Our casuarina tree—
‘চিঠির সঙ্গে তরুলতা গাছের পাতা ও একটা ছোট ফুল পাঠালাম।’— তরু দত্ত।
মানিকতলা মোড় থেকে দক্ষিণে একটু এগিয়েই বাঁ দিকে চোখে পড়বে গাছপালায় ঢাকা খ্রিস্টান সিমেট্রির গেট। রং-চটা গোলাপি দেওয়ালের গায়ে খোদাই করে লেখা ‘মানিকতলা খ্রিস্টান সিমেট্রি’। ভেতরে ঢুকে কিছুকাল আগেও অবাক হতে হত— এ যেন কোনও কবরখানা নয়, প্রায় এক ছোটখাটো জঙ্গল! এখন অবশ্য খানিকটা পরিষ্কার করা হয়েছে।
বেশ কিছুটা খোঁজাখুঁজির পর চোখে পড়বে দত্ত পরিবারের কবর: তরু দত্ত , অরু দত্তর কবর— অনাদরে, অবহেলায় শায়িত দুই বোন। অথচ উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকায় যে নামগুলি আছে, তাঁদের সঙ্গে একই পংক্তিতে রাখা উচিত তরু দত্তর নাম। পরিতাপের বিষয় বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া এই ক্ষণজন্মা, প্রতিভাশালী মহিলা কবির কবরের ওপর পাথরের স্মৃতি ফলকটি অযত্নে প্রায় মাটিতে মিশে যেতে বসেছিল।

অধ্যাপক চিন্ময় গুহর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ গ্রন্থে তরু দত্তের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয় আমাদের।
১১ অক্টোবর, দুর্গা ষষ্ঠীর দিন।
তখন আমি সদ্য পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের সদস্য রূপে নিযুক্ত হয়েছি।
সেদিন কমিশনের উদ্যোগে মানিকতলা সিমেট্রিতে তরু দত্ত নামাঙ্কিত স্মৃতি ফলক বসানোর কাজটি সম্পন্ন হয়। হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারপার্সন শিল্পী শুভাপ্রসন্নর উপস্থিতিতে ফলক উন্মুক্ত করেন মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম। উপস্থিত ছিলেন দত্ত পরিবারের বর্তমান সদস্যেরা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। ফলকটি লিখেছিলেন বিশিষ্ট ফরাসিবিদ চিন্ময় গুহ।
তরুলতা দত্তর পরিবার ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ, উইলিয়াম কেরি প্রমুখ তৎকালীন খ্রিস্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকদের সংস্পর্শে এসে ১৮৬২ সালে সপরিবারে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজের উল্টোদিকে যে গির্জা, সেখানেই তাঁদের ধর্মান্তরণ ঘটেছিল।

অরু ও তরু দত্ত— এই দুই বাঙালি কন্যার নাম ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে একসময় একনিঃশ্বাসে উচ্চারিত হত, অনেকটা ইংরেজি সাহিত্যের ব্রন্টি বোনদ্বয়ের মতো। দুই পিঠোপিঠি বয়সের বোন অরু ও তরু ছিলেন, ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’র লেখক, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের বড়ভাই, কবি ও ভাষাবিদ গোবিন্দ চন্দ্র দত্তের কন্যা। মা ক্ষেত্রমণি দত্ত।
গোবিন্দবাবুর এক পুত্র ও দুই কন্যার সকলেই স্বল্পায়ু ছিলেন। অরু ও তরু দু’বোনের মধ্যে কবি-কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাতিটা ছোটবোন তরুরই একটু বেশি ছিল।
একমাত্র পুত্র অব্জুর মৃত্যুর পর তরুর বাবা ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৬৯ সালে ফ্রান্সে আসেন, তরু এবং অরুকে ভর্তি করেন দক্ষিণ ফ্রান্সের এক আবাসিক স্কুলে। সেখানে দুই বোন ফরাসি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। শুরু হয় দুজনের কবিতা লেখা। দুই বোন ফরাসি এবং ইংরেজিতে লিখতে পারত মাতৃভাষার মতো। ১৮৭১ সালে তাঁরা চলে আসেন কেমব্রিজে। সেখানে শুরু হয় ইংরেজি ভাষার চর্চা। ১৮৭৩ সালে তাঁরা দেশে ফিরে আসেন মূলত ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে।
বড় বোন অরু দত্ত বেঁচে ছিলেন মাত্র ২০টি বছর। ১৮৭৪ সালের ২৩ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। অনেক সমালোচকের মতে অকালপ্রয়াতা অরুর কবিতা অনেকক্ষেত্রে তরুর চেয়েও সরস।
বোনের মৃত্যুতে ভীষণ আঘাত পান তরু দত্ত, কারণ সর্বদা দুই বোন মিলেমিশে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। দুজনে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেছিলেন বেশ কিছু ফরাসি কবিতা। আবার বেশ কিছু কবিতা তরু লিখেছেন, অরু অলংকরণ করেছেন।
বোনের মৃত্যুতে ভীষণ আঘাত পান তরু দত্ত, কারণ সর্বদা দুই বোন মিলেমিশে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। দুজনে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেছিলেন বেশ কিছু ফরাসি কবিতা। আবার বেশ কিছু কবিতা তরু লিখেছেন, অরু অলংকরণ করেছেন।
অসম্ভব প্রতিভাময়ী তরু দত্তর মৃত্যু হয় ৩০ আগস্ট, ১৮৭৭ মাত্র ২১ বছর বয়সে।

জীবনের অধিকাংশ সময় ইউরোপে কাটালেও তরুর অন্তরে গভীর ভালোবাসা ছিল দেশের প্রকৃতি, গাছপালা, পুরাণ, মহাকাব্যের ওপর। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটি ‘Our Casuarina Tree’। আরও একটি বিখ্যাত কবিতা ‘Lotus’। তরু দত্তের লেখায় মানবজীবনের সমস্যা যেমন উঠে এসেছে, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতও ছুঁয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি। তৈরি হয়েছে সাবিত্রী, একলব্য, সীতা। মৃত্যুর এক বছর আগে ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা তাঁর ১৫৬টি কবিতার সংকলন ‘আ শেফ গ্লিন্ড ইন ফ্রেঞ্চ ফিল্ড’ (ফরাসি ক্ষেতে কুড়ানো এক আঁটি ফসল) প্রকাশিত হয়। তাঁর বাবা মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের প্রতি ভালবাসায় নিজ ব্যয়ে কবিতা সংকলনটি প্রকাশ করেন ভবানীপুরের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রেস থেকে। এর মধ্যে চারটি কবিতা দিদি অরু দত্তের অনুবাদ। ১৮৭৭ সালে সমালোচক এডমন্ড গুজ এটি পড়েন এবং ভূয়সী প্রশংসা করে রিভিউ প্রকাশ করেন। তরু দত্তের মৃত্যুর পর বইটির আরও সংস্করণ বের হয়। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা সংস্কৃত সাহিত্য থেকে নেওয়া ‘অ্যানসিয়েন্ট ব্যালাডস অ্যান্ড লিজেন্ডস অব হিন্দুস্তান’ তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়।
তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর ফরাসি ভাষায় ডায়রির আকারে লেখা উপন্যাস ‘মাদমোয়াজেল দ্যারভারের দিনপঞ্জী’। এটিই কোনও ভারতীয় লেখকের ফরাসি ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি অনুবাদ করে বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই উপন্যাস এতটাই প্রাসঙ্গিক যে বহু বছর পর ১৯৫৬ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয়, যার ভূমিকা লেখেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তেমনই তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘বিয়াংকা অর দ্য ইয়াং স্প্যানিশ মেইডেন’ প্রথম ভারতীয় মহিলা লেখকের ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস।
‘চিঠির সঙ্গে তরুলতা গাছের পাতা ও একটা ছোট ফুল পাঠালাম।’
— ১২, মানিকতলা স্ট্রিটের বাড়িতে বসে ইংরেজিতে চিঠিটি লিখেছিলেন ১৮ বছরের তরুণী। আরও একটি চিঠিতে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে ওই তরুণী লিখেছিলেন, ‘‘হয়তো কোনও একদিন ফিরব। হয়তো আর কোনওদিনই ফেরা হবে না!’’
তখন কে জানত, বিভিন্ন সময়ে লেখা এই চিঠিগুলোই একসময় অমূল্য সম্পদ হয়ে যাবে। মিস মেরি মার্টিন আর ক্লারিস বাদেরকে লেখা তরুর ইংরেজি ও ফরাসি চিঠিগুলি ঐতিহাসিক সম্পদ।
তরু দত্তের চিঠির সংকলনও প্রকাশ পায়। চিঠিগুলো থেকে তৎকালীন জীবনযাত্রা, প্রকৃতিপ্রেম, মানবচেতনা বিষয়ে তাঁর ভাবনা জানা যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর লেখনীতে। মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়েও এক হাতে ফরাসি অন্য হাতে ইংরেজি সাহিত্যকে ছুঁয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ফরাসি কোমলতা ও ইংরেজি আভিজাত্য— এই তিন নিয়েই তরু দত্ত।

তরুর মৃত্যুর পর কলকাতার বাস উঠিয়ে যে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান গোবিন্দ চন্দ্র দত্ত, সে বাড়ি কেনেন জনৈক বসু পরিবার। সেই বিশাল বাড়ি, ক্যাসুরিনা গাছওয়ালা সেই বাগান আজ ১২এ, বি ও সি তিনটি আলাদা নম্বরে বিভক্ত। রমেশ দত্তের বাড়ি প্রোমোটারের হাতে পড়ে এখন মধ্যবিত্তের বাক্সবাড়ি। ১২বি ও ১২সি’র বাসিন্দারা এই বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণার দাবি জানিয়েও পরবর্তীকালে নিজেদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। ১২এ অংশের মালিকানা দেবকুমার বসু এবং তাঁর স্ত্রী শোভাবাজার রাজপরিবারের কন্যা শ্রীমতী অপর্ণা দেবীর। দত্ত পরিবারের ব্যবহৃত কাঠের সিঁড়িটি তাঁরা রেখে দিয়েছেন অবিকল।
ফরাসি ও ইংরেজিতে তরু দত্তের ব্যুৎপত্তি রীতিমতো বিস্ময়ের, বলছেন গবেষকেরা! মাইকেল মধুসূদন দত্ত যদি বিদেশি ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য বাঙালি হিসেবে অগ্রণী পুরুষ হন, মেয়েদের মধ্যে ছিলেন তরু। কিন্তু এত গুণে গুণান্বিতা হয়েও কেন তিনি উপেক্ষিতা? কেনই বা উনিশ শতকের বরণীয় সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয় না?
বেশ মনে আছে—
নারীশক্তির আরাধনার আবহাওয়ায় দেবীর বোধনের দিনে ‘বাংলার কিটস’— উপমহাদেশের বিস্মৃতপ্রায় প্রথম ফরাসি ও ইংরেজি নারী ঔপন্যাসিকের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের এই শ্রদ্ধা নিবেদনে এক বাঙালি নারী হিসেবে আমি গর্বিত অনুভব করেছিলাম।
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Wikipedia,
প্রকাশক, সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ। নানা ক্রিয়েটিভ কাজকর্মে জড়িয়ে থাকতে
ভালবাসেন, আর ভালবাসেন নিজস্ব লেখালিখি।
3 Responses
খুব সুন্দর লেখা ।
Fabulous take on the life and works of Dutta sisters.
খুব ভালো লেখা।
লেখককে অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
লেখার সঙ্গে ছবিগুলো প্রাসঙ্গিক ও একইসঙ্গে
অঙ্গসজ্জার উৎকর্ষ হিসেবে বিবেচ্য হবে।
কবি তরু দত্তর নাম শুনেছি ছোটবেলায় অনুবাদ কবিতার মাধ্যমে আমার স্কুল পাঠ্যে। কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানলাম এই লেখা পড়ে। এতবড় একজন বিদূষী মহাপ্রতিভাবান যিনি ফরাসী ও ইংরেজিতে সমান দক্ষ লেখক।
এত অল্প বয়সে কবি তরু দত্তর মৃত্যু হয় জেনে মনটা বিষাদ ভরে গেল। পোষাক, সৌন্দর্য ও সাহিত্যসাধনায় এমন নারী বিরল।
সত্যি তরু দত্ত বাংলার কিটস ছিলেন।