Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

যে বৃষ্টিতে ভেজা হয় না আর

Rain
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বছর দশেক আগেও যে ব্যালকনি থেকে এক আকাশ বৃষ্টি দেখা যেত, সে এখন চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের রংচটা রান্নাঘরটা দেখায়। যে জানলাটা দিয়ে বৃষ্টির গন্ধ ঢুকে যেত সারা শরীরে, সে জানলা আজ প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও পেঁয়াজ রসুনের উগ্র গন্ধ ইঞ্জেকশানের মতো রক্তে ঢুকিয়ে দেয়, জোর করে। আমাদের মুখোমুখি যে ফ্ল্যাট, সেখানে বৃষ্টি হলেই ভুনা খিচুড়ি মাস্ট।

বৃষ্টির একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। যখন আকাশ কালো হয়ে আসে, মোবাইলের রিংটোন আর টিভি সিরিয়ালের আওয়াজ ছাপিয়ে যায় ‘মত্ত দাদুরী’র শির ফোলানো মন্দ্রসপ্তকে গলাসাধা, ঠিক তখনই ওই গন্ধটা পাই। পাই বললাম কেন, পেতুম। তিনতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকতুম, যে দিকে দু’চোখ যায়। তখন অনেক দূর পর্যন্ত চোখ যেত, যেতে পারত।
আমার স্কুল জীবনেও আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের মাটিটা স্কোয়্যার ফিটের মাপে ভাগ হয়নি। বিরাট ঝিলে বেনেবুড়ি ডুব দিত। আর আমি পূণ্য করতাম।
বৃষ্টি নামত।
কখনও অনেক দূর থেকে সেই সাদা আসত আমার দিকে। বৃষ্টির সাদা। বহুদূরের হাওড়া ব্রিজ ঝাপসা। সেই সাদাটা দু’হাত বাড়িয়ে ক্রমশ এগোত। আমার চার দিক জলের ফোঁটারা জাপটে ধরত যখন, সেই গন্ধটা কেমন প্রবল হয়ে উঠত। মনে হত, যেন একটা ডিওডোরেন্ট স্প্রে করতে করতে এগিয়ে চলেছে একটা সাদা পর্দা। পুকুরে ঢেউ। ব্যাঙেদের কনসার্ট আলাপ থেকে ঝালায় যেত ক্রমশ। একটা প্রাচীন গন্ধতে ছেয়ে যেত আমার চারপাশ।
তার তুলনা আমি পাইনি কখনও।
সোঁদা গন্ধ বললে তার সিকিভাগও বোঝা যায় না।

Rain
সোঁদা বললে বৃষ্টির আসল গন্ধের সিকিভাগও বোঝায় না আসলে। ছবি সৌজন্য – globalfashionstreet.com

বড় হয়ে, ফোনে নেট প্যাক পেয়ে গুগলকে জিজ্ঞেস করেছি, স্মেল অফ দ্য রেইন কী?
এত বছরের জমিয়ে রাখা আমার অবাক বিস্ময়কে ফুঁ মেরে গুগল বলেছে, এটা রাসায়নিকের জাদু ছাড়া আর কিছু নয়। পর্দায় ঝরেছে কিছু রাসায়নিক ফর্মুলা। বায়োকেমিস্ট্রি দিয়ে, উইকিপিডিয়া দিয়ে, হাইপারলিঙ্কের সঙ্গতে রহস্যের জট খোলার চেষ্টা করে আন্তর্জাল।
গুগল বলে, এর নাম নাকি পেট্রিকোর। এটা নাকি আসলে মাটি ভেজা গন্ধ। এর মূলে আছে অ্যাক্টিনোব্যাক্টেরিয়া। স্ট্রেপটোমাইসিস নামেও এক জীবাণুর নাম পেলাম। জিওসমিন নামে এক রাসায়নিকের কথাও জানতে পারলাম, যা নাকি এই গন্ধের মূল কারণ।
বেঞ্জিন রিংয়ের মতো নানা ছবি এঁকে গুগল বলল, ইউটিউব বলল, এই সোজা ব্যাপারটা বুঝে নাও জলদি। বৃষ্টির গন্ধ আসলে ফর্মুলা ছাড়া আর অন্য কিছু নয়।

[the_ad id=”266918″]

কিন্তু আমি বুঝতে চাইনি। জীবনে কিছু জিনিস বোধহয় দুর্বোধ্য থাকাই ভালো। তাতেই তাকে আরও বেশি করে কাছে পাওয়া হয়। সব পেলে, সব বুঝে ফেললে, নষ্ট জীবন।

বৃষ্টিভেজা দিন যেন আমাদের স্কুলজীবনে হঠাৎ ডেকে আনা কোনও লকডাউনের মতো ছিল। আমার ছোট্ট পরিধির জীবনটা, রুটিনটা যেন থেমে যেত কয়েক ঘণ্টার জন্য। ভূগোলস্যার বলেছিলেন, পড়া ধরবেন সে দিন। আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন, না পারলেই গার্জিয়ান কল। সেদিনই হয়তো ছিল অঙ্ক পরীক্ষার ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট বেরনোর দিন। হঠাৎ বৃষ্টি কত দুঃখকে, কত ভয়কে বিলম্বিত করে দিয়েছিল আরও। স্কুলের সামনে জল জমত। কাছে থাকতাম যারা, অকুতোভয়ে গোড়ালি জলে ছপ ছপ। মনে হত, বেলা এগারোটার প্রার্থনার ঘণ্টা জিতেনদা দিয়ে আসছেন সেই শের শাহের আমল থেকে। যেন তাঁর বেঁচে থাকা শুধু এই ঢং ঢং ধ্বনির জন্যই। কোনওদিন এক মিনিটের এদিক ওদিক হত না।
তিনশো জনের প্রেয়ারের লাইনে সেদিন মেরেকেটে তিরিশ। ভেজা হেডমাস্টারমশাই। তারপরেই শোনা যেত মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কোনও দৈববাণী— অত্যন্ত কম উপস্থিতির জন্য আজ রেইনি ডে ঘোষণা করা হল!
সামনের মাঠ থেকে বৃষ্টির গন্ধটা হঠাৎ জোরদার হয়ে যেত আরও। স্কুলের বারান্দায় ঝাপটে চলে আসা জলের সঙ্গে মাখামাখি খুশি। প্রেয়ারের লাইনে দাঁড়ানো সেই তিরিশজনের সমবেত আনন্দধ্বনি ঢাকা পড়ে যেত বাজ পড়ার আওয়াজে। ভাগ্যিস তখন স্মার্টফোন ছিল না। সাত ইঞ্চির স্ক্রিনে সেই আনন্দ রেকর্ড করা যেত না কখনও।
স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কাদামাখা ছলাৎছলের মধ্যে যেন আরও বেশি করে মিশে যেত ঘুঙুরের আওয়াজ। কাদামাখা ঘুঙুর। ভেজা কাঁধ, ভেজা ব্যাগ বুঝত, জীবনে দুম করে যোগ হয়ে গেল একটা বেহিসেবি দিন। যে হিসাবহীনতার মধ্যে কোনও দুঃখ মিশে নেই। হোমটাস্কের খাতাগুলোয় কে যেন স্মাইলি এঁকে দিত। আমি জানতামই না।

Rain
হোমটাস্কের খাতায় তখন জলেভেজা স্মাইলি। ছবি সৌজন্য – slate.com

হেডমাস্টারমশাই বলতেন, স্কুল থেকে সোজা বাড়ি যাবে সক্কলে। বাড়ির সংজ্ঞাটা আমাদের মনের মধ্যে বদলে যেত ওঁর দৈববাণী শোনার সময়েই। এমন বৃষ্টিভেজা দিনে স্কুলের পাশের গলিতে মহাদেবদার দোকানে লুচিগুলো রত্নগর্ভা হয়ে উঠত। এটাও হয়তো কোনও কেমিস্ট্রি। গুগল বলবে বুঝে নাও। এই দ্যাখো, যত্ন করে সাজিয়ে দিয়েছি আঠাশটা লিঙ্ক। আলুর দমটা টাকরায় গিয়ে এমন ঝঙ্কার তুলত কোন জাদুতে সেই বৃষ্টিভেজা দিনে, গুগল তুমি জানো?
আমার সেই ভিজে স্কুলের পাশের দেওয়াল আজ আঁচড়ায় সিসিটিভি ক্যামেরা। তখন ছিল না ভাগ্যিস। চকচকে সেই লেন্স জানে না, ওর মধ্যে মাস্টারমশাইয়ের রাঙা চোখের থেকেও বেশি রক্ত পোরা আছে। ‘প্রমাণ’ সেখানে বজ্রবিদ্যুতের থেকেও বেশি ঝলকায়। এমন বৃষ্টিদিনে মনে কোনও সন্দেহ হলেই আজকের দিনের টেক স্যাভি মা-বাবারা বলে ওঠেন, লাইভ লোকেশন পাঠিয়ে দে, এক্ষুণি। চুলের মুঠি ধরে প্রযুক্তি তখনও টানেনি আমাদের। ভাগ্যিস পিছিয়ে ছিলাম!

[the_ad id=”266919″]

কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরতাম।
কাকভেজা কথাটার কি কোনও সুপারলেটিভ আছে বাংলায়? জানি না।
তবে আমি জানি, রেনি ডে-তে স্কুল ফেরত আমায় দেখলেই কাকটা বলে উঠত, ‘আমি আর কি ভিজলাম জীবনে?’
ব্যাগের মধ্যে যে অলস ছাতাটা ছিল, তাকে তেমন কাজই করতে হল না কোনওদিন।
বেলা তখন সাড়ে এগারোটা কিংবা বারোটা। তিনতলায় আমাদের শূন্য ফ্ল্যাট। মা-বাবা যে যার কর্মক্ষেত্রে। ব্যালকনিটা ডেকে উঠত, আয় আয়, চই চই। বৃষ্টি বলত, চারটে সাড়ে চারটের আগে তো আসবে না কেউ। চল্ খেলি। খোলা দরজা দিয়ে জলের বিন্দু নাগাড়ে ঢুকছে ঘরে। মায়ের যত্ন করে পেতে রাখা বেডকভার, বেডশিট ভিজছে। ভিজুক। দুনিয়া ভিজে যাক, শুধু আমার ক্যাসেটগুলো ছাড়া। ড্রয়িংরুমের এক কোণে রাখা আলমারিটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। ওখানে আমার দু’তাক ভর্তি ক্যাসেট। যার মূল্য আমার না খাওয়া টিফিন খরচ জানে। ষাট ওয়াটের টেবল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে মেলে ধরতাম ক্যাসেটগুলোর সামনে। আলো খাওয়াতাম। গরম আলো।
ময়েশ্চার, ও ময়েশ্চার, তুই আমায় ভেজা। এখানে আসিস না প্লিজ। ফিতেগুলো আটকে গেলে আমার সময়টাও তো আটকে যাবে। কয়েকশো ক্যাসেটের কয়েক হাজার মাইল লম্বা খয়েরি রংয়ের সেই নিষ্পাপ ফিতে জানত না, আর কয়েক বছর পর ওদের দিকে ঘুরেও তাকাব না কোনও দিন। ইউটিউবের রামধনু রংয়ে ওরাও হারিয়ে গেল কোথায়।

Rain
ভিজে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে গায়ে মেখে নিতে ইচ্ছে করে বৃষ্টিগন্ধ। ছবি সৌজন্য – artflute.com

এমন বৃষ্টির দিনে ভূতের গল্পের বইগুলো কেন টানত জানি না। রহস্যরোমাঞ্চ গোগ্রাসে গিলতাম যে আমি, কালো দিনে, হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা দৌলতের মতো বৃষ্টি দিনে, রেনি দিনে, আমায় ভূত টানত। ভৌতিক গল্পকথার সঙ্গে বৃষ্টির কি কোনও সম্পর্ক আছে? আজও অলৌকিক বইয়ের প্রচ্ছদ একই রকম ভাবে আলো করে থাকে অন্ধকার। আজ মনে হয়, যে জেদ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভূতের গল্পে মজে থেকেছি বৃষ্টিদিনে, সেই জেদ নিয়ে যদি অমুক প্রকাশনীর সহায়িকা পড়তাম, টিভির বিজ্ঞাপনে হয়তো চেনা মুখ হয়ে যেতাম।

বড় হয়েছি। প্রকৃতির নিয়ম মেনে বৃষ্টি তো হয়। কিন্তু আমাদের স্কুলে আজ আর রেনি ডে হয় কিনা জানি না।
জানতে ইচ্ছে করে না। গার্জিয়ানদের হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপে কোনও বৃষ্টি-সকালেই হয়তো নিয়ে নেওয়া হয় সন্তানকে সেদিন স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত। রেনি ডে-র আর দরকারই বা কী?

[the_ad id=”270084″]

তাও যদি হিসেব ওলট পালট করে নেমে আসে এক আধটা রেনি ডে, কখনও সখনও, আমার তিন দশক পরের প্রজন্ম সেই আনন্দে কী ভাবে নিজেকে মেশায়, জানতে ইচ্ছে করে খুব। আমার কর্পোরেট জীবনে আর রেনি ডে নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোমে, কোনও প্রবল বৃষ্টিদিনের দুপুরবেলায় জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে আকাশটাকে দেখতে ইচ্ছে করে।
কোনও গ্রামের ভিজে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে গায়ে মেখে নিতে ইচ্ছে করে বৃষ্টিগন্ধ। সেই ছোট্টবেলার ভূতের বইগুলো তাক থেকে টেনে নিয়ে নিতে শখ হয় আবার। সর্বস্ব দিয়ে আমার আবার ছোট হতে ইচ্ছে করে।
এমন সময় ফোন বাজে।
অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের মতো।
মড়াকান্নার মতো।
ওটার আওয়াজ বাজের আওয়াজের থেকেও বেশি।
দেখি ভিডিও কল।
অফিস।

আমি জানি, ফোনটা তুলেই দেখব, সারা স্ক্রিন জুড়ে ভূত বসে আছে কয়েকজন। বইটা ঠেলে ঢুকিয়ে দিই।

Author Amlan Kusum Chakraborty

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

Picture of অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
Picture of অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

সংস্কৃতি

আহার

শমিতা হালদার
অমৃতা ভট্টাচার্য
শ্রুতি গঙ্গোপাধ্যায়

বিহার

কলমকারী

মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়
কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

ফোটো স্টোরি

শক্তিপদ ভট্টাচার্য
নির্মাল্য চ্যাটার্জি
নির্মাল্য চ্যাটার্জি

উপন্যাস

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়