান| আমার স্ত্রী বৈশালী আর ছেলে প্রায়ামের সঙ্গেও তাদের মতো করে কথা বলেন|
আমিও জানতে চাই ওঁর লেখা, কাজ, জীবন, ব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে নানা কথা| খোলামনে সব কিছু বলেন বরাবর| কোনও রাখঢাক ছাড়াই| তবে কারও প্রতি কোনও উষ্মা বা বৈরিভাব প্রকাশ করতে শুনিনি কখনও| অসাধারণ ধীশক্তি ওঁর|
আশি পেরিয়েছে অনেকদিন, তা-ও স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর| কিন্তু অদ্ভুত এক সারল্য| চকোলেট খেতে খুব ভালোবাসেন| আমি প্রতিবছর ওঁর জন্য ভাল সুইস চকোলেট নিয়ে যাই| আর বিলেতের কিছু পত্র-পত্রিকা| ভিক্টোরিয়া হাউসের অফিসে ঢোকার মুখে ওঁর সেক্রেটারি আমাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলেন– ‘ভেতরে যান| আপনার জন্যই wait করছেন|’

ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সেই উষ্ণ কাছে আসার আহ্বান| ইন্টারকমে সেক্রেটারিকে বলা– ‘এখন ঘণ্টা তিনেক কেউ যেন না আসে| আর ফোনও একদম ইমার্জেন্সি ছাড়া পাঠিও না| আর দু’ কাপ কফি দিয়ে যেও|’ শুরু হত গল্প| আমাদের দু’জনেরই কিছু কিছু সাধারণ ব্যাপারে উৎসাহ আছে| একজন মনোচিকিৎসক হিসেবে বুঝি—দু’জন ভিন্ন প্রান্তের মানুষকেও কাছে আসতে সাহায্য করে এই শেয়ার্ড ইন্টারেস্ট|
আমাদের সেই তালিকায় আছে- ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ-মা সারদা-স্বামীজি, পুরনো কলকাতা, বাংলা সাহিত্য ও সিনেমা, ব্রিটিশ ঔপনবেশিক ইতিহাস| এইসব বিষয়ে কথা হয়| আমি ওঁর লেখা নিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করি| উনি বুঝিয়ে দেন খুব সহজ করে| বলেন, ওঁর কালজয়ী লেখাগুলি নিয়ে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা|
ওঠার মুখে প্রতিবার ওঁর লেখা একটি বই উপহার দেন| কিছু কথা লিখে, সই করে| বছর এগারো আগে এমনি এক উঠে আসার মুহূর্তে দাদা জিজ্ঞেস করেন– ‘তোমাকে এবার কোন বইটা দিই বল তো?’ আমার মা তখন গুরুতর অসুস্থ এক কালরোগে| ডাক্তার হিসেবে বুঝতাম খেলাশেষের বাঁশি খুব দূরে নয়|
মা বাংলা ভাষা-সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন| আমি দাদাকে বলি– ‘আমার মায়ের (পাঞ্চালী ঘটক) জন্য ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাস দিলে খুব ভাল লাগবে।’ দাদার নিজের সই করা ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাস দিয়েছিলেন। পেয়ে মায়ের খুব ভাল লেগেছিল| জীবনের শেষ কয়েকটা মাস মায়ের বিরাট প্রাপ্তি ছিল এই বই|

মা চলে যাওয়ার পর বইটি বিলেতে নিয়ে আসি আমার সঙ্গে| আর একবার পড়তে গিয়ে খেয়াল করি স্যাটা বোসের ছোটবেলা কেটেছিল সাহেবগঞ্জে, যে শহরে আমার বেড়ে ওঠা| যে শহর ঘুরে ফিরে আসে আমার লেখায়| এক রবিবার ফোনে জিজ্ঞেস করি এই বিষয়ে| উনি বলেন ১৯৫৭ সাল নাগাদ সাহেবগঞ্জ গিয়েছিলেন, সেখানকার কলেজের বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে| গঙ্গা আর রাজমহল পাহাড়ে ঘেরা শহরটি ওঁর ভাল লেগে যায়| তখনই স্যাটা বোসের শিকড় হিসেবে এই শহরটির কথা ওঁর মাথায় আসে।
এইভাবেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক জনপ্রিয় চরিত্রের যোগসূত্র স্থাপিত হয় আমার ছোটবেলার শহরের সঙ্গে| ‘চৌরঙ্গী’ প্রসঙ্গে আমার ‘বৃষ্টিভেজা চৌরঙ্গী’ লেখায় বিস্তারিত লিখেছি| দাদা এই লেখাটি পড়েছিলেন। ওঁর ভাল লেগেছিল|
সাহিত্যিক শংকরের মূল্যায়ন করব, এমন স্পর্ধা বা ধৃষ্টতা আমার নেই| এই লেখাটি একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনাচিন্তা, আবেগের প্রতিফলন। গত ১৬ বছরে যে স্নেহ ওঁর কাছ থেকে পেয়ে এসেছি, তার স্মৃতিচারণ| উনি অ্যাকাডেমি পুরস্কার এতদিন পাননি– এই আক্ষেপ কোনওদিন ওঁর মুখে শুনিনি| আসলে ওঁর কাছে কোনও আক্ষেপই কোনওদিন শুনিনি| খুব অল্পে খুশি|

২০১৯ সালে কলকাতার শেরিফ মনোনীত হন শংকর| খুব খুশি হয়েছিলেন এতে| প্রাপ্তি ভাষণ (acceptance speech) আমাকে ইমেইল করেন| আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি সেই ঐতিহাসিক দলিল| গতবছর ফেব্রুয়ারি মাসে দেখা করি ওঁর সঙ্গে| কয়েক বছর ধরে আর চকোলেট নিয়ে যাই না, ওঁর শরীরের জন্য| গত বছর একটি পার্কার কলমে ওঁর নাম খোদাই করিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম| খুব খুশি হয়েছিলেন| বললেন, ‘আমি এই কলম দিয়ে লিখব|’ আমার জীবনে অল্প কিছু গর্ববোধের ভেতর এটি চিরকাল জ্বলজ্বল করবে|

সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার কারা দেন, কেন দেন, সে বিষয়ে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই| শুধু এটুকু বুঝি, কখনও কখনও পুরস্কারই বেশি সম্মানিত হয়, পুরস্কৃতের চেয়ে| শংকরের পুরস্কারপ্রাপ্তি সে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটাল| ওঁর সাহিত্যকীর্তি সময়ের গণ্ডি ছাড়িয়েছে বহুদিন| উনিও শতায়ু হন– এই কামনা করি|
*ছবি সৌজন্য: লেখক ও wikipedia, Pinterest
দু দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনে প্রবাসী পাঞ্চজন্য পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট। অবসর সময়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন।
One Response
( Noel Frederick) Barwell Saheb er Babu Academy peyechhen, amra khushi ebong anandito. Shei Bodh Uday hawar agei Bodhodoy para, pare Kata Ajanare ebong ta’r sequel Ei to she din! Epar Bangla, Opar Bangla! Manchitra. Nibedita Research …, Chowringhee! Oshadharan janapriya ei sahityik Kolkata r historian o bote! RPG r masto ghar eo tini sahaj swabhabik. Dhanyabad Dr Ghatak! Akta gan mone pore gelo!” Ato alo kothaye chhilo? Amon Panchajanya” ( just kidding!)