উনিশ শতকের মাঝামাঝি।
কলকাতার এক অভিজাত বনেদি বাড়ির এক বালিকা বধূকে প্রবাস থেকে তাঁর স্বামী একটি চিঠিতে লিখছেন,
“আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকদের দৃষ্টান্তস্বরূপ হইবে। কিন্তু তোমার আপনার উপরই তাহার অনেক নির্ভর।”
আরও লিখেছিলেন,
“..আমি বাবামশায়কে এক পত্র লিখিয়াছি। আমার এই ইচ্ছা যে তিনি তোমাকে ইংলণ্ডে প্রেরণ করেন। তুমি তাহাতে চিন্তিত হইবে না।..”
সেই পত্রেই লেখা ছিল যে যখন তাঁদের বিয়ে হয়েছিল তখন পাত্রীর বিয়ের বয়স হয়নি। ফলে স্বাধীনভাবে বিয়ে করতে পারেননি।
১৮৬৩-তে লেখা সেই ঐতিহাসিক পত্রে স্বামী লিখলেন,
“যে পর্যন্ত তুমি বয়স্ক শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না।”
আজ থেকে দেড়শ বছর আগে শ্বশুরবাড়িতে বসে প্রবাসী স্বামীর কাছ থেকে এমন উৎসাহ আর প্রেরণা সত্যিই সেদিন অভাবনীয় ছিল। একে পুঁজি করেই শাড়িতে গিঁট বাঁধলেন এমন যে ‘সেই শক্তি অর্জন করতেই হবে’।
তবে সেই ব্যক্তির পুরুষকার কি একদিনেই এতটা দার্ঢ্য হয়েছিল? তা তো নয়। তাঁর ভাই – বোনের জবানবন্দিতেই জানা যায় সেই ইতিহাস। যেমন বোন লিখছেন,
‘তখন মেয়েদের বাহিরে কোথাও যাইতে হইলে ঢাকা-দেওয়া পালকিতে যাওয়াই রীতি ছিল — মেয়েদের পক্ষে গাড়ি চড়া বিষম লজ্জার কথা বলিয়া গণ্য হইত।… আমাদের বাড়িতে মেজদাদাই এ সমস্ত উল্টাইয়া দিলেন।’
এই কথার পাশাপাশি ভাই লিখলেন,
‘….মেজদাদা বিলাত হইতে ফিরিয়া আমাদের পরিবারে যখন আমূল পরিবর্তনের বন্যা বহাইয়া দিলেন, তখন আমারও মতের পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। তখন হইতে আর আমি অবরোধ-প্রথার বিরোধী নহি।’
এটাই তো আমূল পরিবর্তন। এই আমূল পরিবর্তনের আরও একটি কাহিনির কথা এই প্রসঙ্গে জানা খুব প্রাসঙ্গিক এবং জরুরি বলে মনে হয়।

তাঁদের দাম্পত্যের সেই কাহিনিটি তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে শোনা যাক্,
‘ওঁর এক বন্ধু ছিলেন মনোমোহন ঘোষ। ওঁর ইচ্ছে যে তিনি আমাকে দেখেন—কিন্তু আমার ত বাইরে যাবার জো নেই, অন্য পুরুষেরও বাড়ীর ভিতরে আসবার নিয়ম নেই। তাই ওঁরা দু’জনে পরামর্শ করে একদিন বেশি রাত্রে সমান তালে পা ফেলে বাড়ীর ভিতরে এলেন। তার পরে উনি মনোমোহনকে মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজনেই মশারির মধ্যে জড়সড় হয়ে বসে রইলুম; আমি ঘোমটা দিয়ে বিছানার এক পাশে আর তিনি ভোম্বলদাসের মত আর এক পাশে। লজ্জায় কারো মুখে কথা নেই।
আবার কিছুক্ষণ পরে তেমনি সমান তালে পা ফেলে উনি তাঁকে বাইরে পার করে দিয়ে এলেন।….
মনোমোহন ঘোষ ওঁর সঙ্গেই বিলেত গিয়েছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে ওঁদের যাওয়া হল, কিন্তু তিনি সিবিল সার্বিস পাশ করতে পারলেন না,
—উনি করলেন। তবে সেজন্য তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি, কারণ পরে তিনি খুব বড় ব্যারিস্টার হয়েছিলেন।…’
বোঝাই যাচ্ছে এটা অবরোধ-প্রথা ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ। এমন এই বৈপ্লবিক কাণ্ডটি ঘটালেন নিজের স্ত্রীকে দিয়েই। আজ থেকে প্রায় দুশ বছর আগে বিশ শতকের গোড়ায় এই শহরের বুকে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে জনৈক পুরুষবন্ধুর আলাপ করানোর এমন দুঃসাহস (দুঃসাহস বললেও কম বলা হয়) দেখানোর নজির বোধহয় আর দুটি নেই!! স্ত্রীর জবানবন্দি থেকেই সেই পুরুষ মানুষটির এমন ব্যক্তিত্ব বা পৌরুষের পরিচয় মেলে।
এই ব্যক্তিত্বময় পুরুষটির চরিত্রের এই অভিনবত্ব ছোট থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর ‘বাল্যকথা’য় আছে,
‘এক সময়ে আমাদের বাড়ী সরস্বতী পূজা হত। মনে আছে একবার সরস্বতী প্রতিমা অর্চনায় গিয়েছি — শেষে ফিরে আসবার সময় আমার হাতে যে দক্ষিণার টাকা ছিল তাই দেবীর উপরে সজোরে নিক্ষেপ করে দে ছুট! তাতে দেবীর মুকুট ভেঙ্গে পড়ল।’
আজ থেকে পৌনে দুশো বছর আগে যিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর দালানে এমন দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন পরবর্তীতে এদেশের প্রথম আইসিএসের শিরোপা জুটেছিল তাঁর মুকুটেই। এবং নিজেই নিজের ‘বাল্যকথা’ লিখতে গিয়ে মূর্তিপুজোর প্রসঙ্গে নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন,
‘যাকে ইংরেজীতে বলে Iconoclast, আমি তাই ছিলুম!’
হাতেনাতে সেদিন দেবীর মুকুট ভাঙার অপরাধে শাস্তি না পেলেও পরে বলেছেন,
‘তার ফলভোগ এখন বুঝতে পারছি। বাঁশীতে ছিদ্র দেখা দিয়েছে।’
কেমন সে ফলভোগ?
‘আমার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা ক্ষয়ে আসছে — স্মৃতিভ্রংশ হতে আরম্ভ হয়েছে।’
কারণ সেদিনের দুর্ঘটনায় সরস্বতী প্রসন্ন হননি বলেই নাকি তিনি সিভিল সার্ভিসের শেষে এসে সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে পারেননি!
নিজের সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল তিনি radical.
নিজের কথা আরও বলেছেন, বিশেষ করে স্ত্রী-স্বাধীনতা নিয়ে। যেমন,
‘আমি ছেলেবেলা থেকেই স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী। মা আমাকে অনেক সময় ধমকাইতেন, ‘তুই মেয়েদের নিয়ে মেমদের মতো গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি নাকি?’ আমাদের অন্তঃপুরে যে কয়েদখানার মতো নবাবী বন্দোবস্ত ছিল তা আমার আদবে ভালো লাগত না।…এই অবরোধ প্রথা আমার অনিষ্টকর কুপ্রথা বলে মনে হত।…বিলেতে গিয়ে আমি দেখতুম স্ত্রী পুরুষ কেমন স্বাধীনভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে মেলামেশা করছে। গার্হস্থ্য জীবনে তাদের মেয়েদের কি মোহন সুন্দর প্রভাব।’
তাঁর এই অন্যরকম দৃষ্টিকে কি তাঁর বাবা মেনে নিয়েছিলেন? একথার জবাবও তাঁর ‘বাল্যকথা’য় পাওয়া যায়।
‘বিলেত থেকে ফিরে এসে এই বিষয়ে পূর্বপশ্চিমের পরস্পর বিপরীত ভাব আমাদের [আমার] মনে স্পষ্ট প্রতিভাত হল — পর্দা উচ্ছেদ স্পৃহা আরও জেগে উঠল। কিন্তু তখন ভাল করে দেখতে পেলুম আমার সামনে যে পর্বত সমান বিঘ্নবাধা তা অতিক্রম করা কি কঠিন! যে প্রচন্ড গড়ের মধ্যে আমাদের মেয়েরা আবদ্ধ, সে দুর্গ ভেদ করা কি দুরূহ ব্যাপার! অথচ আমার তা না করলেই নয়।’
কিন্তু কীভাবে পথ তৈরি হল? দুর্গ ভেদ হল কেমন করে?

তখন তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সদ্য পাশ করে এসেছেন। তৎকালীন বোম্বাই শহরে কর্মস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। বোম্বাই যেতেই হবে। ‘আর আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।’ ভাবলেন স্ত্রী স্বাধীনতার দ্বার খোলার এই তো মস্ত সুযোগ। কলকাতা বোম্বাই রেলপথও তৈরি হয়নি তখনও। ফলে জাহাজে করেই যেতে হবে। বলছেন,
‘বাবামহাশয় তাতে কোন উচ্চবাচ্য করলেন না।’ আসলে কথা হচ্ছে ঘাটে যাবেন কেমন করে আর জাহাজে যাবেনই বা কেমন করে? বাড়ি থেকেই গাড়িতে করে স্ত্রীকে নিয়ে যাবার তিনি প্রস্তাব দিতেই তাঁর রাশভারী বাবা সম্মত হলেন না! বললেন,
‘মেয়েদের পাল্কীতে করে যাবার নিয়ম আছে তাই রক্ষা হোক।’ মহা ফাঁপরে পড়লেন তিনি। অথচ অনমনীয় জেদ তাঁর, অবরোধ-প্রথা ভাঙতেই হবে। তাহলে কী উপায় হল?
বিলেত থেকে ফিরে এসে এই বিষয়ে পূর্বপশ্চিমের পরস্পর বিপরীত ভাব আমাদের [আমার] মনে স্পষ্ট প্রতিভাত হল -- পর্দা উচ্ছেদ স্পৃহা আরও জেগে উঠল। কিন্তু তখন ভাল করে দেখতে পেলুম আমার সামনে যে পর্বত সমান বিঘ্নবাধা তা অতিক্রম করা কি কঠিন! যে প্রচন্ড গড়ের মধ্যে আমাদের মেয়েরা আবদ্ধ, সে দুর্গ ভেদ করা কি দুরূহ ব্যাপার! অথচ আমার তা না করলেই নয়।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর Tweet
অবশেষে অসূর্যস্পশ্যা কুলবধূটি কর্মচারীদের চোখের সামনে দিয়ে বাইরের দেউড়ি ডিঙিয়ে গাড়িতে উঠলেন। ব্যস, বাংলার বুকে স্ত্রী-স্বাধীনতার জয়ধ্বজাটি সেই থেকে উড়তে শুরু করল।
কলকাতার এক অভিজাত বনেদি পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিচারণের কয়েকটি উক্তির কোলাজ দিয়ে আজকের প্রতিবেদনটি নিবেদিত হল।
এতক্ষণে সুধী পাঠকের কাছে সেদিনের নায়কের পরিচয়টি নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে গেছে। হ্যাঁ, তিনি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এদেশের প্রথম আই.সি.এস। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মধ্যম পুত্র তিনি। তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। এবং উল্লেখিত বোন ও ভাইটি হলেন যথাক্রমে সৌদামিনী দেবী এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ছবি সৌজন্য: Pinterest
গ্রন্থঋণ:
১) আমার বাল্যকথা: সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
২) পুরাতনী: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
৩) জীবনস্মৃতি: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত)
৪) পিতৃস্মৃতি: সৌদামিনী দেবী
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।