পটনায় যাবার পথে ট্রেনেই জোর ঠান্ডা লেগেছিল। ফলে পৌঁছেই ধুম জ্বরে পড়ে বাবা-মাকে বেজায় মুশকিলে ফেললাম। সেটা আমার ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার পরের ছুটি। বেশ মনে পড়ে, জ্বরের ঘোরে ঝাপসা ঝাপসা দেখছি মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন- অচেনা ঘর, অচেনা দেওয়াল, জানালা। বাবার অফিসে কাজের সূত্রে আড়াই মাসের পটনাপ্রবাস ঘটেছিল আমাদের। অচেনা ওই ঘর হল পটনার শ্রীকৃষ্ণনগরের প্রহ্লাদপ্রসাদ বার্নোয়ালজির বাড়ির একটা অংশ- যেটা আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম।
বার্নোয়ালজির গিন্নি বেশ মোটাসোটা ঢলঢলে চেহারার একজন দরদী মানুষ। তাঁকে আমি আর ভাই ডাকতাম আন্টিজি। দিনসাতেক আমার এই জ্বর পর্বে রোজ ‘বিটিয়া’র জন্য কিছু না কিছু রান্না করে স্টিলের বাটি ঢাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন আন্টিজি। কখনও নরম তুলতুলে রুটি, কখনও ভাজা গমের খিচুড়ি, এখন জানি তার নাম ডালিয়া, কখনও ঝাল ঝাল সুজি, যার নাম উপমা। বাধ্যতামূলক দুধবার্লি, বেদানা, আপেলে বিষম বিতৃষ্ণা ছিল আমার। আন্টিজির পাঠানো সুখাদ্য ভাইয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিমেষে শেষ করে ফেলতাম।
আন্টিজির দু’টি ছেলে ও একটি মেয়ে। পিন্টু, রাজু আর মিনি- তারা সবাই আমার থেকে ছোট বলে আমি সকলের ইউনিভার্সাল দিদি হয়ে বসে যথেষ্ট মুরুব্বিয়ানা করতাম। ওদের সঙ্গে খেলাধুলো করা নিজের সম্মানের পক্ষে হানিকর মনে হত। ফলে বিকেলে আমার ভাই বাপ্পা, পিন্টু, রাজু, মিনি যখন সামনের মাঠে পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েদের দৌড়দৌড়িতে মেতে উঠত, আমি আন্টিজির রসুইঘরে তাঁর সঙ্গে আড্ডায় মজতাম। ভুলেও ভাববেন না আমি হিন্দি বলায় দক্ষ ছিলাম। এই ব্যাপারে তখনও যেমন, এখনও তেমন, নিতান্ত অপটু। তবে সুবিধে ছিল, আন্টিজিও বাংলা বলায় ততখানিই অপটু। তাতে বাতচিৎ করতে আমাদের কারুরই কোনও সমস্যা হত না।
আন্টিজি বিহারশরিফের কোনও গ্রামে ওঁর বাপের বাড়ির গল্প করতেন। ওঁর বাবার অনেক খেতিজমি, অনেকগুলো গরুমোষ। বাড়িতেই গাওয়া আর ভঁয়ষা ঘি তৈরি হয়। ওখানে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ থাকলেই নাকি আমার দুবলাপাতলা চেহারা এক্কেবারে পালটে যাবে। আমিও কলকাতার নানা গল্প জুড়ে দিতাম। বিশেষ করে আমার ইস্কুলের গল্প শুনতে আন্টিজি খুব ভালবাসতেন। উনি ‘মিডিল পাশ’- তার মানে তখনও জানতাম না।
গল্প করতে করতে ওঁর হাত কিন্তু থেমে থাকত না। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলতে থাকত। মস্ত একটা গামলায় রাতের রুটির জন্য আটা মাখতেন। সেই মাখা একটা দেখার বস্তু ছিল। আমাদের বাঙাল বাড়িতে লুচি পরোটার চল থাকলেও রুটি খাওয়ার অভ্যাস ছিল কম। দু’বেলাই ভাত। আমি একটা পিঁড়িতে বসে ওঁর আটা মাখা দেখতাম। মস্ত বড় আটার তালটাকে ঠেসে ঠেসে মেখেই যেতেন বহুক্ষণ। তারপর একটু তেল মাখিয়ে আটার তালটিকে জামাই আদরে একটা ভেজা সাদা ন্যাকড়া দিয়ে পরিপাটি করে ঢেকে দিতেন। অবশেষে আটার গামলার ওপর একটা থালা চাপা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে উনি সবজি কাটায় মন দিতেন।

আমাদের বাড়িতে বঁটিতে তরকারি কাটা হত। এখানে এসেও উনুন ইত্যাদির সঙ্গে একটা বঁটি কিনে আনা হয়েছিল বোধহয় মিঠাপুর বাজার থেকে। আমিও সেই বঁটিতে মাকে মাঝে মাঝে আলু কুচিয়ে দিতাম। আন্টিজি কিন্তু ছুরি দিয়ে সবজি কাটতেন। উনি বলতেন চাকু। কী চোস্ত হাত ছিল! গাজর, আলু ইত্যাদির খোসা ছাড়ানো, ফুলকপি বা আদা পেঁয়াজ, সব ঐ চাকুতেই নিপুণভাবে কেটে রাতের রান্না চাপাতেন। ওঁরা ছিলেন নিরামিষের ভক্ত। ছেলেমেয়েরা ডিম খেত বটে, মাছমাংস তেমন আসত না। অড়হর ডাল ওঁর কাছেই প্রথম খেয়েছি। আমাদের বাড়িতে মুগ, মুশুর, ক্বচিৎ ছোলার ডাল হত। ওঁদের বাড়িতে অড়হর ডালেরই বেশি চল। একটা ভাজি করতেন কিংবা একটা আলু ফুলকপির তরকারি- যার নাম ‘আলুগোবি’। আটার তালটা কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষমাণ থাকতো।
ডাল ও সবজি রান্না শেষ করে সেদিকে আন্টিজি মন দিতেন। ন্যাকড়ার ঘোমটা খুলে তালটাকে আঙুল দিয়ে ঠোনা মারতেন, মনে হত পছন্দ হচ্ছে না। আবার তাকে ঠাসতে শুরু করতেন। তারপর চাকি বেলুন পেড়ে রুটি বেলা শুরু হত। বেশ বড়ো চাকি বেলুন। নিখুঁত গোল হয়ে রুটি চাকির ওপর হাতের চাপে ঘুরতে থাকত। গন্গনে উনুনে চাটু চাপিয়ে একটি একটি করে সেঁকতেন। তারের জালে সরাসরি আঁচে দিয়ে ফুলিয়ে নিতেন না। তাঁর মুলুক থেকে আনা ঘি একটা বৈয়াম থেকে নিয়ে রুটির ওপর ছড়িয়ে দিতেন। গরম চাটুর ওপর ঘিয়ের আদর পেয়ে রুটি বাবাজি গোল বলের মতো ফুলে উঠত, ঠিক রুশদেশের উপকথায় যেমন গোল রুটির কথা পড়েছিলাম! সেই যে রুটি গড়িয়ে গড়িয়ে চলল- পথে খরগোশ, নেকড়ে, ভালুকের হাত এড়িয়ে অবশেষে শেয়ালের চালাকির কাছে জব্দ হয়ে গেল।

রুটি গড়া দেখতে দেখতে ওই গল্পটা আন্টিজির কাছে বিস্তর মশলা দিয়ে পরিবেশন করেছিলাম। খুব মজা পেতেন উনি, বারবার ওই গল্পটা শুনতে চাইতেন। আমি লক্ষ করতাম আটার তালটা যেন সিল্কের মতো নরম হয়ে গেছে। রুটিগুলো রাখার জন্য একটা স্টিলের মস্তবড়ো ডাব্বা ছিল। আমি বলতাম ‘রুটির মকান’। একটা বাঁধাধরা নিয়ম ছিল, রান্নার পাট চুকলে একটা স্টিলের প্লেটে একটা রুটি আর খানিকটা সবজি বা ডাল আমার বরাদ্দ। কাঁচের শিশি থেকে আম, লেবু বা লঙ্কার আচার বেরত। সাঁঝের খাওয়াটা দিব্বি জমত আমার। শুধু কাঁচা মূলোর স্যালাডটা এড়িয়ে যেতাম। এখনো মনে পড়ে সেই তুলতুলে মাখনের মতো নরম পুরু রুটির স্বাদ, দেশি ঘিয়ের অপূর্ব গন্ধ।
মা মাঝেমাঝে খুব লজ্জা পেতেন। আমাকে বকুনি দিতেন, ‘তোকে তো ওঁরা লোভী মনে করবেন!’ বাড়িতে আমাকে খাওয়াতে সাধ্যসাধনা করতে হত। আন্টিজির কাছে একেবারে লক্ষ্মীমেয়ে। মার বকুনি খেয়ে দু’একদিন গরহাজির হলেই, আন্টিজি এসে ডেকে নিয়ে যেতেন। কারণ ‘বিটিয়া’ কাছে না বসলে নাকি তাঁর ‘রসুই’-তে মন লাগছে না, ভাবির লজ্জা পাবার কিছু নেই এতে।
আজ ভাবি, কী ছিল সেই রসুইঘরের সন্ধ্যেবেলাগুলোতে? কেন আমার এত ভাল লাগত আন্টিজির রুটি গড়া দেখতে? রান্না যে যেমনতেমন কাজ নয়, একটা শিল্পকর্ম- সেই বোধ তখন বাড়িতেও আস্তে আস্তে হচ্ছিল। কিন্তু আন্টিজির রান্না ছিল এক সম্পূর্ণ অভিনব অভিজ্ঞতা। ভারতের ভিন্নভিন্ন রাজ্যের বিচিত্র খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সেটাই যে আমার প্রথম পরিচয়!

তারপর থেকে রাস্তার ধারের ধাবা হোক বা ঝুপড়ি, কিংবা হোক ফুটপাথবাসীদের ইটের উনুন- রুটি গড়া দেখলেই আন্টিজির কথা মনে পড়ে যায়। তিনি যেন আলাদা হেঁসেলের স্বাদগন্ধ এনে প্রথম আমাকে বাঙালির পাশাপাশি ভারতীয় করে দিয়েছিলেন। এইসব বড়বড় কথা শুনলে নিশ্চয়ই তিনি হেসে ফেলতেন। আর মস্ত পাথরের নথপরা তাঁর হাসিমুখটি খুব সুন্দর লাগত দেখতে।
করোনার আক্রমণের পর যখন লকডাউনে ভিন্ রাজ্যের শ্রমিকরা আটকে পড়লেন, খবরের কাগজে পড়লাম কেরলের লোকেরা রুটি বানানো শিখে নিয়ে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের অস্থায়ী বাসস্থানে সেই রুটি পৌঁছে দিতেন… আন্টিজির কথা মনে পড়ল আবার। এ কথা শুনলে মাথা নেড়ে নথে ঝিলিক লাগিয়ে তিনি নিশ্চয়ই বলতেন, ‘বিটিয়া, বহোৎ খুব’।
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Livemint, adiyprojects
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।