ফেলুদা সিরিজের প্রথম কাহিনি ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ লেখা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, আমার জন্মের আগে। ছোট থেকেই ফেলুদা পড়ি। প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পূজাবার্ষিকী দেশ জোগাড় করে এক নিঃশ্বাসে ফেলুদা পড়ে ফেলার রোমাঞ্চই ছিল আলাদা। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের এক বছর আগে ফেলুদা সিরিজের শেষ লেখা ‘রবার্টসনের রুবি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে। ফেলুদার সমস্ত গল্প ও উপন্যাস (মোট ৩৫টি) নিয়ে দুই ভল্যুমে ‘ফেলুদা সমগ্র’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। কিনে ফেলেছিলাম।
পেশায় আমি একজন ডেটা সাইনটিস্ট বা রাশিতত্ত্ববিদ, যাঁদের কাজ ডেটা বা তথ্যভাণ্ডার ঘেঁটে প্রয়োজনীয় তথ্য বার করা। এখন তথ্য বা ডেটা অনেককিছুই হতে পারে নাম্বার, ইমেজ, অডিও, ভিডিও, টেক্সট ইত্যাদি। তথ্য যখন টেক্সট, তখন তার বিশ্লেষণকে বলে টেক্সট মাইনিং বা ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং। ইংরেজি ভাষায় টেক্সট মাইনিং-এর কাজ প্রচুর হয়েছে। শেক্সপিয়রের সমস্ত রচনা কম্পিউটারে ইনপুট করে তার প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে বিশ্লেষণ হয়েছে । বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কাজ নিয়ে তার টেক্সট মাইনিং নিশ্চয়ই হয়েছে। তবে তা আমার অজানা।
এইসব থেকেই মাথায় এসেছিল যদি সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের টেক্সট অ্য়ানালিসিস করা যায়, যদি তা থেকে কিছু ইন্টারেস্টিং দৃষ্টিভঙ্গি বেরিয়ে আসে! প্রথম বাধা এল প্রযুক্তিগত। যদিও বা ফেলুদা সমগ্রের দুটি পিডিএফ আমার হাতে এল, কিন্তু তা থেকে বাংলা ফন্টে ওয়ার্ড এক্সট্র্যাকশান করব কীভাবে, তা আমার অজানা। তারপর না হয় বাংলা ভাষায় ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং-এর কিছু পাইথন ওপেন সোর্স প্যাকেজের খোঁজ পেয়েছিলাম, কিন্তু ওয়ার্ড এক্সট্র্যাকশান না করতে পারলে তা দিয়ে কোনও কাজ হবে না।
আমার সীমিত মেধায় ঠিক করলাম নিজেই কিছু বৈশিষ্ট্য বের করে কিছু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। নীচে বৈশিষ্ট্যগুলো লিপিবদ্ধ করলাম। তারপর রইল কিছু পর্যবেক্ষণ ও পরিজ্ঞান, যদি আপনাদের ভাল লাগে।
বৈশিষ্ট্য:
(১) ক্রমিকসংখ্যা, (২) লেখার নাম, (৩) সাল, (৪) পৃষ্ঠাসংখ্যা, (৫) চরিত্ররা, (৬) ঘটনাস্থল, (৭) অস্ত্রের ব্যবহার, (৮) অলঙ্করণ, (৯) গল্প না উপন্যাস, (১০) প্রকাশনা
ফেলুদার বয়স:
ফেলুদা সিরিজের দ্বিতীয় লেখা ‘বাদশাহী আংটি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। তাতে তোপসে জানাচ্ছে, তোপসের বয়স তখন ১৪ আর ফেলুদার ২৭। সুতরাং এখন ২০২০ সালে তোপসে আর ফেলুদার বয়স যথাক্রমে ৬৮ ও ৮১। লালমোহনবাবু ওরফে জটায়ুর সঙ্গে ফেলুদার বন্ধুত্ব ১৯৭১ সালে ‘সোনার কেল্লা’ থেকে। তোপসের অনুমানে তখন লালমোহনবাবুর বয়স কমপক্ষে ৩৫। তাহলে এখন তাঁর বয়স কমপক্ষে ৮৪। লালমোহনবাবু ফেলুদার থেকে কমপক্ষে তিন বছরের বড়।
চরিত্রসংখ্যা:
ফেলুদা সিরিজের তৃতীয় গল্প ‘কৈলাশ চৌধুরীর পাথর’ সন্দেশে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। গল্পটিতে মাত্র পাঁচটি চরিত্র– ফেলুদা, তোপসে, কৈলাশ চৌধুরী, কেদার চৌধুরী ও অবনীশবাবু। এর থেকে কম চরিত্রসংখ্যার ফেলুদা কাহিনি আর নেই।
আবার ১৯৮৬ সালে শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দার্জিলিং জমজমাট’ উপন্যাসে মোট ১৪টি চরিত্র যা সমস্ত ফেলুদা কাহিনির মধ্যে সর্বাধিক। সবকটি ফেলুদা কাহিনি ধরলে তাদের গড় চরিত্রসংখ্যা ৯.১৪৩। উপন্যাস ও গল্পের গড় চরিত্রসংখ্যা যথাক্রমে ৯.৩১২ ও ৯ এবং এই পার্থক্য রাশিতত্ত্বের নিরিখে গুরুত্বহীন।
লালমোহনবাবু, সিধুজ্যাঠা ও মগনলাল

‘সোনার কেল্লা’য় মুকুলের বয়স আট। সেখানে তার বন্ধু নীলুর কথাও আছে। জয়বাবা ফেলুনাথে’ রয়েছে বেনারসবাসী রুক্মিনীকুমার (রুকু) ওরফে ক্যাপ্টেন স্পার্ক। ‘অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’ কাহিনিতে আছে ফ্রকপরা মেয়ে রুণার কথা যে অন্তর্ধান রহস্যের সবকিছু আগে থেকেই জানত। ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’ গল্পে হরিনারায়ণবাবুর মেয়ে লীনা স্কুলে পড়ে। ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’ গল্পে একটি বামন ভিখারীর চরিত্র আছে। তাকে আমি শিশুশ্রেণীতে ধরছি না। ব্যোমকেশ কাহিনীর তুলনায় ফেলুদা কাহিনি যথার্থই নারী চরিত্রবর্জিত। এয়ারহোস্টেসের সঙ্গে লালমোহনবাবুর কথোপকথন আছে ‘কৈলাশে কেলেঙ্কারি’ উপন্যাসে। ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ গল্পের কণ্ঠহারটি শকুন্তলা দেবীর স্মৃতিবাহী। তবে গল্পটিতে মা প্যামেলা সুনীলা ও মেয়ে মেরি শীলা বিশ্বাস উপস্থিত।
পাঁচটি ফেলুদা কাহিনীতে বিদেশি চরিত্র আছে। তারা হল, (১) গ্যাংটকে গন্ডগোল: হেলমুট উঙ্গার, (২) গোরস্থানে সাবধান: মিঃ গডউইন, মিঃ অ্যারাকিস, (৩) টিনটোরেটোর যীশু: মিঃ ক্রিকোরিয়ান, (৪) লন্ডনে ফেলুদা: মিঃ ডেক্সটার, মিঃ ম্যানিং, মিঃ ক্রিপ্স, হকিন্স, (৫) রবার্টসনের রুবি: মিঃ রবার্টসন , মিঃ ম্যাক্সওয়েল।
রিভলবার:
ফেলুদার প্রধান হাতিয়ার আমরা সবাই জানি মগজাস্ত্র। তবে এছাড়াও ফেলুদা কাহিনিতে রয়েছে রাইফেল, এয়ারগান, স্মোক বম্ব, ভোজালি, বুমেরাং, লোহার লাঠি ও আরও অনেক কিছু। রিভলবারের প্রথম ব্যবহার ‘বাদশাহী আংটি’তে ১৯৬৬ সালে। তবে তখনও ফেলুদার হাতে রিভলবার ওঠেনি। ফেলুদা প্রথম রিভলবার ব্যবহার করে ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’ গল্পে ১৯৬৯ সালে যখন সে টায়ারে গুলি করে ভিলেনের একটা কালো অ্যাম্বাসাডার থামায়। এরপর থেকে ৬ টি গল্প ও ৮ টি উপন্যাসে ফেলুদা তার রিভলবার ব্যবহার করেছে। আনুপাতিক হারে রিভলবারের ব্যবহার উপন্যাসে ৫০ শতাংশ ও গল্পে ৩১.৫৮ শতাংশ। তবে ফেলুদার রিভলবারের ব্যবহার গল্প না উপন্যাস তার ওপর নির্ভর করেনা।
পৃষ্ঠাসংখ্যা (ফেলুদা সমগ্র অনুযায়ী):
মোট ৩৫টি ফেলুদা কাহিনিতে গড় পৃষ্ঠাংখ্যা ৪০ যেখানে উপন্যাসগুলির গড় পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৪ ও গল্পগুলির ২৮। সবচেয়ে ছোট গল্প ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’ ১৬ পাতার ও সবচেয়ে বড় উপন্যাস ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ৬৪ পাতার। ফেলুদা কাহিনীতে অলঙ্করণের সংখ্যা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করেছি। তবে খুব স্বাভাবিকভাবেই কাহিনির পৃষ্ঠাসংখ্যা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেছে কাহিনিতে কতগুলি অলঙ্করণ আছে তার ওপর।
সাল:
১৯৬৬ থেকে ১৯৯১, এই ২৬ বছরে ফেলুদা কাহিনি লেখা হয়েছে মোট ৩৫টি, গড়ে প্রতি বছরে ১৩০টি। তবে একদিকে যেমন ১৯৮৩ ও ১৯৮৯ এ তিনটি করে ফেলুদা কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি আবার ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭৭ ও ১৯৮৪ তে কোনও ফেলুদাই প্রকাশিত হয়নি। ১৯৮৯ সালে ক্ৰমিক গড় বা রানিং অ্যাভারেজ হয়েছিল ১.৩৭৫ যা ২৬ বছরের মধ্যে সর্বাধিক।
গড়ে প্রতি বছরে গল্প লেখা হয়েছে ০.৭৩ টি ও উপন্যাস লেখা হয়েছে ০.৬১৫ টি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০, ফেলুদা সিরিজের মধ্যাহ্নে, উপন্যাস প্রকাশের ক্রমিক গড় সর্বাধিক ০.৯০৯ এ পৌঁছেছিল ও গল্প প্রকাশের ক্রমিক গড় সর্বনিম্ন ০.৩৫৭ এ পৌঁছেছিল।

গল্প না উপন্যাস:
পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচারে ৪০ পৃষ্ঠার বড় ফেলুদা কাহিনিগুলি উপন্যাস। যদিও ১৯৭৬ সালে লেখা ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ উপন্যাসটি ৩৩ পৃষ্ঠার। আবার ১৯৮২ সালে লেখা ‘টিনটোরেটোর যীশু’ গল্পটি ৫৩ পৃষ্ঠার। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ফেলুদা কাহিনিগুলি মূলত উপন্যাস। যদিও ‘বাদশাহী আংটি’, ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ ও ‘হত্যাপুরী’ উপন্যাস তিনটি সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত।
পৃষ্ঠাসংখ্যা ও পত্রিকা ছাড়া ফেলুদার গল্পে অলঙ্করণের সংখ্যা পাঁচের কম, উপন্যাসে বেশি। যদিও ১৯৮১ সালের পর প্রকাশিত আটটি গল্পে অলঙ্করণ সংখ্যা পাঁচের বেশি। গল্পগুলি হল ‘টিনটোরেটোর যীশু’, ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’, ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’, ‘অপ্সরা থিয়েটার মামলা’, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’, ‘ডঃ মুনসীর ডায়রি’, ‘গোলাপী মুক্তা রহস্য’ ও ‘লন্ডনে ফেলুদা’।

অলঙ্করণ:
ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের সই দেখে যা বোঝা যায়, শুরু থেকে ১৯৮৬ সালে শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দার্জিলিং জমজমাট’ পর্যন্ত সমস্ত ফেলুদা কাহিনির অলঙ্করণ সত্যজিৎ রায় নিজের হাতেই করেছেন। পরবর্তীকালে যাঁরা অলঙ্করণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে সমীর সরকার অন্যতম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা উপন্যাসে অলঙ্করণের সংখ্যা কমেছে, কোরিলেশান -০.১৪৷ কিন্তু ফেলুদার গল্পে অলঙ্করণের সংখ্যা বেড়েছে, কোরিলেশান ০.৫০।
প্রকাশনা:
সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেশ পত্রিকায় ফেলুদার উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়েছে ও সন্দেশে গল্পগুলি। এর বাইরে একমাত্র পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ফেলুদর গল্প ‘অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ১৮টি কাহিনীর মধ্যে ১৪টির (৭৮ শতাংশ) ঘটনাস্থল পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। আবার সন্দেশে প্রকাশিত ১৬টি কাহিনীর মধ্যে ১৩ টির (৮১ শতাংশ) ঘটনাস্থল পশ্চিমবঙ্গ। এ রহস্য সমাধানে ফেলুদার মগজাস্ত্র বোধহয় একান্ত প্রয়োজনীয়।
সিগারেট, খুনখারাপি ও অন্যান্য:
স্বর্গীয় লীলা মজুমদার তাঁর ‘ফেলুচাঁদ’ রচনায় ফেলুদার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসের নিন্দে করেছেন। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে শার্লক হোমসের পাইপ খাওয়ার অভ্যাসের কথাও বলেছেন। ফেলুদা যে চারমিনার সিগারেটে অভ্যস্ত, তা এখন দুর্লভ। পরের দিকে তোপসে লিখেছে যে ফেলুদা সিগারেট খায় ঠিক কথা, তবে দশ বারো ঘণ্টা সিগারেট ছাড়াও চালিয়ে দিতে পারে। ডিটেকটিভ গল্পে খুনখারাপির আধিক্য থাকবেই। তবে তার বিশদ বিশ্লেষণ আমি বাদ রেখেছি। ফেলুদা কাহিনিতে আরো নানান গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহলোদ্দীপক দিক আছে। সেগুলো নিয়ে সবিস্তারে পরে আলোচনা করা যাবে।
মলয় দে পেশায় রাশিতত্ত্ববিদ। বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। নেশা বলতে অংকের জটিল ধাঁধা তৈরি আর তবলায় বোল ফোটানো। নিজের মনে লেখালিখি করতে আর গানবাজনা নিয়ে মেতে থাকতে ভালবাসেন।
One Response
Good. Expand on this more. Find some interesting conclusions. But definitely a very promising start and laudable effort.