– আপনি কি কবিতা দত্ত বনিক? 
– হ্যাঁ, কী ব্যাপার?
– শুনলাম এই বাড়ির একতলা…
– ও আচ্ছা… কী নাম আপনার?
– আপনি কি নাম পছন্দ হলে তবেই ভাড়া দেন?
– ধ্যাৎ! 
ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন। মাখনের মতো গালে টোল পড়ল। তখনই দেখা গেল ওর ডান ভুরুর উপর কাটা দাগ, যা না থাকলে মুখটাকে ঘর সাজানোর পুতুল মনে হত। বয়স নিশ্চয় ষাট ছুঁয়েছে। তবু গরিমা অটুট।
– তুমি তো বেশ দুষ্টু ছেলে… তোমাকে তুমি বলেই ডাকছি…। দোতলায় চল।
– আমার নাম রঞ্জন মজুমদার। স্প্যারো কমিউনিকেশনস-এ কাজ করি। মোবাইল… সেলসে…
– হ্যাঁ বিষ্টু, মানে যে এজেন্টের মাধ্যমে এসেছ, সব বলেছে। না-না ডানদিকে নয়… ভদ্রমহিলা আঙুল তুলে দেখালেন,
– বাঁ-পাশে ওই জানালার দিকের সোফাটায় বস। বিকেলের আলো পড়ুক মুখে…
– অ্যাঁ? বিকেলের আলো! মানে এই আলোতে তো কনে দেখা হয়… আপনি ভাড়াটেও দেখেন নাকি?
ভদ্রমহিলা আর হাসলেন না। 
– বস, বস। হ্যাঁ ঠিক আছে…। কী খাবে চা না কফি?
রঞ্জন ঠোঁট নাড়া শুরু করতেই হুকুম চলল,
– কুসুম দুটো চা নিয়ে আয়…
উলটোদিকের কাঠের চেয়ারে বসলেন কবিতা দত্ত বনিক। 
– এইবার বল তোমার ব্যাপার-স্যাপার। নাম তো বলেছ। বাড়ি কোথায়? বাবা-মা? পরিবার?…সব খুলে বল। আজকাল যা সব হচ্ছে… টেররিস্ট-ফেররিস্ট… পছন্দ হলে তবেই একতলা দেখাব। তারপর আই কার্ড-ফার্ড নেওয়া যাবে…
একেবারে পুলিশি জেরা শুরু করেছেন ভদ্রমহিলা। অন্য কোনও জায়গা হলে এখনই চলে যেত রঞ্জন। কিন্তু নিউ টাউনের এই অঞ্চল বেশ পরিষ্কার। খাস কলকাতায়, চৌরঙ্গিতে যেখানে তাদের অফিস, তার থেকে টেম্পারেচার অন্তত দু’ডিগ্রি কম। আশপাশ বেশ ফাঁকা-ফাঁকা। হেঁটে আরাম, মোটর বাইক চালাতেও মজা। বাড়িঘরদোরের তুলনায় মানুষ কম বলেই ভাড়াও কিছু কম। পাঁচ থেকে সাত-হাজারের মধ্যে এই রকম সাড়ে সাতশো-আটশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া যায়। পাঁচ হাজার দিয়ে শুরু করবে, ঠিক করে নিল রঞ্জন। মুখে বলল, 
– হ্যাঁ ঠিক আছে, সব বলছি। তারপর আমিও আপনার কথা জানতে চাইব। ঠিকঠাক লাগলে তবেই ভাড়া নেব…
ভদ্রমহিলা তাকালেন। মনে হয় কথার ধাক্কায় দমবন্ধ হয়ে গেছে। সেই ফাঁকে চোখ বন্ধ করে রঞ্জন ভেবে নিল তার একুশ বছরের জীবন। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গিয়ে কোনও মানুষ মারা যায় না বলেই কবিতা দেবীর কথা ফুটল 
– বেশ, আমিও না হয়…
চায়ে চুমুক দিয়েই রঞ্জন জুড়ে দিল। 
আমার বাড়ি বর্ধমানের কাঞ্চননগরে। কাছেই দামোদর। বর্ষায় এখনও হঠাৎ-হঠাৎ দু’কূল ছাপানো জল। বাবা মণীন্দ্র মজুমদার অ্যাডভোকেট। বর্ধমানে নাম আছে। মা মণিমালা, স্কুলে পড়াতেন। দু’বছর আগে কিডনি ফেলিওর… মারা গেছেন। হাই প্রেশার, সুগারও ছিল। আমরা ওখানকারই পুরনো বাসিন্দা। পড়াশুনা মিউনিসিপ্যাল বয়েজ স্কুলে। রাজ কলেজ থেকে বি এস সি– কেমিস্ট্রি অনার্স। বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে এম এস সি। তারপরে কলকাতায় একটা সেলস ম্যানেজমেন্টের ডিপ্লোমা করছিলাম। এক বছরের কোর্স। কিন্তু ন’মাসের মাথায় স্প্যারো-তে এই চাকরিটা পেয়ে গেলাম।
প্রথমে ছিলাম জুনিয়র সেলস এগজিকিউটিভ। এক বছরের মাথায় সিনিয়র হয়ে গেলাম। তারপরে এই কিছুদিন আগে টিম লিডার, মেন্টর যাই বলুন, হয়ে গেছি। কলকাতায় এই রকম চারটে টিম আছে। আমি একটার লিডার। অফিস থেকে মোটর বাইক কেনার লোন দিল। কিনে ফেললাম। অনেকটা সময় কাটাতে হয় কলকাতায়। ঘোরাঘুরি করতে কাজে লাগে। ক’দিন আগেও বর্ধমান থেকে যাতায়াত করতাম। এখন আর পারা যাচ্ছে না। অনেক সময়েই লাস্ট ট্রেন ফেল হয়ে যায়। তখন মহা হ্যাপা। অত রাত্তিরে টু-হুইলার চালিয়ে বর্ধমান ফেরা ঝঞ্ঝাট।
আরও পড়ুন: অর্ক পৈতণ্ডীর অনুবাদে: জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমাল ফার্ম
অবশ্য আমি ট্রেনেই কলকাতা বর্ধমান করতাম। বাইক রাখা থাকে অফিসের গ্যারাজে। চুরি যাবার ভয় নেই। কলকাতায় এসে সারাদিন ঘোরাফেরা দু’ চাকায়। ফেরবার সময় গ্যারেজে রেখে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরা। কিন্তু এখন প্রবল চাপ। সেলস টার্গেট বেড়ে গেছে হু-হু করে। সেইজন্যেই বাড়ি ভাড়া নেওয়া। এখান থেকে আধঘণ্টায় অফিস পৌঁছনো যাবে। কোনও চাপ নেই…।
– চল একতলা দেখিয়ে আনি। কুসুম চাবি আন…। চা খেয়েছ?…
রঞ্জন মাথা নেড়ে উঠতে যাচ্ছিল।
– আরে এখনও তো পড়ে আছে! বিস্কুট খাও না বুঝি?… ঠিক আছে চা শেষ করে নাও।
ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। সুড়ুৎ-সুড়ুৎ দু’বার চুমুক দিতেই চা শেষ হয়ে গেল। 
– চলুন…
একতলার ঘর দক্ষিণখোলা। জানালা খুলতেই, খালি মেট্রো রেলে বসবার জন্য জোয়ানমদ্দরা যেমন করে, হুড়ুম-দুড়ুম করে ঢুকে পড়ল নেই-আঁকড়া বাতাস। জানালা কাচের। স্লাইডিং। বেশ বড়-বড়। ফলে আলো প্রচুর।
– সন্ধের সময় জানলা বন্ধ রাখতে হয়… ওই একটাই অসুবিধা, বড্ড মশা…।
ভদ্রমহিলা আরও কী-কী সব বলে যাচ্ছিলেন। রঞ্জন মন দিয়ে ঘর দেখছিল। মোট দুটো শোবার ঘর। পূর্বদিকের ঘরের জানালা খুললেই বাগান। চন্দ্রমল্লিকা রোপণ করা হয়েছে। এখনও ফুল ধরেনি। ঘরের গায়েই এক চিলতে রান্নাঘর। উত্তর-পশ্চিম কোণে এক ফালি বসার জায়গা। ড্রয়িং রুম বললেই বলা যায়। একটা ছোট ডাইনিং টেবিল কিনলে ওইখানেই বসাতে হবে। বাথরুম একটা নয়, দুটো। একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে ঢোকা যায়। অন্যটি ঢুকতে হবে ড্রয়িং রুমের দিক থেকে। বাইরের লোকের জন্য এই ব্যবস্থা। কাজের লোক রাখলে সেও ওই টয়লেটই ইউজ় করবে। আজকাল বেশিরভাগ বাড়িতেই এই ব্যবস্থা। কটকটে সাদা নয়, ঘি-রঙা সিল্কের পাঞ্জাবির মতো দেয়াল।
আরও পড়ুন: অমর মিত্রের উপন্যাস: কাকলি গানের বাড়ি
সব মিলিয়ে ঘর পছন্দ হয়ে হয়ে গেল রঞ্জনের। এর জন্য ছ’হাজার চাইলেও দেওয়া যায়। আবার দোতলায়। আবার বিকেলের আলো মেখে সোফায় বসা। এইবার সেই কথাটা পাড়তে হবে। এর আগে এমনই কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট পছন্দ হবার পর ওই কথাটা পাড়তেই সব কেঁচে গেছে। এরা সব লেখাপড়া করে ডিগ্রিই হাতিয়েছে শুধু, মনটা আধুনিক হয়নি। যুক্তি দিয়ে বিচার করতেও শেখেনি। 
– কী, এইবার আমার কথা শুনবে তো?
ভদ্রমহিলা কথা বললেই সুচিত্রা মিত্রের মতো মাথা ঝাঁকান। একমাত্র তখনই দেখা যায় ডানদিকের চুলের গোছার কিছু অংশে পাক ধরেছে। উনি যে রুপোলি চুল চাপা দিতে কলপ করেননি, এইটা দেখে স্বস্তি।
– কী, আরম্ভ করি? চা?… কুসুম আর এক কাপ–
– আপনার আগে আমার আর একটি কথা বলা দরকার…। 
উপরের ঠোঁট নিচের ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে রঞ্জনের। দরকারি কথা বলবার সময় এমনই হয়। চোখ দু’টিও নিশ্চল। প্রতিটি বাক্যের প্রতিক্রিয়া বুঝে, পরের বাক্য গঠিত হবে। সবাই এমনই করে থাকে। তবে রঞ্জন তা অনায়াসে করে। এইজন্যই সে টিম লিডার। ভদ্রমহিলা ভুরু উপরে তুললেন, 
– হুঁ..বল…।
– আমার সঙ্গে আমার বন্ধু নন্দিনী… নন্দিনী রায়চৌধুরী থাকবে। আমারই কাছাকাছি বয়স। দু-এক বছরের বড়ও হতে পারে…
– ও… লিভ ইন– 
ভদ্রমহিলার মুখ দেখে বোঝা শক্ত, ব্যবস্থাটা অপছন্দ কিনা।
– এর আগে কয়েকটা বাড়ি দেখেছি। এই কথাটা শোনবার পর সবাই গুটিয়ে গেছে। এখন আপনি ভেবে দেখুন। ওকে আমি মাসতুতো কি পিসতুতো বোন বলে চালিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু অকারণে মিথ্যে বললে আমার মাথাব্যথা করে…।
রঞ্জন মন দিয়ে ঘর দেখছিল। মোট দুটো শোবার ঘর। পূর্বদিকের ঘরের জানালা খুললেই বাগান। চন্দ্রমল্লিকা রোপণ করা হয়েছে। এখনও ফুল ধরেনি। ঘরের গায়েই এক চিলতে রান্নাঘর। উত্তর-পশ্চিম কোণে এক ফালি বসার জায়গা। ড্রয়িং রুম বললেই বলা যায়। একটা ছোট ডাইনিং টেবিল কিনলে ওইখানেই বসাতে হবে। বাথরুম একটা নয়, দুটো। একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে ঢোকা যায়। অন্যটি ঢুকতে হবে ড্রয়িং রুমের দিক থেকে।
– ঠিক আছে ওর প্রোফাইলটা শুনি… 
ভদ্রমহিলার ভুরু এখনও অর্ধবৃত্ত।
– শিলিগুড়ি হাকিমপাড়ার মেয়ে, বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে বটানিতে এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই ‘দ্য ভ্যানগার্ড’ কাগজে সাংবাদিকের চাকরি পেয়ে গেছে। সাব-এডিটর। এখন থাকে মদন মিত্র লেনে, দূর সম্পর্কের কোনও আত্মীয়ের বাড়ি। উইমেনস হস্টেলে থাকতে পারত, কিন্তু আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর ঠিক করেছি একসঙ্গেই থাকব–
– বিয়ে করে নিলেই পারো…
– হুঁ। এখনও তেমন ভাবিনি…। অবশ্য আমি বলতেই পারতাম আমরা বিবাহিত। আজকাল অনেক মেয়েই মাথায় সিঁদুর পরে না। কারও অ্যালার্জি হয় বলে পরে না, কেউ-কেউ পছন্দ করে না বলে পরে না। অবশ্য সিনেমা সিরিয়ালে দেখবেন সব মেয়েই মোটা করে সিঁদুর লেপে দেয় সিঁথিতে। সে যাক গে, বলতেই পারতাম… কিন্তু ওই যে বললাম মাথাব্যথা–
– মেয়ে কেমন?
– বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে তাও বলতে হয় বুঝি?
– নিশ্চয়ই! তোমায় তো আমি দেখতে পাচ্ছি। আন্দাজ করতে পারছি তুমি মানুষটা কেমন। আর একটি মানুষ থাকবে, তার সম্বন্ধে জানতে হবে না? একটা ডিগ্রি, একটা চাকরি কি মানুষের সব?
শক্ত ঘাঁটি, রঞ্জন মনে-মনে বলল। তবু সেলসের লিডারকে তো হারলে চলবে না। বোঝাতে হবে। বুঝিয়ে মন জয় করবার আনন্দই আলাদা!
– কেমন?… এই আপনারই মতো…
এইটা রঞ্জনের সেলস ট্রিক। ভদ্রমহিলার আত্মবিশ্বাসকে একটু প্রশংসা করে দেওয়া হল, অহংকারও মালিশ পেল। 
– হ্যাঁ আপনারই মতো।
– এইসব ঢলানি কথায় কিছু বোঝা যায় না…। যা বলছি সোজা জবাব দাও, কেমন?
আর উপায় নেই। মনে-মনে নন্দিনীকে ধ্যান করল রঞ্জন। এই অভ্যাসটা বাবার থেকে পেয়েছে। জটিল কোনও কেসের ব্রিফ শোনবার সময় অ্যাডভোকেট মণীন্দ্র মজুমদার চোখ বন্ধ করে নেন। দেখলে মনে হবে কান তো বটেই, সবক’টি রোমকূপ দিয়েও তিনি গ্রহণ করছেন ঘটনার রক্তরস। ডিকটেশন দেবার সময়েও একই অবস্থা। প্রতিটি অক্ষর দেহকোষে নির্মিত হয়ে অকস্মাৎ পাতালঘর থেকে বেরোয়। যেন কোনও আচ্ছন্ন রোগী কথা বলছে– এমনই কণ্ঠস্বর! রঞ্জনও তেমন। 
– নন্দিনী? ও পাহাড়ের চড়াই ভাঙা শেরপার মতো শান্ত, সুন্দর সহজ। ওর চোখ তেমনই গভীর। বহুদূর দেখতে পায়… আবার একই সঙ্গে ও পুরী সমুদ্রের দমকা, হুটোপাটির অতল জল। তেমনই জলপাই রঙের চামড়া–
– ঠিক আছে, বুঝেছি। তোমাকেই, মানে তোমাদেরই দেব…
কবিতা দত্ত বণিক মন্দ-মন্দ হাসলেন। রঞ্জনের আরও কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু উনি থামিয়ে দিলেন–
– এইবার আমার কথা… 
উপরের ঠোঁট নিচের ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে রঞ্জনের। দরকারি কথা বলবার সময় এমনই হয়। চোখ দু’টিও নিশ্চল। প্রতিটি বাক্যের প্রতিক্রিয়া বুঝে, পরের বাক্য গঠিত হবে। সবাই এমনই করে থাকে। তবে রঞ্জন তা অনায়াসে করে। এইজন্যই সে টিম লিডার। ভদ্রমহিলা ভুরু উপরে তুললেন, হুঁ..বল…।
ভদ্রমহিলা এসে বসলেন ডানদিকের সোফায়। একেবারে প্রান্তে। এইবারে ওঁর চোখে-মুখে বিকেলের আলো। চুলে সোনালি রঙ লেগে গেল। আঁচলের কাছেও দু’তিনটি সোনার বল নেচে চলেছে। জানালার বাইরে রাস্তার ওপারে ঝাঁকড়া শিরীষ গাছটাকে এক ঝলক দেখতেই–
– আমি এখানে একা থাকি মানে এই নয় যে, নষ্টবিয়ে অথবা অবিবাহিত।
ডিভোর্সের জবরদস্ত বাংলা করেছেন তো ভদ্রমহিলা– নষ্টবিয়ে! মনে-মনে ভাবল রঞ্জন।
– ও, মানে নীলকণ্ঠ বণিক, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। একেবারে হিসেব মানা ভদ্র। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। মাথায় চকচকে টাক। হঠাৎ দেখলে মনে হবে চুল কামিয়েছে পরিষ্কার করে। কার্গো শিপে। বছরে দু’বার ঘুরে যায়। কখনও একমাস, কখনও পনেরো দিন। এখন সুয়েজে আছে। একটি সন্তান হয়েছিল, কন্যা, কিন্তু সাতমাসের মাথায় মেনিনজাইটিস–
– হ্যাঁ ঠিক আছে… বুঝেছি। 
কারও গলায় মুখে কান্না চলে এলে হতভম্ব লাগে। বিশেষত, তিনি যদি সুন্দরী মহিলা হন। রঞ্জন তাড়াতাড়ি বলল,
– ঠিক আছে। এই ঘর আমার পছন্দ, নন্দিনীরও হবে। তাছাড়া ও আমাকেই ঘর খোঁজার ভার দিয়েছে। আমি হ্যাঁ করে দিলে ও না বলবে না। কবে আসব?
– এই মাসের তো আর মাত্র পাঁচদিন বাকি। সামনের মাসের এক তারিখ এস। চাইলে এ ক’দিনের মধ্যে মালপত্র রেখে যেও…
– তাহলে তো খুব ভালো হয়। আচ্ছা, এইবার ভাড়া–
– তোমাদের কি মাসে ছয় দিতে অসুবিধা হবে?
রঞ্জন চমকে গেল। কী করে ওর মনের কথার নাগাল পেয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা! মুখে বলল,
– হ্যাঁ, আমিও… মানে ওইরকমই–
– ও তাই বুঝি…? একবার স্থির চোখে দেখে নিলেন কবিতা দত্ত বণিক। 
– তাহলে ঠিক আছে…
ভদ্রমহিলা সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। রঞ্জনের সংকোচ হচ্ছিল,
– আপনি আবার… আমি ঠিক চলে…
– তুমি বিকেলের আলো নিয়ে কীসব যেন বলছিলে? জানবে, এইরকম বিকেলের আলো ঠোঁটে মেখে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না…। তুমিও না আমিও না…
ভদ্রমহিলা সদর বন্ধ করে দিলেন।
সেই কবিতা দত্ত বণিক কি আজকের এই ছেলে-বউছুট প্রৌঢ়া? যদি হয়, তাহলে বুঝতে হবে সময়ের থেকে দ্রুত ছুটছেন। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে।
– রাত কাটাবার মতো কোনও জায়গায় নিয়ে যাবে বাবা…?
মনে-মনে নন্দিনীকে ধ্যান করল রঞ্জন। এই অভ্যাসটা বাবার থেকে পেয়েছে। জটিল কোনও কেসের ব্রিফ শোনবার সময় অ্যাডভোকেট মণীন্দ্র মজুমদার চোখ বন্ধ করে নেন। দেখলে মনে হবে কান তো বটেই, সবক’টি রোমকূপ দিয়েও তিনি গ্রহণ করছেন ঘটনার রক্তরস। ডিকটেশন দেবার সময়েও একই অবস্থা। প্রতিটি অক্ষর দেহকোষে নির্মিত হয়ে অকস্মাৎ পাতালঘর থেকে বেরোয়।
কবিতা দেবীর কোনও ছেলে ছিল না। ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসবার পর দু’বছর হয়ে গেছে। এর মধ্যে ছেলে হলেও তার বউ হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবু এই মহিলার সঙ্গে কবিতা দত্ত বণিকের আশ্চর্য মিল। এতটাই, কবিতা দেবীর কপালের কাটা দাগটা খোঁজবার চেষ্টা করল রঞ্জন। নাহ্, এই প্রবীণার কপালে কোনও দাগ নেই। তবু মনে হল, কপালের বলিরেখার মধ্যে লুকিয়ে নেই তো দাগটা। 
– স্যার গলতি কিয়া, মাফ কর কিজিয়ে… 
সেই পালিশওলা। চোখ-মুখ একেবারে ফাঁদে পড়া বগা। শরীরের প্রান্তরেখা সব ভেঙে চুরমার। মুখের কুটিলরেখা সব সরল। ওর মুখে বিকেলের আলো!
– চলিয়ে…পালিশ…
এখনও অবধি কেউ আসেনি পালিশ করাতে। অথচ অন্যদিন অনেকে আসে এই সময়। সামনের আকাশছোঁয়া বাড়ির দারোয়ান থলে ভর্তি করে আনে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের ছোট-ছোট জুতো। তাতে কালি-ক্রিম দুই-ই কম লাগে, খাটনিও কম। আজ একটা থলেও আসেনি। ফলত, পালিশওলা ভড়কে গেছে। ভাবছে রঞ্জন নিশ্চয়ই জামা-প্যান্ট পরা কোনও মুনি-ঋষি! অথবা পিরবাবা।
– চলিয়ে স্যার… তুরন্ত হো জায়গা…
– শুনো, এ মাঈজি রাত কো কঁহা ঠ্যাহরেঙ্গে? জ়রাসা সোচো… 
চোখের ইঙ্গিতে দেখাল রঞ্জন।
পালিশওলা বিভ্রান্ত। না, বিভ্রান্ত বললে ঠিক বোঝানো যাবে না। লোকটি পুরো ঘেঁটে গেছে। একবার বিড়বিড় করল,
– রহনেকা জগাহ…
পরক্ষণেই রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে উলটোদিকে ছুট।
প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ঝোঁক বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি। তাঁর তিনটি তথ্য-উপন্যাস-- অগ্নিপুরুষ, আটটা-ন’টার সূর্য এবং অবিরাম জ্বরের রূপকথা--তিনটি বিভিন্ন সময় নিয়ে। প্রবন্ধের জন্য দু’বার পেয়েছেন আনন্দ-স্নোসেম পুরস্কার। শেষোক্ত উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে নামী পুরস্কারের বিচার তালিকায় স্থান পেয়েছিল।
 
								 
								 
								 
															 
											
 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								 
								