তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছে ৪০ ডিগ্রি। তেতেপুড়ে হাঁসফাঁস অবস্থা। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুর সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। দারুণ অগ্নিবাণে প্রাণ অতিষ্ঠ। প্রকৃতির রোষানলে চারদিক জ্বলছে। মুখে রুচি নেই। সর্বক্ষণ ক্লান্তিতে শরীর নুইয়ে পড়ছে। সেই অবাক জলপান নাটকের শেষ দৃশ্যের মত চোঁ করে এক গ্লাস জল পান করতে ইচ্ছে করে কিনা বলুন তো!! তখন তৃষিত প্রাণে একমাত্র ইনিই পরম বন্ধু যে শান্তি দেয়, যাকে দেখে মন ভাল হয়ে যায়। আমি বলছি শরবতের (Sharbat) কথা। বৈশাখী দহনে চোখের, মনের, জিভের, এবং শরীরের আরাম। শরবত পানের আগে তার সম্পর্কে দু-এক কথা জেনে নিই।
শরবত শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘সরবা’ বা ‘সারিবা’ (যা পান করা যায়) থেকে। যা পরে ১৬০০ শতাব্দীতে পারস্য দেশে ‘সেরবেট’ নামে এবং ক্রমশ তুরস্ক ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় মুঘলদের হাত ধরে শরবত ভারতে প্রবেশ করে গরমে আরামের পানীয় হিসেবে।
শরবত, যা মধ্যপ্রাচ্যে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। তখন মূলত বিভিন্ন ফলের রস বা ফুলের পাপড়ি অথবা মধু দিয়ে তৈরী হত এই পানীয়। মিষ্টি এবং ঠান্ডা জল মিশিয়ে পরিবেশন করা হত। শরবত শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘সরবা’ বা ‘সারিবা’ (যা পান করা যায়) থেকে। যা পরে ১৬০০ শতাব্দীতে পারস্য দেশে ‘সেরবেট’ নামে এবং ক্রমশ তুরস্ক ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় মুঘলদের হাত ধরে শরবত ভারতে প্রবেশ করে গরমে আরামের পানীয় হিসেবে। আমাদের দেশে পাঞ্জাবে ‘শরবত’ শব্দটি বলতে বোঝায় সকলের পানীয়। এমনকি ‘শরবত দা ভাল্লা’ মানে ‘সকলের মঙ্গল হোক’।
আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রদেশে সহজলভ্য স্থানীয় উপাদান দিয়ে সেখানকার শরবত তৈরী হত। যেমন, বাংলার কথায় আসা যাক। আম পোড়া শরবত; গুড়ের বাতাসা বা মৌরি মিছরির শরবত; নুন-চিনি দিয়ে পাতি, কাগজি বা গন্ধরাজ লেবুর শরবত; পাকা বেলের শরবত; তেঁতুল, গুড় দিয়ে তৈরী সাগরী; গন্ধরাজ লেবু দিয়ে শরবত – এসব বরাবরই জনপ্রিয়। গুড় এবং পাকা পুরনো তেঁতুলে আছে আয়রন যা খুব উপকারী, আর লেবুতে আছে সাইট্রিক অ্যাসিড। বাংলার বিখ্যাত গন্ধরাজ লেবুর সুবাস তো মনকাড়া।
মহারাষ্ট্র, গোয়া অর্থাৎ কোঙ্কন উপকূলে তীব্র তাপমাত্রার জন্য ওখানকার স্থানীয় কোকুমের শরবত খুব বিখ্যাত। বিট রুটের মতো সুন্দর রং। কোকুমে আছে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি। এছাড়া, দক্ষিণ ভারতে ‘পানাকাম’ পানীয়টি মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়। এর মধ্যে থাকে আদা, মধু, গোলমরিচ, গুড়, এলাচ ইত্যাদি এবং প্রত্যেকটারই নিজের অশেষ খাদ্যগুণ আছে।
এছাড়াও গুলকন্দের শরবত, আঞ্জিরের শরবত,কেশর, লস্যি, আম রস, পানপাতা শরবত; ‘মোহব্বত কা শরবত’, যা রোজ সিরাপ, দুধ, চিনি, ছোট ছোট তরমুজ টুকরো দিয়ে তৈরি হয়। উত্তর ভারতে খুব প্রচলিত এগুলো।
দিন পাল্টেছে। কালের নিয়মে আমরা এখন প্রচুর ফলের শরবতও বানাই ঘরে। যেমন, আঙুর, কমলালেবু, বেদানা, মোসাম্বি, মালবেরি, পুদিনা, স্ট্রবেরি ইত্যাদি। আজ রইল মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে সহজলভ্য উপাদান (Ingredients) দিয়ে তৈরি সম্পূর্ণ ঘরোয়া (Homemade) কিছু শরবতের রেসিপি (Sharbat Recipe)।
তরমুজের মোজিতো
তরমুজের রসের সাথে পুদিনা পাতা, সামান্য রক সল্ট, পাতি লেবুর রস, সামান্য চিনি বা সুগার সিরাপ মিশিয়ে তৈরি শরবত। চাইলে এর মধ্যে সোডা ওয়াটার মিশিয়ে নিতে পারেন। খুব রিফ্রেশিং একটি পানীয়। তরমুজে প্রায় ৯২ ভাগ জল। এছাড়া ফাইবার, ভাইটামিন এ ,সি,বি সিক্স এবং পটাশিয়াম থাকে।
আম পোড়ার শরবত গন্ধরাজ লেবু দিয়ে
এই রেসিপির মূল উপাদান কাঁচা আম, গন্ধরাজ লেবু, সামান্য আখের গুড় ও বিটনুন। কাঁচা আম পুড়িয়ে খোসা ছাড়িয়ে তাতে গুড় এবং অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে এই সুগন্ধি সুস্বাদু রুচি ফেরানোর মনকাড়া শরবতটি তৈরি হয়।
কালো আঙুরের শরবত
কালো আঙুরের গুণাবলী আমাদের সকলের জানা। এতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ভাইটামিন সি,কে আর অ্যান্টিঅক্সডেন্ট থাকে। এই শরবতটির জন্য আমি কালো আঙুরের সাথে মধু ব্যবহার করেছি। আপনি চাইলে সুগার সিরাপও ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও পাতিলেবুর রস ,পুদিনা পাতা ও রক সল্ট বা বিটনুন দিতে পারেন। জল বা সোডা ওয়াটারও ব্যবহার করতে পারেন।
সাগরা
সাগরা মূলত তৈরি হয় পুরোনো পাকা তেঁতুল,আখের গুড় ও গন্ধরাজ লেবু দিয়ে। তেঁতুল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি গুণ সম্পন্ন ,সাথে আছে প্রচুর পরিমাণ ভাইটামিন সি। পাকা তেঁতুল আর গুড়ে আয়রনও আছে ।
বেশ খানিকটা পাকা তেঁতুলের ক্বাথ নিয়ে তার সঙ্গে দেড় বা দ্বিগুণ আখের গুড় মিশিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে ভাল করে মেশাতে হবে। তারপর গন্ধরাজলেবু নিয়ে তার রস বের করে লেবুটাকে কেটে জলের মধ্যে ফেলে দিন। যদি খোসার জেস্ট বা কটা লেবু পাতা ছিঁড়ে জলে ফেলে রাখেন, তাহলে আরো সুবাস ছড়াবে। সামান্য সাদাজিরে, ধনে আর মৌরী একসঙ্গে রোস্ট করে, ভাজা গুঁড়ো মশলা বানিয়ে মিশিয়ে দিলে স্বাদে আলাদা মাত্রা এনে দেয়।
পাকা বেলের শরবত বা বেল পানা
এটি গরমে বেশ উপকারী একটি শরবত। বেল ফাটিয়ে বীজগুলো বের করে ভালো করে ক্বাথ বের করে জলে ভিজিয়ে শরবত বানাতে হয়। স্বাদ অনুযায়ী চিনি দেবেন, সামান্য নুন দেবেন। এটা দুধের সাথে মিশিয়েও বানাতে পারেন। খুবই উপকারী,পেটের জন্য ভাল। শরীর ঠাণ্ডা করে।
শরবত সামান্য ঠান্ডা পরিবেশন করলে খুব ভাল লাগবে। আরেকটা কথা,ফ্রিজের জল না খেয়ে যদি মাটির পাত্রে রেখে জল পান করেন তবে সেটা সবসময়ই ভাল।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Bahumatrik.com
আঁকা, ফুড আর্ট ও রান্নাবান্না সৌমীর প্যাশন। গাছপালা, প্রকৃতি ভালোবাসেন। যেকোনও সৃজনশীল কাজে আনন্দ পান। বিজ্ঞাপণ ও বিপণন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। লেখালেখি করতে পছন্দ করেন।