একে কালাহান্ডি, তায় আবার জঙ্গল! বাধা দেওয়ার মানুষজন তো থিক থিক করছে, কিন্তু সে সব ভাবলে কি আমার চলে? ফলে লকডাউনের দমফাঁসে যেই না ফস্কা গেরো, ওমনি আমার মন গেয়ে উঠল, ‘চলো নিজ নিকেতনে’। জনা দু’য়েক বন্ধু তো জুটেই যায়। আর সবচেয়ে বড় খুঁটি হল আমার ওড়িয়া বন্ধু, মানে বাবার ওড়িয়া বন্ধু, সেই রবিজেঠুর মেয়ে- যশোধরা দিদি। আপাতত তাঁর আস্তানা কটক বাসগুমটি লাগোয়া ‘ঝাঞ্ঝির মঙ্গলা’ এলাকায়। রেল স্টেশনের থেকে না–দূর, তার শ্বশুরমশায়ের তিনপুরুষের এক প্রাচীন বসত। তাঁর বর, মানে আমাদের জামাইবাবু বাদলভাই এক নট নড়নচড়ন মানুষ। দিদি তার কবিতা লেখার জোরে সারা ওড়িশা চষে বেড়ায়। যেখানেই যায় তার মনকেমন করে আমার জন্য। পুজোর ঠিক পরে পরেই ডিসেম্বরের শেষদিকে যে কোনও একটা ছুটির দিনের টিকিট কাটতে গিয়ে দেখি, দুনিয়া শুদ্ধ লোকই তো কটক যাচ্ছে! অগত্যা কালাহান্ডি বেড়ানোটা একেবারে বরবাদ করে না দিয়ে, একটু নরম মনে, ছুটির দিনগুলো ছেড়ে, বেমক্কা একটা অন্য দিনে খোঁজ করতেই টিকিট মিলল, যাওয়া এবং ফেরা– দুদিকেরই।
সকালের ট্রেন ধরে কটক পৌঁছেই আবার রাতের ইন্টারসিটি ধরে, ভোরবেলা এসে পৌঁছলাম খড়িয়াল নামে এক ধূ ধূ ইস্টিশনে। সেখানে সব আছে; নিয়ন আলো, বসার বেঞ্চি, বেরিয়েই এটিএম; এমনকী দিদির ব্যবস্থাপনায় আমাদের নিতে আসা টাটা সুমোও। যা নেই তা হল বসতি আর মানুষ। ভোরের চা পান করে, গাড়িতে পঞ্চাশ কিলোমিটার সাঁতরে, নির্ধারিত আস্তানা বা হোটেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিয়ে সারাদিনের মতো আবার পাড়ি। পথে রানিপুর–ঝরিয়ালে ‘চৌষট্টি যোগিনী’ মন্দির দেখে এবং সাঁইপুর গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে চা ও সাদা বড়া খেয়েই এবার সোঁ শনশন সোজা কালাহান্ডি।
অপূর্ব সব পিচ বাঁধানো পথ, ফিকে সবুজ ধানক্ষেত আর নীল আকাশের কোলে কালচে সবুজ পাহাড়। এই অপরূপ নিসর্গ পার হতে হতে যখন কালাহান্ডি পৌঁছলাম, তখন দেখি চারিদিকের সাইন বোর্ডে লেখা ‘ভবানী পাটনা’, কালাহান্ডির প্রধান সদর। একসময়ের মারণ দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশার কথায় চিহ্নিত কালাহান্ডির এ অঞ্চলের দেখতাই বেশ চমকদার। এক ঝাঁ চকচকে হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে, গাড়ি এবার ছুটল বনাঞ্চলের দিকে, যার নাম মহাকান্তার। খুব মনে পড়ছিল অনিতাদি– অনিতা অগ্নিহোত্রী আর তাঁর লেখা ‘মহাকান্তার’ উপন্যাসটির কথা। শহর পেরিয়ে কিছু মফসসলি-পাড়া ছাড়াতেই শুরু হল লাল মাটির পথ আর সবুজের সমারোহ। দীঘল সব গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুনো ফুল আর ভেজা ভেজা ছাইরঙা আকাশ। দূরে খণ্ড খণ্ড পাহাড়ের ইশারা।

শীতের বেলা তখনও পড়েনি, কিন্তু পাতার ছায়ায় ম্লান হয়ে গেছে আকাশের আলো। জনহীন শূন্যতা আর নিবিড় বনগন্ধ। পথ কখনও সরু, আবার কখনও দু’পাশে দু’হাত মেলেছে। সে এক অপূর্ব রহস্য। গলায় স্বর নেই, জিভ বাক্যহারা, দেহ স্থাণুবৎ। চোখ শুধু উদগ্রীব আনন্দে রূপমুগ্ধ। কী দেখছি জানি না। না কোনও পশু, না পাখি, না সরীসৃপ; কিন্তু ছমছমে অস্তিত্বে সকলেই যেন আছে। আমি ওদের না দেখলেও তারা কিন্তু আমাকে ঠিকই দেখছে। কত পথ যে পার হলাম হিসেব রাখিনি; গাড়ি থামতে দেখলাম, লেখা আছে ‘রাবণ ধারা’। আশপাশের শহর থেকে বেড়াতে এসেছেন বহু মানুষ। সাজগোজ করে দল বেঁধে ছবি তুলতেই বেশি ব্যস্ত। আর কিছু মানুষ ছুটে গিয়ে জলে পা রাখছে; একটু সাহসিরা সাবধানে কয়েকটা শ্যাওলা পাথর পার হয়ে ওপারেও চলে যাচ্ছে। মাথা ভিজিয়ে স্নান করছে অনেকে। বেশিরভাগ মানুষ বনবিভাগের বানানো সানসেট পয়েন্টে উঠে সূর্যাস্ত দেখছে।
আমি একটা ধাপ যোগাড় করে বসে পড়লাম। জলটা খুব উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ছে না বলে বেশ মোটা ধারার ঝরনা হয়ে যেন হাত পা বিছিয়ে নামছে। নীচের পাথরে তার নেচে নেচে কুলকুল বয়ে যাওয়ার স্রোত। পাথরের রঙে জলের রং বদলে কখনও তা সবুজ, আবার কখনও বা খয়েরি। এখানে বসে শুনতে পেলাম, পাখিদের ঘরে ফেরার মৃদু আওয়াজ। আরও একটু লক্ষ করে দেখি, ডানদিকের একটা উঁচু পাথরের থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ বেগুনি ফুল নিয়ে একটা কী সুন্দর বুনো লতা শূন্যে ঝুলে আছে; ছোট্ট ছোট্ট পাখিগুলো সেটা আঁকড়ে মধু খাচ্ছে দুলে দুলে। সেই লতাটা আবার বাতাসেও মৃদু মৃদু দুলছে। প্রকৃতি যেন তার বিলাসী বাগানে বুনো লতার ঝুরি পাহাড় থেকে ঝুলিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। পড়ন্ত রোদে, কমলায় রঙিন হয়ে যেতে লাগল জলের ফোঁটাগুলো।

এখান থেকে পাট গুটিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়েও আমরা খোলা পেলাম না ‘ফুরলি ঝরন’ ঝরনা দেখার গেট। গাড়ি থেকে নেমে চোখ বিছিয়ে বুঝলাম, অনেকটা নেমে ওই জলপ্রপাত; এটি রাবণ ধারার মতো গেরস্ত পোষা নয় যে স্নান করা যাবে। বেশ খরস্রোতা এবং বড় বড় পাথরের চাঙড় ডিঙিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র ধারায়; তবে এর উছলে পড়া ধারায় রোদ্দুরের আলো পড়লেই তা নাকি রামধনুর সাতরঙের শোভা হয়ে দেখা দেয়। দেখা না হোক, ‘ফুরলি ঝরন’ নামটাই তখন আবেশ নিয়ে মনের মধ্যে গুণগুণ করছে।
আবার বনপথ এবং আবার সেই পার হয়ে যাওয়া। এবার গাড়ি এসে দাঁড়াল একটা বাঁকের মুখে। সাইনবোর্ডে লেখা ‘জখম’। বাঁহাতি দুপাশের জঙ্গল চিরে যে পথ, তার একেবারে শেষ মুখে বনবিভাগের এক জঙ্গুলে আস্তানা, ঢোকার মুখ থেকেই যা তালাবন্ধ বড় লোহার গেট দিয়ে আটকানো; মানে সংরক্ষিত অঞ্চল। গাড়ির চালক নামতে এবং কথা বলতে বারণ করল, কারণ এটি নাকি হাতি চলাচলের রাস্তা। ঘন বা গহন অরণ্য যে কী, তা তো আমি জানিই না, তবে একবার ঢুকে গেলে নিশ্চিত যে পথ হারাব, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

এখানে আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে না। ঢালু জমিতে শুধু লম্বা লম্বা গাছ আর তাদের আকাশ ঢাকা ছায়া। পাতার রঙেও যে এতো বৈচিত্র্য হয় নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস হত না। গাঢ় সবুজ, কালচে লাল আর উজ্জ্বল হলুদ। ঝরা পাতাগুলো সব হাল্কা বাদামি। বাস্তবটাই যেন কল্পনা হয়ে ধরা দিতে চাইছে। কী একটা শব্দও যেন কানে আসছে বা সবটাই মনের ভুল। এই প্রখর শূন্যতা মাথার মধ্যে পাক খেতে খেতে হয়তো জটলা বেঁধে জড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে চুপচাপ বসেছিলাম সকলে; যেন সম্মোহিত।
ফেরার পথে হুহু করে শেষ হয়ে গেল এ অঞ্চলের আদিবাসীদের প্রিয় জঙ্গল; যার গহীনে তারা বেঁচে আছে তাদের উৎসব, তাদের ওষধি আর আমাদের দেওয়া উপহারের সাংবিধানিক দারিদ্র্য নিয়ে। সে এক মস্ত ইতিহাস এবং পুনর্বাসনের নামে পীড়ন ও উৎখাতের দলিল। ভবানী পাটনা শহরেই জাগ্রত ‘মানিক্যদেবী’র মন্দিরেও যাওয়া হল। কালাহান্ডি যেমন জঙ্গলসম্পদে ঋদ্ধ, তেমনই অফুরান সঞ্চয়ে এখানে আছে দামি দামি পাথরের যোগান। ‘মানিক্যেশ্বরী’র কোনও মাতৃমূর্তি নেই; বিগ্রহ বলতে মানিকখচিত একটি ছাতাকে পুজো করা হয়। এ অঞ্চলগুলি ছিল আদিবাসী অধ্যুষিত এবং স্বাধীন রাজাদের রাজ্য। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে তাঁদের সংযুক্তি ঘটে রাজত্ব চলে গেলেও রাজবাড়িগুলি আজও রয়ে গেছে। অনেকে আবার হোম-স্টে হিসেবে ভাড়াও দেন। মন্দির লাগোয়া রাজবাড়িটিও সেরকমই।

সবচেয়ে অবাক হলাম এখানেই চার পুরুষ কাটিয়ে দেওয়া শিখ পরিবারটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্রী সুরিন্দর সিংয়ের দাদু প্রয়াত পাঞ্জাব সিংকে, সুদূর পাঞ্জাব থেকে এখানে নিয়ে আসেন এই রাজা। তিনি পেশায় ছিলেন ছুতোর; তাঁর সঙ্গে আর একটি পরিবার আসেন রাজবাড়ির মোটরগাড়ি চালাবার জন্যে– ‘ড্রাইভার’ হিসেবে। এ দুটি শিখ পরিবারই বংশপরম্পরায় এখানে থেকে যান। গুরমুখীর থেকে এঁরা ভাল ওড়িয়া বলেন। নিজেদের ঘরে কিন্তু স্বর্ণমন্দির ও গুরু নানকের ছবি টাঙানো। এঁদের বাড়ি পাঞ্জাবি স্টাইলের কফি ও কুকি সহযোগে অসময়ে আমরা যে রাজকীয় আপ্যায়ন পেলাম, তার কারণ তিনি হলেন কটকের রাভেনশ কলেজে যশোধরা দিদির সহপাঠী। এঁদের বাড়ির বারান্দা থেকে রাজবাড়ির পিছন দিকের প্রায় অনেকখানি দেখা যায়। সে সব গল্প শুনতে হলে সুরিন্দরজির সঙ্গে কথা কয়ে কটক বা ভুবনেশ্বর থেকে সোজা কালাহান্ডি এসে উঠতে হবে।
ভবানী পাটনা ছাড়াতেই ধূ ধূ পিচ রাস্তা আর খোলা আকাশের সামিয়ানা। এত অন্ধকারেও তা নীল আর তারার আলোয় জ্বলজ্বল করছে। মনে পড়ছিল এর গভীরে সেই ছায়াময় বনভূমি আর উদ্বেল ঝরনাদের কথা। এতক্ষণে নিশ্চয় বনদেবতার সভা বসেছে আর মদির বনগন্ধে ভরে গেছে চারিদিক। মনে মনে বললাম, আবার আসব এবং এসে বেশ কয়েকদিন থাকব। কোনও হোটেলে নয়; এরই বুকের ভেতর বন বিভাগেরই কোনও গহন আস্তানায়।
*ছবি সৌজন্য: Native Planet, Kalahandi.nic.in
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।