‘খালি বলতেন– আর যাই কর, সিনেমায় নামবে না!’ এই কথার খেই ধরে ‘নায়ক’-এর মধ্যে নাটক ঢুকে পড়েছিল। সিনেমার মধ্যে থিয়েটার। হ্যাঁ, সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘নায়ক’-এর কথা বলা হচ্ছে। নিজের লেখা গল্প নিয়ে সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি। প্রযোজক আর ডি বনশল। ব্যাপারটা কী একটু মনে করা যাক।
বাংলা সিনেমার ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখোপাধ্যায় (উত্তমকুমার) চলেছেন দিল্লি। রাজধানী এক্সপ্রেসের ফার্স্ট ক্লাসের সওয়ারি হয়ে। কী একটা পুরস্কার নিতে। ট্রেনে আলাপ হয়েছে অদিতি সেনগুপ্তের (শর্মিলা ঠাকুর) সঙ্গে। মেয়েদের জন্য পাঁচমিশেলি একটা কাগজ চালান অদিতি। একটা সাক্ষাৎকারের জন্য অনুরোধ করাতে ফেলতে পারেননি অরিন্দম। এদিকে মুশকিল হয়েছে কী, অরিন্দমের আবার রাতে ঘুম হয় না। ইনসমোনিয়ায় ভোগেন। ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম এসেছিল বটে, কিন্তু একা আসেনি। এসেছিল দুঃস্বপ্ন সঙ্গী করে। আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টাকা পড়ছে। খোলামকুচির মতো সেই টাকা নিয়ে খেলতে খেলতে হঠাৎ অরিন্দম দেখলেন যে টাকা পড়া থেমে গেছে। টেলিফোন বাজছে। রিসিভারটা রাখা কঙ্কালের হাতের ওপর। বীভৎস দৃশ্য!

দেখতে দেখতে চারদিক থেকে অরিন্দমকে ঘিরে ফেলল ওরকম কঙ্কালের ওপর রাখা অনেকগুলো টেলিফোন। পালানোর পথ নেই। এদিক-ওদিক করতে করতে চোরাবালিতে পা পড়ে গেল। তলিয়ে যেতে যেতে অরিন্দমের চোখে পড়ল অনেকটা দূরে চেনা একজন দাঁড়িয়ে আছেন। শঙ্করদা। অরিন্দমের কাতর অনুরোধে শঙ্করদা তাঁকে টেনে তুলতে এলেন। পচে যাওয়া ফেটে যাওয়া একটা মুখ দেখা গেল। তারপর একটা হাত। বাড়ানো সেই হাত অরিন্দমের হাত ধরতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে গুটিয়ে নিল। তলিয়ে যাবার আতঙ্ককে সঙ্গী করে সকাল হল অরিন্দমের।
খানিকবাদে ডাইনিং কারে ব্রেকফাস্ট করতে বসে অদিতির কাছে এই অদ্ভুত দুঃস্বপ্নের কথা বলতে শুরু করায় অরিন্দমের জীবনের এমন একটা অধ্যায় সামনে চলে এল, যেটা অনেকেই জানে না। এই অধ্যায়ের প্রথম পুরুষ শঙ্করদা। অরিন্দমের পাড়ার দাদা। কোন পাড়া? খুব স্পষ্ট করে বলা না থাকলেও ভবানীপুর-কালীঘাট মহল্লাই মনে হয়। অরিন্দমের চরিত্রাভিনেতা উত্তমকুমারের গিরিশ মুখার্জি রোডের বাসার কাছেপিঠেই হবে। সেই পাড়ার ক্লাবের থিয়েটারের ‘হিটলার’ মার্কা সর্বেসর্বা ছিলেন শঙ্করদা। তাঁর নেকনজরে থাকায় ক্লাবের থিয়েটারে হিরোর পার্ট কোনওদিন ফস্কায়নি অরিন্দমের।
কিন্তু সিনেমা নিয়ে শঙ্করদার প্রবল আপত্তি। ‘খালি বলতেন– আর যাই কর, সিনেমায় নামবে না!’ পুজোর থিয়েটারের জন্য জোরকদমে রিহার্সাল চলছে, এমন সময় শঙ্করদা হঠাৎ জানতে পারেন যে ‘দেবী চৌধুরানী’ছবিতে ব্রজেশ্বর করার অফার পেয়েছেন অরিন্দম। ছুটে এসে রিহার্সাল শিকেয় তুলে দিয়ে অরিন্দমকে চেপে ধরেন। এবং সিনেমা যে থিয়েটারের তুলনায় কত নগণ্য, কত তুচ্ছ, সেটা বোঝাতে চান। সেদিন শঙ্করদা যা বলেছিলেন, সেটা শিল্প হিসেবে থিয়েটারের মহত্ব নিয়ে যাঁরা গলা ফাটান, তারা আজও বলে থাকেন। যবে থেকে থিয়েটারের হাত ধরাধরি করে সিনেমা এসেছে বাংলায়, তবে থেকেই কথাটা চালু আছে।
‘দ্যাখ অরিন্দম, ফিল্মের একটা গ্ল্যামার আছে জানি। কিন্তু তার সঙ্গে আর্টের কোনও সম্পর্ক নেই। থাকতে পারে না। বিশেষ করে ফিল্মের অভিনেতার কোনও সাসটেনড কন্ট্রিবিউশন বলে কিছু থাকতে পারে না। ইমপসিবল! এ আমি জেনে বলছি, না জেনে নয়। ফিল্ম নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করা আছে আমার। এ ফিল্ম অ্যাক্টর ইজ নাথিং বাট এ পাপেট! পুতুল! পরিচালকের হাতে সে পুতুল! ক্যামেরাম্যানের হাতে সে পুতুল! সাউন্ড রেকর্ডিস্টদের হাতে সে পুতুল! আর যিনি কাঁচি দিয়ে ছবি কাটবেন, আর কেটে জুড়বেন, তার হাতে সে পুতুল! আর একটা কথা। মঞ্চের অভিনেতার যেটা আসল সোর্স অফ ইনসপিরেশন– দর্শক– ফুটলাইটের পেছনে ওই কালো কালো মাথাগুলো যে দেখিস, যার থেকে তোর এনার্জিটা আসে, তোর প্রেরণাটা আসে, সেটাকে বাদ দিলে অ্যাক্টিংয়ের যেটা আসল থ্রিল, সেটা থাকে? ফিল্মে সেটা কোথায়? এত মোহ কীসের জন্য? টাকার জন্য?’

এটুকু বলে ছায়াছবির সঙ্গে বাণিজ্যলক্ষ্মীর ‘ন্যাস্টি’ সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন শঙ্করদা।
শেষমেশ অবশ্য অরিন্দমকে নিবৃত্ত করা যায়নি। তাছাড়া দুর্গাপুজোর ভাসানের দিন থ্রম্বোসিসের অতর্কিত হানায় শঙ্করদার প্রয়াণ ঘটলে ‘সাকসেসফুল পুতুল’ হবার সদর দরজা হাট করে খুলে গেছিল অরিন্দমের কাছে। তবু শ্মশানে শঙ্করদার জ্বলন্ত চিতার সামনে বসে বন্ধু জ্যোতিকে (নির্মল ঘোষ) অরিন্দম শুধিয়েছিল, ‘আচ্ছা তোর কি বিশ্বাস হয় ফিল্ম অ্যাক্টররা সবাই পুতুল? ব্র্যান্ডো, বোগার্ট, পল মিউনি– এরা সবাই পুতুল?’ মন মানেনি। তবু একটা অপরাধবোধ কুরে কুরে খেত অরিন্দমকে। ওই দুঃস্বপ্নের মূলে বোধকরি সেটাই ছিল।
কিন্তু ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস নিয়ে এখন আমরা ভাবছি না। কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং ওই সাররিয়্যাল ড্রিমের কোন ব্যাখ্যা করতেন সেটাও এখানে অবান্তর। আমরা ভাবছি একটা ফল্গুধারার কথা, যেটা ‘নায়ক’-এর আপাত সিনেম্যাটিক ন্যারেটিভের নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে। বাদী-সম্বাদী-বিবাদী স্বরের মতো মাঝেমাঝে উপস্থিতি জানান দিয়ে দিয়ে। এই ফল্গুধারার প্রধান উপাদান হল থিয়েটার আর সিনেমার তুল্যমূল্য বিচার। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে থিয়েটার আর সিনেমার অভিনয়রীতির ফারাক। যে ফারাক গড়ে দেওয়াটাই ছিল ভারতীয় ছায়াছবিতে নিওরিয়্যালিজমের উদ্বোধক সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম উদ্দেশ্য।
কেন? সেই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটার জায়গা এখানে নেই। তর্কের খাতিরে এটুকু বলা থাক যে বাংলা থিয়েটারের বিজ্ঞাপন হিসেবেই বাংলা সিনেমার জন্ম হয়েছিল। নির্বাক ছবির যুগে তো বটেই, তারপরেও বাংলা থিয়েটারের সঙ্গে বাংলা সিনেমার নাড়ির যোগ ছিল। চিত্রনাট্য বা স্ক্রিনপ্লে কথাটার মধ্যেই ওই জন্মদাগ রয়ে গেছে। ‘টকি’ এসে পড়ায় আরও বেশি করে কলকাতার পাবলিক থিয়েটারের অভিনয়রীতি জাঁকিয়ে বসেছিল টালিগঞ্জের স্টুডিয়োতে তৈরি সিনেমার ঘাড়ে। অভিনেতৃমণ্ডলীর কমবেশি সকলেই থিয়েটার থেকে সিনেমায় আসতেন বলে ব্যাপারটা একেবারে জলভাত ছিল। মুরারী ভাদুড়িকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটা বহুউদ্ধৃত চিঠিতে এর সাক্ষ্য আছে।
এরই পাশাপাশি থিয়েটার আর বায়োস্কোপ (তখন সিনেমা-ফিল্ম-মুভি কোনওটাই নয়, বায়োস্কোপ কথাটারই চল ছিল) যে আলাদা, তাদের অভিনয়ের কায়দাকানুন যে আলাদা, এ নিয়েও কথা উঠছিল। ওভাবে থিয়েটারের খিদমতগারি করা যে মোটেই উচিত হচ্ছে না, এসব নিয়েও লেখাপত্তর বেরোচ্ছিল। ‘পথের পাঁচালী’ ছেপে বেরনোর ক’বছরের মাথায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন- ‘বায়োস্কোপ থিয়েটারকে বড় বেশী নকল এবং অনুকরণ করেছে এবং করছেও।’

সত্যজিৎ-ও ঠিক এই কথাটাই বিশ্বাস করতেন। এই মামুলি ছক ছিঁড়বেন বলে আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন তিনি। বাংলা সিনেমাকে বা ব্যাপক অর্থে ভারতীয় ছায়াছবিকে আগের মতন ড্রাম্যাটিক নয়, আনকোরা সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজে ছাপিয়ে নেওয়াই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। থিয়েটারের ঘরের লোক ছিলেন না বলে কিছু সুবিধেও তাঁর ছিল। তাঁর সমকালীন চলচ্চিত্রকারদের অনেকেই– যেমন গ্রিগোরি কোজিন্তসেভ, আকিরা কুরোসাওয়া, ইংগমার বার্গম্যান বরাবরই দু’ নৌকোয় পা দিয়ে চলেছেন। থিয়েটারের সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্টের জন্য জান কবুল করেছেন। ওদিকে শেষ জীবনে নেহাত বেকায়দায় পড়ে হেনরিক ইবসেনের কাছে হাত পাতার আগে পর্যন্ত থিয়েটারের ছায়া মাড়াননি সত্যজিৎ। যে মেলোড্রামা বেশির ভাগ ভারতীয় ছায়াছবির প্রাণভোমরা, তার দিকে ফিরেও তাকাননি কোনওদিন।
এদেশের সিনেমাতে ড্রাম্যাটিক অ্যাক্টিং মোটেই অচল পয়সা ছিল না। আজও নয়। ‘নায়ক’ বানানোর আগের বছর, অর্থাৎ ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ বলেছিলেন, উনিশ শতকের বাংলা পাবলিক থিয়েটারের আকর্ষণ ও আবেদন এমনভাবে বাঙালি দর্শকদের ওপর ভর করে আছে, যে তার সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়ায় না আসতে পারলে বাংলা সিনেমা কোনওদিনই দর্শকমনে দাগ কাটতে পারবে না, তাদের আদর পাবে না।
পরের বছরই যেন ওই বোঝাপড়ার চেষ্টা করলেন সত্যজিৎ। ১১৫ মিনিট ধরে তাদের চ্যুতিরেখাকে চেনালেন। আর সেই সুযোগে থিয়েটার আর সিনেমার অভিনয়শৈলী নিয়ে যেসব তর্কবিতর্ক সে সময়ে বাজারচলতি ছিল, সেগুলোকে ঝালিয়ে নিলেন। একটা কথা এখনও চালু আছে– ‘থিয়েটার ইজ অ্যাকশন, সিনেমা ইজ রিয়্যাকশন।’ সিনেমায় ক্লোজ় আপ আছে, থিয়েটারে নেই। মুখমণ্ডলবাহিত যে সব অভিব্যক্তি প্রথম সারির দর্শকের কাছে পৌঁছয়, পেছনের সারির দর্শকের কাছে পৌঁছয় না। থিয়েটারে অতিরঞ্জন লাগে। ভয়েস প্রোজেকশনের বেলাতেও একই কথা খাটে। অভিনেতাকে লার্জার দ্যান লাইফ হতেই হয়।
অন্যদিকে ক্যামেরা আর সাউন্ড রেকর্ডার হাতে নিয়ে এসব ঝুটঝামেলা কাটিয়ে এগোতে পারে সিনেমা। ছায়াছবির অভিনয় হতে পারে স্বভাববাদী। ন্যাচারাল। সত্যজিতের অত্যন্ত অপছন্দের অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়া আর মোটের ওপর পছন্দের অভিনেতা উত্তমকুমারের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় তফাত ছিল। সেই তফাত প্রকট হয়েছিল ‘দেবী চৌধুরানী’র শুটিং ফ্লোরে। ‘ফিল্ম উইদিন ফিল্ম’-এর এমন প্রয়োগ তখনও পর্যন্ত বিরল ছিল বাংলায়।

হিরো ব্রজেশ্বর সেজে শুটিং ফ্লোরে সেটাই অরিন্দমের প্রথম দিন। তাঁর বাবা সাজছেন পোড়খাওয়া দাপুটে অভিনেতা মুকুন্দ লাহিড়ী (বীরেশ্বর সেন)। মাঝেমাঝে মনে হয় অরিন্দম-জ্যোতির মেসের দেওয়ালে শিশির ভাদুড়ির ছবি না-থাকলেও ওই মুকুন্দ লাহিড়ী নামের মধ্যে শিশির ভাদুড়ির আদল থাকলেও থাকতে পারে। কানাঘুষো আছে, সত্যজিৎ নাকি তাঁকে ‘জলসাঘর’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সেধেছিলেন এবং ভাদুড়িমশাই তাঁকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বস্তুত, দেবী চৌধুরানীর একটা চলচ্চিত্রায়ণ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল। তাতে প্রদীপকুমার সেজেছিলেন ব্রজেশ্বর, আর শিশির-ঘরানার অভিনেতা নীতীশ মুখোপাধ্যায় তাঁর বাবা সেজেছিলেন।
অরিন্দমের কেরিয়ারগ্রাফ মন দিয়ে দেখলে ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৬-র যাত্রাপথ চিনে ফেলাই যায়। সত্যজিৎ তখন অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির কাজ করার সমান্তরালে সিনেমা বানানোর তাল ঠুকছেন। ওই ১৯৪৯-এই ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় বেরচ্ছে তাঁর নান্দনিক ইস্তেহার – ‘হোয়াট ইজ রং উইথ ইন্ডিয়ান ফিল্মস।’ ফ্লোর-ভর্তি কলাকুশলীর সামনে মুকুন্দ লাহিড়ীর কাছে অরিন্দমের অপমানিত হবার জ্বালা যেন সেকেলে হয়ে-পড়া থিয়েট্রিক্যাল অ্যাক্টিংয়ের দাপটের সামনে একেলে সিনেম্যাটিক অ্যাক্টিংয়ের এক নবীন প্রতিভূর অহেতুক নাস্তানাবুদ হবার সামিল।
সত্যজিৎ এমনভাবে দৃশ্যায়ন করেছেন, যে দুটো অভিনয়শৈলীর পার্থক্য বেবাক সাফ হয়ে গেছে। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে তাকিয়ার হেলান দিয়ে বসে আছেন মুকুন্দ। দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছেন ব্রজেশ্বর-রূপী অরিন্দম। মুকুন্দর আয়েসি উচ্চারণে, তাঁর কণ্ঠনালির কাঁপুনিতে, থেমে থেমে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলাতে, প্লুতস্বরের লাগাতার প্রয়োগে যে সুর ফুটে বেরোচ্ছে, তা মিনার্ভা-স্টারে অতি সুলভ। মেট্রো-নিউ এম্পায়ারে নয়। মোগলাই গোঁফদাড়ি সমেত তাঁকে ক্লোজ় আপে ধরেনি ক্যামেরা। তা সত্ত্বেও কপালের ভাঁজ থেকে কুঁচকোনো ভুরু, সবেতেই অতিরেক ধরা পড়ছে। অরিন্দমের নিচু চাবির অভিনয়ের সামনে সেটা আরও খোলতাই হচ্ছে। খানিক যেতেই অভিনয় থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে রোষকষায়িত চোখে অরিন্দমের দিকে তাকিয়েছিলেন মুকুন্দ। বলে উঠেছিলেন, ‘এটা কি স্বগতোক্তি, না হলিউড স্টাইল?’ নিমেষে উদোম হয়ে গেছিল অভিনয়রীতির টানাপড়েনের চাপা রহস্য।
– বিড়বিড় করচিলে কেন?
– আজ্ঞে, এখানে একটু কমই চাইছিল না?
– কম চাইছিল?
– বঙ্কিম লিখেছেন যে সেকালের ছেলেরা বাপের সামনে গলা তুলত না।
– না তুললেও একটা সামঞ্জস্য থাকবে বইকি! আমি জল বলব, তুমি তেল বলবে– দুটো মিশ খাবে কী করে? আর তাছাড়া কণ্ঠস্বরটা অবহেলা করার জিনিস নয়। তুমি তো স্টেজে অভিনয় করেছ। গলার কাজ শেখোনি? হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান নেই? নাকি ক্যামেরার সামনে সেসব …

ফেড ইন করে গেছিল মুকুন্দের আওয়াজ। ভয়েস ওভারে ফিরে এসেছিলেন অরিন্দম। বলেছিলেন, ‘হজম করে গেলাম। তবু মনে মনে জানতাম যে ওঁর অভিনয় স্টাইলটা ভুল। কারণ সেটা পুরনো। আজকের দিনে সেটা অচল।’ এর খানিক বাদে আর একটা ফ্ল্যাশব্যাকে, সম্ভবত বড় পর্দায় প্রেস শো-তে দেবী চৌধুরানী দেখে এসে বন্ধু জ্যোতির সামনে ছবির কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে অরিন্দমের মনে হয়েছিল মুকুন্দ লাহিড়ীর সঙ্গে চারটে সিনেই তাঁর অভিনয় ‘গুবলেট হয়ে গেছে’। মুকুন্দ তাঁকে ‘লেঙ্গি’ মারলেন বলে পয়লা বাজিতেই মাত করতে পারেননি অরিন্দম। এ নিয়ে আপশোস হলেও মেজাজ হারাননি সত্যজিতের নায়ক। তলিয়ে ভেবে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘আমি যে পার্টটা নিয়ে ভেবেছি সেটা ও বুঝতে পেরেছিল। আর সেইটেই ও সহ্য করতে পারল না।’
এর পরের কথাগুলো সাংঘাতিক! বাংলা সিনেমার প্রাক-পথের পাঁচালী পর্বের অভিনেতা ও তাঁদের অভিনয়রীতিকে কার্যত তুলোধোনা করে অরিন্দমকে দিয়ে সত্যজিৎ বলাচ্ছেন,
‘এরা কীরকম জানিস? এদের কাছে চরিত্র-ফরিত্র বলে কিস্যু নেই। তুই যে-কোনও পার্ট দে, যে কোনও পার্ট, ওই এক ধাঁচে ফেলে দেবে। সেই এক কণ্ঠস্বর, এক অভিনয়, এক ম্যানারিজ়ম। আর পাবলিকও হয়েছে সেরকম! মুকুন্দ লাহিড়ী! আহা কী অভিনয়! কী কণ্ঠস্বর! আরে ধুর ধুর ধুর! এটা কোনো ফিল্ম অ্যাকটিংই নয়। ক্যামেরার সামনে অতি-অভিনয় চলে না। একটু বাড়িয়েছ কি দশগুণ বেড়ে যাবে। তবে আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম সেটা ওঁর পাশে খুব ডেঞ্জারাস হত। সেটা ও বুঝতে পেরেছিল। আর বুঝতে পেরেছিল বলেই আমাকে নতুন পেয়ে হুমকি দিয়ে দাবড়ানি দিয়ে …’
বলে শেষ করেছিলেন অরিন্দম। খানিক বাদেই বেরিয়ে এসেছিল নান্দনিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সেই অমোঘ উচ্চারণ–
‘(উন্নতি) করব। আলবাত করব। আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ!’
এই তেএঁটেপনার মধ্যে কি খালি অরিন্দম মুখোপাধ্যায় আছেন? সত্যজিৎ রায় নেই? উত্তমকুমার নেই? আলবাত আছেন! উত্তমকুমারের আইডল ছিলেন পল মিউনি। মিউনির বছর কুড়ি পরে হলিউডে আসা মার্লন ব্র্যান্ডোর উত্থানপর্ব ১৯৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর জুড়ে হলেও উত্তমকুমার-সত্যজিতের উত্থানপর্বের সঙ্গে তার হুবহু মিল আছে। মিউনি আর ব্র্যান্ডো দু’জনেই থিয়েটার থেকে সিনেমায় এসেছিলেন। স্তানিস্লাভস্কি-ঘরানার মেথড অ্যাক্টিং প্রয়োগ করেছিলেন সেলুলয়েডে। উত্তমকুমার তাঁদের অনুসরণ করেছেন। অরিন্দমের সংলাপ বলছে, এঁরাই তাঁর আদর্শ। ১৯৫৫তে ‘পথের পাঁচালী’ যে অভিনয়রীতির প্রণয়ন করেছিল, তা এক অর্থে ওই ‘হলিউড স্টাইলে’র অনুকৃতি। সংলাপের সঙ্গে স্বগতোক্তির সাবেক বিরোধ সেখানে গৌণ।
১৯৬৬-তে ‘নায়ক’ বেরচ্ছে। ততদিনে মূলত ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ ও বহুরূপীর দৌলতে ন্যাচরাল অ্যাক্টিংয়ের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে শহর-শহরতলির শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। এই শ্রেণির মানুষই সত্যজিতের ছায়াছবির মূল পৃষ্ঠপোষক, তখনও পর্যন্ত। তাদের সামনে থিয়েটার-সিনেমার আড়াআড়ির জায়গাটা নজরটান দিয়ে না দেখালে যেন শান্তি পাচ্ছিলেন না সত্যজিৎ।
‘নায়ক’-এর এক জায়গায়, ষাটের দশকের গোড়ায় অচল পয়সা হয়ে যাওয়া মুকুন্দ লাহিড়ীকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তিনি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যিনি সিনেমাতে এসেছিলেন, টকি আসার পর যিনি ‘সামিট’ ছুঁয়েছিলেন, কুড়ি বছর যিনি রাজপাট চালিয়েছেন, সেই তিনি একদিন দেখলেন – ‘হড়কে গেছি।’ তাঁর গলায় ‘দেখলুম দ্য থ্রোন ইজ দেয়ার, বাট আই হ্যাভ বিন ওভারথ্রোন’ এসে কান্নার মতো আটকে গেছিল। শুধু যে ‘ভয়েস’ দিয়ে আধুনিক ছায়াছবির অভিনয়ে পার পাওয়া যায় না, সেটা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অরিন্দম। মুকুন্দ লাহিড়ীকে নিঃস্ব, রিক্ত, ধ্বস্ত অবস্থায় পেয়ে প্রথম আলাপের অপমানের শোধ তুলেছিলেন।
থিয়েটার আর সিনেমার পুরনো লড়াইটাকে এখানেই খতম করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৬৬-র সাপেক্ষে এটা সময়োপযোগী হয়েছিল। আজও এই লড়াইটা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি বলে ‘নায়ক’ পুরনো হয়নি। মুকুন্দ লাহিড়ী ‘মরা হাতির প্রবাদটা কি মিথ্যে’ বলে মিলিয়ে গিয়েছিলেন বটে, অরিন্দম মুখার্জির উত্তরসাধকরা এখন দিনে সওয়া লাখ দর হাঁকছেন।
*ছবি সৌজন্য: লেখক
*ভিডিও সৌজন্য: Youtube
অংশুমান ভৌমিকের জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। ছেলেবেলা কাটিয়েছেন মামারবাড়ি নবদ্বীপে। গত চার দশক কলকাতার বাসিন্দা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজির এমএ হলেও বাবার 'দেশ' বরিশাল আর মায়ের 'দেশ' নদিয়ার মধ্যে দোদুল্যমান তাঁর অস্তিত্ব। পেশায় শিক্ষক, নেশায় কালচারাল কমেন্টেটর। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি করছেন দু'দশকের বেশি। দেশবিদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারো। 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও কৃত্তিবাস-এর নাট্যসমালোচক হিসেবে ইদানীং থিতু।
One Response
হাওড়া থেকে প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে ১৯৬৯-এর ৩রা মার্চ। নায়ক চলচ্চিত্রে সম্ভবত ডিলাক্স এক্সপ্রেস ব্যবহার করা হয়। ডিলাক্স এক্সপ্রেসে প্যানট্রি কার ছিল। ১৯৫৬-র ২রা অক্টোবর থেকে এটিই ছিল দিল্লি যাওয়ার অভিজাত ট্রেন। এখন অবিশ্যি আভিজাত্য হারিয়ে নাম হয়েছে পূর্বা এক্সপ্রেস। এবং হারিয়ে গেছে সুন্দর প্যানট্রি কার।