গত শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ধ্যে থেকে ল্যাম্পপোস্টের নীচে ওমলেট গরম গরম ভেজে দেবার জন্য ডিমওলারা সরঞ্জাম গুছিয়ে বসত। বেশি কিছু দরকার হত না, একটা ছোট তোলা উনুন, একটা হাতপাখা, আঁচ তুলবার জন্য, অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রাইপ্যান ও খুন্তি, কুচোনো পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা ভর্তি বাটি, এক বোতল সর্ষের তেল আর অবশ্যই তারের জালের ঝুড়িতে একঝুড়ি ডিম। আমি আর আমার পিসতুতো বোন ঝুমা বিকেলে ওদের বিডন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি হাঁটতে যেতাম। কৈশোরে দারুণ আকর্ষণের বস্তু ছিল ওই ডিমভাজা– শুধু খাওয়া নয়, তৈরি করার মধ্যে একটা শিল্পীসুলভ নৈপুণ্য ছিল, যেটা মন কাড়ত।

তখনও অনেকের বাড়িতে কোনও বিচিত্র অলিখিত ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞায় মুরগির ডিম ঢুকত না। আর কে না জানে, নিষিদ্ধ বস্তুতেই টান বেশি থাকে! ডিমওলাকে ঘিরে বেশ একটা জমায়েত হয়ে যেত। সে অবশ্য শিল্পীসুলভ অবজ্ঞায় দর্শকদের তেমন পাত্তা দিত না। তার মনযোগ থাকত সম্ভাব্য খদ্দেরদের দিকে। কেউ ডিমভাজা চাইলে সে একটা লম্বা অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসের কানায় ঠুকে ডিমটা ভেঙে গেলাসে ঢেলে নিত। তারপর তাতে পেঁয়াজকুচি, কাঁচালঙ্কাকুচি পরিমাণমতো দিয়ে নুন মেশাত, হয়তো গোলমরিচ গুঁড়ো দিত। তারপর একটা চামচে দিয়ে ঘট্ ঘট্ করে ডিমটা ঘুঁটতে থাকত একমনে।
উনুনে ফ্রাইংপ্যান বসিয়ে তাতে সর্ষের তেল ঢালত মাপমতো। তারপর ডিমটা ঢেলে দিত সসপ্যানে। অনেকক্ষণ ঘুঁটবার ফলে বেশ বড়ো গোল হয়ে ফুলে উঠত ডিমটা। খুন্তি দিয়ে একবার উল্টে, পরেরবার হাতের কায়দায় সসপ্যানটা তুলে নাচাত এমনভাবে, যে ডিমভাজাটা শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে ঠিক থপ্ করে পড়ত স্যসপ্যানের মধ্যে।
এবার কী একরকমের মশলা ছিটিয়ে শালপাতায় মুড়ে তুলে দিত খদ্দেরের হাতে। ধারবাকির ব্যাপার নেই, সব নগদ কারবার। পার্ক থেকে ছেলেরা ফুটবল খেলে ফিরত তখন– ঝপাঝপ বিক্রি হত। কেউ ওমলেট বলত বলে মনে পড়ে না। সবাই বলত ‘মামলেট’। শব্দটা ইংরেজি ডিকশনারিতে পাওয়া যাবে না। পরে বুঝেছি, মাখন বা ওই জাতীয় কিছু সুন্দর বাসনে ঢালিয়া টোমাটো, পেঁয়াজ, পার্সলে (অভাবে ধনেপাতা), চিজ়, সেদ্ধ চিকেনের টুকরো, মাশরুম বা ক্যাপসিকাম-সহ বহু কিছু সহযোগে হুইস্ক বা কাঁটা দিয়া ফেটানো ডিম ভাজিলে তাহার নাম ওমলেট। আর গনগনে আঁচে অ্যালুমিনিয়ামের ফ্রাইপ্যান বা সসপ্যান বসাইয়া প্রচুর কাঁচালঙ্কা ও পেঁয়াজকুচি সহযোগে ফেটানো ডিমকে বিশুদ্ধ সরিষার তৈলে ভাজিলে তাহার নাম মামলেট (অন্য কোনও তৈল কদাপি নয়)।
যাইহোক, ঝুমা আর আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওই মামলেট ভাজা দেখে বাড়ি ফিরতাম। বাড়ি থেকে হাতে পয়সা দেওয়ার ব্যাপারে মারাত্মক কড়াকড়ি ছিল দু’জনেরই। তবে একবার দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন ঠাকুর দেখতে যাবার সময় কয়েক আনা মিলেছিল– স্বাদ নিয়েছিলাম সেই দেবভোগ্য মামলেটের। একটাই কিনে দু’জনে ভাগ করে খেয়েছিলাম। আজকাল দেখি শুধু ডিমভাজার বদলে বেশ গুছিয়ে চা, পাঁউরুটি নিয়ে ডিমের সঙ্গে পরিবেশন করা হচ্ছে ফুটপাথে। খুবই জনপ্রিয় ‘ডিমটোস্ট’ নামে উত্ত খাদ্যবস্তু।

ওই দোকানিদের উদ্ভাবনীশক্তি অসামান্য। মনে আছে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাসংসদে সভাপতি থাকার সময় মাঝে মাঝেই হাইকোর্টে ডাক পড়ত। একবার হাইকোর্টের কাজ সেরে চা-তেষ্টা পেল খুব। সংসদের সহসচিব ছিলেন সঙ্গে, তিনি কোর্ট চত্বরের উল্টোদিকে ফুটপাথের চায়ের দোকানটি দেখিয়ে ইতস্তত করতে লাগলেন। ভাবখানা, ম্যাডাম কি ওই দোকানে যাবেন। বলে কী? ম্যাডাম তো পারলে ডিমটোস্ট খেয়ে জীবন সার্থক করতে চান!
যাইহোক, চা খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম, ডিমের দুটি বিশাল স্তূপ রয়েছে– একটি শাদা ডিমের, অন্যটি ঈষৎ লালচে রঙের ডিমের। সহসচিব বললেন, ‘ঐ লাল ডিমগুলো জানেন তো বেশি পুষ্টিকর। আমি বেশি দাম দিয়ে ওগুলো কিনি কল্যাণীর বাজারে।’ তাইতো বটে, এমন একটা কথা যেন শুনেছিলাম আগে। ডিমওলাকে শুধোলাম, ‘লাল ডিমগুলো বেশি দাম তাই না?’ সে খুব ব্যস্তভাবে এক খদ্দেরের জন্য ডবল ডিমের মামলেট ভাজতে ভাজতে জবাব দিল ‘একই দাম। ওগুলো সেদ্ধ ডিম।’ রহস্যটা আরো গভীর দেখছি! দাম একই, অথচ শুনেছি বেশি পুষ্টিকর। আমার কৌতূহল মেটাল দোকানি অচিরেই। ‘ওগুলো লাল কেন তবে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে অত্যন্ত নির্লিপ্তভাবে কাঠের পাটার ওপর পেঁয়াজ রেখে দক্ষ হাতে কুচোতে কুচোতে বলল, ‘সেদ্ধ করার সময় জলে চা পাতা ফেলে দিই– কাঁচা ডিমের থেকে আলাদা করবার জন্যি, নাহলে গুইলে যায়।’ সহসচিব বজ্রাহত – শুধু অস্ফুটে একবার বললেন, ‘আমার ডিমওলা কি চা-পাতা দিয়ে রঙ করে দেয় তবে?’

তবে এ লেখা শুধু ডিমওলাদের নিয়ে নয়, একটি মেয়েও আছে। তাকে দেখেছিলাম ডিমওলার সঙ্গে ভারী হেসে হেসে গল্প করতে। তখন আমার বয়স সাত-আট হবে। বাবার সঙ্গে বিডন স্ট্রিটে পিসিমণির বাড়ি গিয়েছিলাম। এসেই বাবা বসে গিয়েছিল ওই বাড়ির বিখ্যাত তাসের আড্ডায়, ফলে অবধারিত দেরি। পিসিমণি রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে সদ্য ফোড়ন দেওয়া পাতলা সুগন্ধি মুসুরির ডাল, ভাত আর মাছভাজা গরাস করে করে খাইয়ে দিয়েছে আমাকে। ফলে বাসে উঠে যে ঢুলব– এটা একরকম নিশ্চিত।
সময়টা ছিল হেমন্তকাল, পুজোর কিছুদিন পর। বাবার সঙ্গে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি, কাছেই ল্যাম্পপোস্টের নীচে ডিমওলা স্যসপ্যানে ডিম ভাজছে, টুকটাক বিক্রি হচ্ছে। হালকা কুয়াশা ভেদ করে এল মেয়েটি। আমার চোখে পড়েছিল তার খুব ঝলমলে শাড়ি আর হাতভর্তি চুড়ি। এত সাজগোজ করতে দেখতাম না বাড়ি বা পাড়ার কাউকে, তাই হাঁ করে দেখছিলাম। স্মৃতির পটে আঁকা হয়ে আছে সেই রোগা কালো মেয়েটি– চড়া লাল তার লিপস্টিক, কানে মস্ত ঝোলা দুল। ডিমওলার বন্ধু মনে হয়েছিল তাকে। বেশ গল্প করছিল, একটা মামলেট খেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, দ্যাখো তো কী মজা! এত রাতে বেরিয়ে এসে ডিমভাজা খাচ্ছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই বকুনি খাবার ভয় নেই। আমাদের বাস এদিকে খুব দেরি করছিল। বাবা তাঁর প্রিয় ক্যাপস্টান সিগারেটের টিন বার করে একটা ধরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমার সঙ্গে গল্প টল্প করার নাম নেই। অগত্যা মেয়েটিকেই মন দিয়ে দেখছিলাম।
হঠাৎ কোথা থেকে লোকটা এল কে জানে! আবছা মনে পড়ে, এসেই সে মেয়েটির হাত ধরে টানল। নেহাৎ শিশু তখন আমি– তবু কীভাবে বুঝে গেলাম লোকটা মেয়েটার চেনা নয়। খুব কাছেই ছিল ল্যাম্পপোস্টটা। ফলে ওদের চাপা গলার কথাবার্তা মোটামুটি শোনা যাচ্ছিল।
– কোথায়?
– এই তো কাছেই।
কিছু বুঝতে পারিনি এসব কথার মানে। লোকটা কি মেয়েটার বাড়ি যেতে চাইছে? সবচেয়ে অবাক হচ্ছিলাম ডিমওলাকে দেখে। সে যেন ওদের দেখতেই পাচ্ছে না। অথচ ডিমওলা তো মেয়েটার বন্ধু। মেয়েটা ঘাড় নাড়ছে, যেন রাজি নয়। লোকটা ওর লম্বা চুলের বেণী ধরে টান দিল। বেণীটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম কারণ কয়েকদিন আগেই আমার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল মা ছেঁটে ঘাড় পর্যন্ত করে দিয়েছে, আমার ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও। আর দুদিকে দুই বেণী বাঁধা যাচ্ছিল না আমার ছোটো চুলে। তাই মেয়েটার লম্বা ফুল টুল জড়ানো বেণীটা দেখে ভাবছিলাম কবে যে আমার চুল অমন লম্বা হবে। লোকটা মেয়েটার বেণী ধরে টান দিল দেখে আমার একটু রাগ হল। ওমা! মেয়েটা দেখি হি হি করে হেসে লোকটার গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। তারপর লোকটার হাত জড়িয়ে ধরে দু’জন রাস্তা পার হয়ে কুয়াশায় মিলিয়ে গেল। ডিমওলা নির্বিকারভাবে উনুনে আঁচ ঠেলছে তখন।

আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম লোকটা মেয়েটার আগে থেকে চেনা নয়। তবে? কোথায় গেল ওরা? এত তাড়াতাড়ি ভাব হয়ে গেল? বাবাকে জিজ্ঞেস করতে বাধা ছিল না। শৈশবে যত সমস্যা, প্রশ্ন সব বাবার কাছে নিয়ে যাওয়াই অভ্যেস ছিল। কিন্তু বাবা দেখি একেবারে উল্টোদিকে মুখ করে সিগারেট টানছেন। আমাদের বাসও এসে গেল কিছুক্ষণ পরেই।
সেদিনের বাচ্চা মেয়েটি ফুটপাথে ল্যাম্পপোস্টের নীচে তিনটি চরিত্রের ঐ ছোট্ট নাটকটা কিছু বুঝতে না পারলেও, বড়ো হয়ে বুঝতে দেরি হয়নি। ক্রমে জেনেছিলাম যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম তার খুব কাছেই রয়েছে কলকাতার সবথেকে বড়ো লালবাতি অঞ্চল। আমাদের ডিমওলাটিরও রাতের খদ্দের তারাই। এটাও বুঝেছিলাম আমার বাবা মেয়েটিকে দেখে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকসুলভ প্রবল অস্বস্তিতে পড়েছিল বলেই অমন মুখ ঘুরিয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। বিশেষ করে আমি সঙ্গে ছিলাম– প্রশ্ন করে করে বাবাকে জেরবার করে দেবার বদভ্যাস যার পুরোদস্তুর। সব বোঝার পর বড় কষ্ট হয়েছিল সেই ঝলমলে শাড়ি পরা, বেণীতে মালা জড়ানো, হাতভর্তি রোল্ডগোল্ডের নকল চুড়ির ঝিনিঝিনি আওয়াজ তোলা রোগা কালো মেয়েটির জন্য। যতই রাত করুক, অসময়ে ডিমভাজা খাক, অচেনা লোকের সঙ্গে মিশুক– ওকে বকুনি দেবার মতো তো ওর বাড়িতে কেউ নেই!
*ছবি সৌজন্য: Behance, cookpad, thespruceeats
চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
One Response
এ এক অন্য জগতে নিয়ে গেছে আপনার প্রতিবেদন ।আজো এই রাস্তা খাদ্য আমাদের টানে, আকর্ষণ করে , উদ্বেল করে । ধন্যবাদ।