পেশোয়ার থেকে সোজা পুণেতে এসে স্যান্ডুইচের ব্যবসা শুরু করলেও তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল এক নতুন জগৎ। তখন কি কেউ জানত যে উপমহাদেশের একজন সুপারস্টার হিসেবে তিনি সকলের মন জয় করে নেবেন? মুম্বই চলচ্চিত্র জগতের ট্র্যাজেডি-কিং হয়ে উঠবেন? বম্বেতে তখন তিনি একের পর এক ছবিতে অভিনয় করছেন নার্গিস, মধুবালা, বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা রহমান প্রমুখের সঙ্গে। প্রতিটি ছবি হিট। এসবের মধ্যেই একসময় ইউসুফ খান অভিনয় করতে এলেন বাংলায়। পরিচালক তপন সিংহের হাত ধরে। গৌরকিশোর ঘোষের উপন্যাস ‘সাগিনা মাহাতো’ নিয়ে তপনবাবু যখন ছবি তৈরি করলেন, সেই সময় তিনি ইউসুফ ওরফে দিলীপকুমার এবং সায়রাবানুকে নির্বাচন করলেন ছবির দু’টি প্রধান চরিত্রে।
কারখানার ইউনিয়ন লিডার সাগিনার মুখে ‘ছোটি সি পঞ্ছি’ শুনে চমৎকৃত দর্শকেরা। শুটিংয়ের সময় আউটডোর লোকেশন বা স্টুডিওর ফ্লোরে পরিচালকের নির্দেশ মেনে শট দেবার পরে আবার অনুরোধ করতেন ওই একই শট আরও দু-তিন রকমভাবে দেবেন। মনে করতেন এডিটিংয়ের সময় পরিচালক যাতে তাঁর পছন্দমতো শটটা ছবিতে ব্যবহার করতে পারেন। অবশ্য বাংলার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ প্রায় তাঁর চলচ্চিত্রজীবনের প্রথম থেকে। বাংলার চলচ্চিত্র পরিচালকদের প্রতি তাঁর ছিল অসীম শ্রদ্ধা। তপনবাবুকে বলতেন, ‘বাংলার পরিচালকেরা এত ভাল ছবি আর চিত্রনাট্য তৈরি করেন কীভাবে?’

ইউসুফ খান বরাবরই উর্দু ভাষায় ছিলেন দক্ষ। ১৯৪৪ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কন্যা দেবিকারানির হাত ধরে হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে তাঁর প্রথম ছবি ‘জোয়ারভাটা’। পরিচালক অমিয় চক্রবর্তী বম্বে টকিজের ব্যানারে ছবিটা তৈরি করেছিলেন। এর কিছু পরে নীতিন বোসের ছবি রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ অবলম্বনে ‘মিলন’-এ অভিনয় করলেন দিলীপকুমার। মূলত হিন্দি ছবির দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর কাজের সম্পর্ক থাকলেও বাংলার প্রতি তাঁর আন্তরিক টান ছিল। দিলীপকুমার ছিলেন এমন এক অভিনেতা যিনি কখনও এক সঙ্গে দুটো ছবির কাজ করতেন না। অভিনয়ের পরে তাঁর সব থেকে বেশি আগ্রহ ছিল ক্রীড়াজগতের প্রতি। খেলতে পারতেন ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, দাবা, ফুটবল। এক সময় রোর্ভাস কাপ টুর্নামেন্টেও খেলেছেন। জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে এক মঞ্চে বক্তৃতাও দিয়েছেন। পণ্ডিত নেহেরু তাঁকে অসম্ভব স্নেহ করতেন।
দিলীপকুমারকে অতীতে মুম্বইতে বলা হত নেহেরুভিয়ান হিরো। মেঘনাদ দেশাইয়ের লেখা ‘নেহেরুস হিরো দিলীপকুমার’ বইটিতে পাঠকেরা এই প্রসঙ্গে আরও তথ্য পেতে পারেন। তপনবাবুর ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবির হিন্দি সংস্করণ ‘সাগিনা’তেও অভিনয় করেন দিলীপকুমার। ব্যক্তিগত জীবনে তপন সিংহের সঙ্গে ছিল তাঁর ভীষণ ভাল বন্ধুত্ব। কলকাতায় কোনও কাজে এসে প্রতিবারই তিনি তপনবাবুর বাড়ি গিয়ে অথবা স্টুডিওতে গিয়ে দেখা করতেন। তাঁর কিছুটা আভাস পেয়েছিলাম যখন ছায়াবাণী প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার আমার কাছে প্রস্তাব রাখেন তপন সিংহকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করার জন্য। সেই সময় তপনদার খুব ইচ্ছে ছিল সেই ডকুমেন্টারিতে দিলীপকুমারের বক্তব্য যুক্ত করতে।

তপনবাবু তখন খুবই অসুস্থ। কিন্তু তার মধ্যেও ল্যান্ডলাইনের বিভিন্ন নম্বর সম্বলিত ডায়রি থেকে দিলীপকুমারের মুম্বইয়ের বাড়ির নম্বর খুঁজে বের করে ফোন করে আমার পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্যটা বলে আমার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দেন। ইন্ট্রোভার্ট আমি তো অপ্রস্তুত। উপমহাদেশের সর্বকালের জনপ্রিয় নায়ক তখন ফোনের ওপারে। কী বলব? কীভাবে বলব? কিছুই বুঝতে পারছি না। সামনে আবার তপন সিংহের মতো চলচ্চিত্রনির্মাতা বসে রয়েছেন। দিলীপকুমার স্বয়ং কাজটা সহজ করে দিলেন। খুব সহজভাবে বললেন, মুম্বই গেলে তিনি অবশ্যই তপনদার বিষয়ে সাক্ষাৎকার দেবেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে তথ্যচিত্রের কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। কী কারনে হঠাৎ সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল, তা আমার কাছে আজও অজ্ঞাত। যাই হোক, সেই সূত্রে মাঝে-মধ্যেই তপনদার কাছে তাঁর অন্যতম প্রিয় বন্ধু দিলীপকুমার সম্পর্কে অনেক কথা শুনতাম।
একবার তপনদা দিলীপকুমারের মুম্বইয়ের বাড়ি গিয়ে দেখেন, তিনি ডেন্টাল সার্জারি সংক্রান্ত একটা মোটা বই নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছেন। তপনদাকে দেখে হেসে বলেছিলেন কদিন পরে ডেন্টিস্টদের একটা সভায় তাঁকে যেতে হবে, তাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমনই ছিল তাঁর নিষ্ঠা। ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ভাল ক্রিকেট এবং ব্যাডমিন্টনও খেলতেন। ‘সাগিনা মাহাতো’ ছবির সেটে মাঝে মাঝে তিনি তাঁর বন্ধু পরিচালকের সঙ্গে ব্যাডমিন্টনও খেলতেন। শুটিং শেষ হয়ে গেলে তিনি তপনবাবুর ইউনিটের সহ-পরিচালক এবং কথা-সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘তুমি তপনকে বল আমাকে নিয়ে আরও একটা ছবি তৈরি করতে।’ সাগিনা মাহাতো ছাড়াও দিলীপকুমার আরও একটা বাংলা ছবিতে ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে অভিনয় করেন, তার নাম ‘পাড়ি’। ছবির পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়। সেই সময় একটা স্মরণীয় ঘটনা ঘটে।

‘পাড়ি’র কাজ চলছিল ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। তার মাসকয়েক আগে তপন সিংহ তাঁর ‘অতিথি’ ছবির কাজ শেষ করেছেন । ‘পাড়ি’-র শুটিং চলাকালীন বিশিষ্ট কয়েকজনের জন্য তপনবাবু অন্য একটি স্টুডিওতে ‘অতিথি’-র এক বিশেষ ‘শো’ দেখাবার ব্যবস্থা করেন। তাঁর বন্ধু ইউসুফভাই কলকাতায় এসেছেন শুনে তপনদা পলাশবাবুকে বলেন, ‘অতিথি’-র সেই বিশেষ ‘শো’-তে দিলীপকুমারকে আমন্ত্রণ জানাতে। বিশেষ শো শুরু হওয়ার একটু আগেই ইউসুফ এসে পৌঁছন। প্রিভিউরুমের বাইরে ছিল কড়া প্রহরা, কারণ দিলীপকুমারের মতো স্টার স্টুডিওতে এসেছেন শুনলে জনতা ভিড় করতে পারেন। পুরো ছবিটা দেখার পরে দিলীপকুমার বেশ কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকেন এবং চা খেতে চান। চায়ে চুমুক দিয়ে তিনি তপনদাকে বলেন, ‘আই ক্যান আইডেন্টিফাই মাইসেলফ উইথ দ্য ক্যারেক্টার অব তারাপদ। একবার আমি মেঘের পেছনে ছুটতে ছুটতে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স খুব বেশি হলে দশ বা বারো।’
আগেই বলেছি, যে দিলীপকুমারের সঙ্গে বাংলার মানুষের এক সুন্দর সম্পর্ক ছিল। পরিচালক বিমল রায়ের সঙ্গেও তাঁর ছিল শ্রদ্ধা আর স্নেহের সম্পর্ক। বিমল রায়ের ‘দেবদাস’, ‘মধুমতি’ আর ‘ইহুদি’-তে দিলীপকুমারের অভিনয় ইতিহাস হয়ে রয়েছে। বিমল রায়ের সান্নিধ্যে এসে তিনি, তাঁর অভিনয়কে আরও বেশি সমৃদ্ধ করেন।
১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে ইডেন গার্ডেনে এক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। সেবার খেলা হয়েছিল উত্তমকুমার একাদশ বনাম দিলীপকুমার একাদশের। কাজেই, পাকিস্তানের মহম্মদ ইউসুফ খান একদিকে যেমন ছিলেন মুম্বইয়ের দিলীপকুমার, অন্যদিকে তেমনি ছিলেন বাংলার আপনজন সাগিনা মাহাতো। কিন্তু এত কিছুর পরেও মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলার প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি আর কোনও বাংলা ছবি করলেন না!
*ছবি সৌজন্য: Freepressjournal, IMDB, Wikipedia
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
One Response
শ্রদ্ধেয় দিলীপ কুমার সম্মন্ধে কিছু বলার ধৃষ্টতা নেই। একটা কথা মনে জাগে , ওনাকে সঠিক ভাবে ব্যাবহার করা হয়েছে কি? বিমল রায় বা তপন সিংহ বাদে আরো বহু উচ্চ মানের পরিচালক সেই সময়ে ছিলেন। সৃষ্টি হলো কি একটা Lawrence of Arabia বা মন্থন বা আক্রোশ বা পাড় জাতীয় কোনো চলচ্চিত্র.. যেখানে উনি স্মরনীয় হয়ে থাকতে পারতেন তাঁর অভিনয় শৈলীর দ্বারা? বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র কাররা তখন ভারতে উজ্জ্বল … চেষ্টা হয়েছিল কি? নানান কারন বা অজুহাত থাকতে পারে , আমরা কিন্তু বঞ্চিত থাকলাম।