আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১]
সব স্কেচ লেখকের করা।
আমাদের ফরেস্টের সামনের কাঁচা রাস্তাটা ধরেই গাড়ি করে সবাই রিশপ যায়। এছাড়া ট্রেক করার আলাদা পথ আছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সকালে হাঁটতে হাঁটতে ওই দিকে এগোলাম, চোদ্দো বছর আগে আমাদের সেই অ্যাডভেঞ্চারের কথা মনে পড়ছিল।
কিছুটা গিয়ে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে নীচের ঘরবাড়ি, দূরের জঙ্গল নিয়ে একটা স্কেচ শুরু করলাম। পাশের পাহাড়ের গায়ে ছোটাছুটি করে খেলছিল দু’জন আট-দশ বছরের ছেলেমেয়ে। মেয়েটি আমাকে দেখে কাছে এসে চোস্ত ইংরেজিতে নানা প্রশ্ন আরম্ভ করল, পাশে ছেলেটি চুপচাপ। গালফোলা মেয়েটি তড়বড় করে নিজের নাম বলল, তেঞ্জিং ওডেন ভুটিয়া। পড়ে সেন্ট স্টিফেন্স কনভেন্টে। বোঝা গেল কেন এত স্মার্টনেস।
ছেলেটি সাদাসিধে। নাম প্রকাশ ছেত্রী। স্ট্যান্ডের সামনে অর্কিড হোটেলটা ওদের। যেতে আসতে হোটেলটা চোখে পড়েছে, মস্ত চারতলা বাড়ি। নীচে বড়সড় রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আমরা ওখানেই দুপুরে হানা দিলাম। একপাশে রান্নাঘর, মালকিন নিজেই দেখভাল করছেন। প্রকাশ এখানে খাবার টাবার টেবিলে এনে দেয়। মালকিন ওর নিজের মাসি। পর্ক না হলেও এখানে ধোঁয়া ওঠা চিকেন থুকপা কিংবা চাউমিন আমরা পরেও বেশ কয়েকবার এসে খেয়েছি। শান্তশিষ্ট প্রকাশ কিন্তু কাজের ছেলে। আমাদের দু’জনের থুকপা খাওয়ার কয়েকটা ছবি বেশ দেখেশুনে তুলে দিয়েছিল।

‘অর্কিড’-এর পশ্চিম দিকটায় ঘন গাছপালা, সামনে একটা ছোট মন্দির, ছড়ানো ছেটানো ঘরবাড়ি। দারুণ আঁকার সাবজেক্ট, দরকার কেবল আরও পরিষ্কার ভিউ। গিন্নিকে খাওয়া চালিয়ে যেতে বলে আমি সিঁড়ি ভেঙে চারতলার বারান্দায় গিয়ে হাজির হলাম। সামনের দৃশ্য অতিশয় চমৎকার, কিন্তু কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার চোটে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। কাঁপতে কাঁপতে কোনওরকমে সাদা কালো একখানা ছবি এঁকে নেমে আসতে হল।
বিকেল হতে না হতেই প্রতিদিন আমাদের কটেজ আর চারপাশের জঙ্গলটার টানে আমরা ফিরে আসতাম। খাদের ধারে ছাউনি দেওয়া গোল রেলিং-ঘেরা চত্বরটায় বসে দূরে পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্ত দেখতাম। অনেক নীচে একটা সরু রাস্তা ধরে এক আধটা গাঁয়ের লোক মাথায় বোঝা চাপিয়ে ঘরে ফিরছে, সামনের পাহাড়টার খোপে লুকিয়ে থাকা বাড়িগুলোতে ছোট ছোট ফুটকির মতো আলো জ্বলে উঠছে, মাঝে মাঝে ভুসভুস করে নীচে থেকে কুয়াশা উঠে এসে সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা যেন কোথায় হারিয়ে যেত।
এর মধ্যে অবশ্য ব্যাঘাত ঘটাবার লোকজনও ঠিক জুটে গিয়েছিল। ক্যান্টিনের দিকটায় পরপর যে গোর্খা কটেজগুলো রয়েছে, একদিন দুপুর থেকে কিছু হুল্লোড়বাজ টুরিস্ট এসে সেগুলো দখল করে জোরে গান বাজাতে শুরু করল। হাজার হোক, দেশের ঐতিহ্য বলে কথা। এ তো দেখি মহা উৎপাত, সাগরকে ফোন করে নালিশ জানালাম। ওরা নাকি শিলিগুড়ির লোক। সন্ধেবেলা বারবিকিউ করবে, সাতটা থেকে আটটা টাইম নিয়ে রেখেছে। এর জন্য একটা ঢালাই করা চাতালও আছে।
হুল্লোড় অবশ্য বেশিক্ষণ চলেনি। সাগর হয়তো কিছু বলে থাকবে, তাই নাচগানটাও কিঞ্চিৎ আস্তেই হয়েছিল। মনখারাপ হয়েছিল লাভার একদা বড় আকর্ষণ ওই লগ কেবিন দেখেও। এখন একেবারে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আবর্জনায় ভর্তি, ফায়ারপ্লেসের সামনে কতকালের পুরনো কয়লা আর ছাইয়ের পাহাড়। উলটো দিকে গাড়ি রাখার জায়গা হওয়াতে সেই নির্জনতাও উধাও। ভাল জিনিস যত্ন করে টিঁকিয়ে রাখতে আমরা আজও শিখিনি!
ঠিক করেই এসেছিলাম, লাভা থেকে আমরা কোলাখাম-এ গিয়ে দু’দিন থাকব। জায়গাটায় খুব বেশি লোক এখনও যাওয়া শুরু করেনি। এ ব্যাপারে সাগরকে বলাতে ও চেনা একটা হোম স্টে ‘ড্রঙ্গো ইকো হাট’ ঠিক করে দিল। মালিক সুন্দর রাই ওর বন্ধু। ফলে ফোনে পাকা কথা হয়ে গেল। জিপস্ট্যান্ডের সামনেই গুমটিতে গাড়ির খোঁজ করলাম, রেট সব বাঁধা। সকাল সাড়ে দশটায় বেরিয়ে পড়লাম। ৪৫ মিনিটের রাস্তা, পুরোটাই নেওড়াভ্যালির ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এছাড়া শর্টকাট রাস্তাও আছে ট্রেকিংয়ের জন্য।

কোলাখামের একেবারে শুরুতেই ড্রঙ্গো পড়ল। সুন্দর রাই বাইরেই ছিলেন। কাঠের ঝকঝকে বাড়িটিও সুন্দর। সামনের ঘরটা পাহাড়ের গায়ে রীতিমতো ঝুলে রয়েছে, তিন দিক খোলা, বড় বড় জানলা। আমরা ওটাই নিলাম। ঘরের মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি উঠে ওপরে আর একটা শোবার জায়গা রয়েছে, বাড়তি লোকজনের কথা ভেবে বানানো। বেশ আধুনিক মেজাজের সব কিছু। কোলাখামে রাস্তা বলতে একটাই, যেটাতে গাড়ি যাতায়াত করে এবং এঁকেবেঁকে নেমে গেছে ছাঙ্গে ফলস পর্যন্ত। একধারে পাহাড়ের গায়ে থাকে থাকে বাড়ি উঠে গেছে, এক আধটা চার-পাঁচতলা হোটেলেরও কাজ চলেছে জোরকদমে। বুঝলাম জায়গাটা জমে উঠছে ধীরে ধীরে।
সে রকম পায়ে হেঁটে এদিক সেদিক হেঁটে বেড়াবার ইচ্ছে হলে পাহাড় ভেঙা ওঠানামা করা ছাড়া গতি নেই। ছবি আঁকার ধান্দায় আমি যদিও এইভাবে প্রচুর ঘোরাঘুরি করলাম, গিন্নি কিন্তু দিব্যি ঘরে পা ছড়িয়ে বসে কাটালেন। প্রায় হাতের নাগালের মধ্যে গাছের ডালে দোল খাচ্ছে কতরকমের পাখি, সামনেই ঝকঝক করছে স্লিপিং বুদ্ধ। দূরের পাহাড়ে লাভা শহর আর গুম্পা দেখা যাচ্ছে। তাহলে আর কী চাই? না আরও আছে। চারবেলা ধরে যাকে বলে ফাঁসির খাওয়া! সকালে এক দিস্তে আলু পরোটার পর দুপুরে ভাতের সঙ্গে চার রকমের তরকারি আর ডবল ডিমের কারি। বিকেলে মাথাপিছু ডজনখানেক মোমো, রাতে ইয়াবড় বাটি ভর্তি মুর্গির কষা। মুঠো মুঠো জেলুসিল খেয়েও কিসসু লাভ হবে না!

এখানে জঙ্গলের গভীরে অভিযান করতে আসে বহু লোক। সঙ্গে গাইড নেওয়া আবশ্যক। আর থাকার জন্য পাহাড়ের টংয়ে রয়েছে ভারী আরামদায়ক ছোট ছোট কাঠের বাড়ি নিয়ে একটা সাজানো গোছানো রিসর্ট, যার নাম ‘জাঙ্গল ক্যাম্প’। গাড়ি যাবার রাস্তা আছে অন্যদিকে, আমি ইচ্ছে করেই ওটায় না গিয়ে পাহাড়ের পাকদণ্ডী ধরে উঠে গেলাম স্থানীয় লোকেদের ঘর বাড়ির ফাঁক দিয়ে। ওখানে দু’চারজন কর্মচারি ছাড়া কাউকে দেখা গেল না। ডাইনিং হলটা শুধু খোলা ছিল, ব্যবস্থা দেখলাম ভালই। থাকা খাওয়ার খরচাও শুনলাম নেহাত মন্দ নয়।
কোলাখাম ছেড়ে এবার আমরা যাব কালিম্পংয়ের কাছে ডেলো পাহাড়ে। সুন্দর নিজের গাড়িতে পৌছে দেবে। বললাম, সঙ্গে কিছু আলু পরোটা প্যাক করে দিতে, যেতে যেতে নাস্তা হয়ে যাবে। সকাল ১০টার মধ্যে গোছগাছ করে গাড়িতে উঠব। সুন্দরের দশ বছরের ফুটফুটে মেয়ে রিচা খাবার নিয়ে হাজির। মা বাজারে গেছে তাই ও আর ওর দাদা মিলে আমদের জন্য আলু পরোটা বানিয়েছে।

ওকে হাত নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে পড়লাম। গিন্নি ওর হাতে চকোলেট গুঁজে দিয়েছিল। গাড়ি বাঁক নিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় মিলিয়ে যাওয়া অবধি দেখলাম মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছিলাম ছোট্ট রিচা একদিন বড় হবে। তারপর এই কোলাখাম গ্রামটার মতো ধীরে ধীরে নিজের সহজ সরল জীবনটাকে হারিয়ে ফেলবে কিনা কে জানে!
স্বনামধন্য এই অঙ্কনশিল্পী নিজেই এক সম্পূর্ন প্রতিষ্ঠান | তাঁর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেয়েছে বাংলার কার্টুন শিল্প | সিগনেচার বেড়াল আর স্ব-নেচারটি কোমল, আত্মবিশ্বাসী, রসিক | বেড়ানো তাঁর নেশা | তাই ঝুলিতে রয়েছে বহু গল্প, সঙ্গে অসাধারণ সব স্কেচ | সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিরলস সাধনার অমর ফসল ‘রঙ তুলির সত্যজিৎ’ |
One Response
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে…