রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গন) শহর ছাড়িয়ে আরেকটু এগোলেই দৃশ্যপট বদলে বদলে যায়। এখন এই অঘ্রাণের রোদে পথের দুপাশে ধান শুকোতে দিয়েছে কারা যেন। কারও বা মাঠের ধান এখনও কাটা হয়নি। রোদ্দুরে সোনার অঙ্গ এলিয়ে পড়েছে সেসব ফসলের। সেসব খেত খামারের গায়ে গায়ে বড় বড় পুকুর, বিল আর কলাবাগান। ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস। হাঁস চরানো ছেলেরা সব গ্রিম ভাইদের রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসেছে যেন। টোকা মাথায় তারা গাছের ছায়ায় খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে হয়তো বা। এই শহরতলীর আগে আগেই কারখানা, গঞ্জ, ব্যস্ততা। দলে দলে মেয়েরা সেখানে টিফিন ক্যরিয়ার দুলিয়ে কাজে চলেছে। তাদের লঞ্জি (লুঙ্গি), তানাখা আর স্টিলের টিফিন বাটি– সব মিলিয়ে যেন আস্ত একখানা ছবি হয়ে উঠেছে সকালের আলোয়। এসবের বেশিরভাগই গার্মেন্টস কারখানা। ছেলেরা আছে কিন্তু এসব কারখানায় মেয়েরাই কাজ করে বেশি। অনেকটা চা-শ্রমিকদের মতো। নারীর শ্রমের এমন বর্গীকরণ আমার খুব চেনা, অন্তত এই উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি।
কারখানার ভোঁ পেরিয়ে নারী শ্রমিকদের চলমান কলোনি পেরিয়ে মাঠে ঘাটে দোকানে বাজারে পেট্রোলপাম্পে মেয়েদের দেখা পেলাম (women empowerment in Myanmar)। তারা সকাল থেকে বাজারে বসে, ইস্কুলে পড়াতে যায়, মুরগির মাংস বিক্কিরি করে, অফিসে যায়, পথে-ঘাটে বিবিধ শ্রমে তাদের অবাধ বিচরণ। এই ছবি কেবল শহরে নয়। গ্রাম মায়ানমারেও দেখি পথের ধারে কচি কচি বাঁশের ভিতরে মিষ্টি ভাত রান্না করে পসরা সাজিয়েছে তন্বী যুবতী। প্যাগোডার সামনে গোছা গোছা শালুক ফুলের পসরা নিয়ে বসে আছে। কেউ বা গেঁথে এনেছে দোলনচাঁপার মালা। কারো দোকানে বা ভুট্টা সেদ্ধ হচ্ছে। এইসব ভুট্টা, নাপ্পি আর মোহিঙ্গার গন্ধকে পিছনে ফেলে আমি গ্রাম দেশে পৌঁছে যেতে চাই। সেই যে ছবির মতো একখানা দেশ! ধানজমি আর সহজলভ্য শ্রমের বিনিময়ে যেখানে মানুষেরা মানুষের কলোনি গড়ে তুলেছিল সময়ে সময়ে। ইরাবতীর জল সেসব গল্প ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে হয়তো কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের কলোনির গল্প কি সহজে ভোলে মানুষ? ধান-চালের এমন গন্ধ আর কোথায়? সুয়েজ ক্যানেল দিয়ে সেসব রপ্তানির সুযোগ কি ছাড়ে কেউ? ছাড়ে না। তবে, নদী তার গতিপথ বদলায়। বার্মাও। মানুষেরা কিন্তু বদলায় না।

গৃহযুদ্ধ আর বিশ্ব-অর্থনীতির গল্পে তাই বার্মার মাটি জল আর চষা খেতেরও কিছু ভূমিকা থাকে। সেই ক্ষয়ভূমি ধরে ধরে পায়ের তলার শিকড় আলগা হয়ে যায় একদিন। নব্বইয়ের দশক পেরিয়েও গ্রাম জীবন তাই থিতু হতে পারে না। এমন মাটি, এমন জল, এমন বনজ কুসুম ফেলে মানুষেরা তাই ভিটে ছাড়া হয়। এই ধরুন না আমাদের নান খাম (Nang Kham)! অবশ্য শুধু নান খামই তো নয়, ছেলে মেয়ে বর নিয়ে কত কত মানুষ ভিটে ছাড়া হয়েছে সেই অস্থিরতার দিনে। সেসব একটু থিতিয়ে গেলে তারা ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু গৃহপালিত পশুরা কে কোথায় চলে গেছে কে জানে! চেনা জমির গন্ধ বদলে গেছে ততদিনে। মাঠে মাঠে পাহাড়ের সানুদেশে এখন কেবল পোস্ত চাষের রমরমা। কম চাষেও এতে লাভ বেশি। পাইকাররা বাড়ি এসে এইসব পোস্ত কিনে নিয়ে যায়। রেঙ্গুন শহরে ঘুরলে ফিরলে আপনি শুনতে পাবেন, বার্মা মুলুকে পোস্ত ভারী সস্তা। নান খামের মতো আরও কত কত মানুষেরা যে সারা সারা দিন ধরে পোস্ত খেতে কাজ করে! সেই কাকভোরে উঠে প্রার্থনা সেরে ঘরের কাজ, রান্না, কাঠকুটো জোগাড়। সেসব সামলে বাচ্চাদের ইস্কুলের ভাত, চাষাবাদ। দিনগত পাপক্ষয়ের শেষে পোস্ত গাছের পাতা রান্না করে খায় ওরা হামেশাই। পৃথিবীর মানুষ সেসব জানে আবার জানেও না। একা নান খাম তো নয়, কত কত নারীশ্রম পারিবারিক শ্রমের পরেও সারাটা দিন মাঠ জমি আর আবাদের গল্প বুনে যায় অক্লান্ত। ক্লান্তি কি আসে না? আসে তো। তবু, ক’জনই বা পারে এক বর্ষায় দু’বার ধান (double crop) রুইতে! কিন্তু কী আশ্চর্য দেখুন পারছে ওরা। মাঠে মাঠে কাজ করা বার্মার মেয়েরা সেসব করে দেখাচ্ছে।

মাঠ, বাড়ি, গার্মেন্টস কারখানায় মেয়েদের নইলে চলে না! তবু এখানেই কিন্তু শেষ নয়। ওই যে বললাম না, অঘ্রাণের দিনে রেঙ্গুন শহর ছাড়িয়ে চলেছি সেদিন, পথের পাশে পাশে সোনালি ধান বিছিয়ে দিয়েছে মানুষেরা। ধানকলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এদিক সেদিকে। ভাতের দেশে এ আর এমন আশ্চর্য্যি কী! আশ্চর্য্যি এই যে দ মু থু-এর (Daw Mu Htoo) মতো কেউ কেউ আস্ত একখানা মিল মালিক হয়ে উঠেছে ক্রমে দিনে। নারীশ্রমের গল্পে এও তো সেই গ্রিম ভাইদের গল্পের চেয়ে কম কিছু নয়! শ্রম বণ্টনের রাজনীতি পেরিয়ে এই নির্মাণকে বুঝতে হবে। ভোরবেলার কাঠকুড়ানি মেয়ের ভাত রেঁধে বেড়ে খাইয়ে মাঠে কাজ করার ইতিহাসকে বুঝতে না পারলে ওকে একজন সামান্য কৃষক বলে ভুল হতে পারে। নারীশ্রমের বহুস্বরকে চিনতে গেলে জানতে হবে ওদের সীমাবদ্ধ চাষজমির ভাগ, ঋণ ব্যবস্থার গাণিতিক মানচিত্র এবং পারিবারিক শ্রমের অসম বণ্টনকে। শান প্রভিন্সের পাহাড়, ধাপচাষের জমি দেখতে দেখতে এসবই মনে হয় কেবল। পাহাড়ের ধাপে ধাপে কী অপূর্ব চাষ! সে চাষের গল্প তো শুনলেন আপনারা।
পেট্রোল পাম্প থেকে মুদিখানায় এত এত মেয়ের শ্রমযাপন দেখতে ভালো লাগে আমার। এই ভালোলাগাকে পিছনে ফেলে দাঁড়িয়ে আছে দ মু থু-এর (Daw Mu Htoo) মতো মেয়েরা। তারা ধানকলের মালিক, তারা শ্রমবণ্টনের পিরামিডকে ছুঁয়েছে অবশেষে। লঞ্জি আর তানাখায় তার মেধা কিন্তু এতটুকু ঢাকা পড়েনি। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ও শিখেছে ফলন বৃদ্ধির উপায়। কত কত মানুষকে নিয়ে ওর কাজ। ওর ইচ্ছে ধান মজুত করার মতো একখানা বিরাট গুদামঘর যদি ও তৈরি করতে পারে! আশেপাশের গ্রাম থেকে ধান জোগাড় করে ও সেদিন মজুতদার হয়ে উঠবে হয়তো। আপনারা ভাবছেন, শেষমেশ একজন মহিলা মজুতদারের গল্প শোনালাম আপনাদের! নাহ, সেরকম ঠিক না। বিশ্বযুদ্ধের সেই চাল রপ্তানি থেকে শুরু করে সুয়েজ ক্যানেল দিয়ে ইউরোপে চাল পাঠানোর যে গল্প সে তো আমরা জানি। বাংলার ঘরে ঘরে মানুষের সৃষ্ট মন্বন্তরের গল্পও অজানা নয়। নারীর শরীর আর শ্রমকে সেই এক ছাঁচে দেখে দেখে ক্লান্তি আসে। সেসবকে পিছনে ফেলে দ মু থু’য়ের এই যাত্রা। চাষের শ্রমে মেয়েদের চাই, অথচ গ্রাম ভারতের চাষজমির গল্পে লাঙলের অধিকার মেয়েদের নেই। এবার আপনারাই বলুন, মু থু-এর এই ইচ্ছেকে ভালোবাসবো না? ওর শ্রম আর মেধায় যে ভাতের গন্ধ মিশে আছে মেয়েরা কি তার আঘ্রাণ নেবে কেবল ভাতের হাঁড়িতেই? তা তো হতে পারে না!
ছবি সৌজন্য: অমৃতা ভট্টাচার্য এবং Wikimedia Commons
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।