আসুন আজ আপনাদের আরেক অকালবোধন এর গল্প শোনাই। গল্প শুনে ভাল লাগলে দিব্যি ঘুরেও আসতে পারেন, কলকাতা থেকে খুব দূরে নয় কিন্তু। বেগমপুরী শাড়ি যেখানে হয়, আর তার কাছাকাছি খরসরাই, তাজপুর, এই তন্তুবায় অঞ্চলের কাছাকাছি বসবাসকারী অনেকের কাছে হয়তো পরিচিত এই শীতের উৎসব কিন্তু অন্য অনেকের কাছেই বাংলার তন্তুজীবি জেলার এই উল্টো অকাল বোধন উৎসব পালন সম্বন্ধে অতটা ধারণা নেই। যে যে জায়গায় তাঁত বস্ত্র উৎপাদন হয় কম বেশি সেই সব জায়গায় এই উৎসব নিয়ে আসে বর্ষসূচির আনন্দের জোয়ার। এবছরে তিথি অনুসারে এই পুজোর দিনটা পালন হবে — ২৩ শে পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে (বা ৮ই জানুয়ারি ২০২৫ এ) বুধবার। বিসর্জন পরের দিন বৃহস্পতি সন্ধ্যায়। এটাই বিধি, তবে এখন বেশ কিছু পুজো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, প্রচুর জনসমাগম হয়ে থাকে, সেখানে উদ্যক্তারা বাড়তি আরও দু একদিন ঠাকুর প্যান্ডেলে রেখে দেন। (Biswakarma Puja)

এখন তন্তুবায় অঞ্চলে তাই সাজ সাজ রব উঠেছে। মণ্ডপে মণ্ডপে সেরা হবার টান টান উত্তেজনা।
বছর পনেরো আগে এরকমই একবার এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে বিচারকের ভূমিকায় থাকার সুযোগ হয়েছিল,সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানাই, দুর্গা পুজোর মতনই শিরোপা দিতে হয় সেরা প্রতিমা, সেরা মণ্ডপ, সেরা আলোকসজ্জা আর সেরা আবহ তথা পরিমণ্ডলের। গাড়ি করে ঘুরে ঘুরে সব প্যান্ডেলে ও মূর্তি প্রদক্ষিণ করে সিদ্ধান্তে আসাটা বিচারক মণ্ডলীর পক্ষে সহজ ছিল না মোটেই– তুমুল প্রতিযোগিতা। পরের দিন ফলাফল ঘোষণা আর পুরস্কার বিতরণের সময়ে ছিল যথেষ্ট উত্তেজনা। তবে করোনা কাল (কোভিড – ১৯) এই পুজোর জাঁকজমকের উপরেও থাবা বসিয়েছিল। সেই সঙ্গে দীর্ঘকালীন তাঁতবস্ত্রের বাজারে মন্দা আর মাঝে মাঝে থাবা বসায় শীতকালীন নিম্নচাপের বৃষ্টি। গতবছরই এই অকাল বৃষ্টি, উৎসাহে ভাটা ফেলেছিল কিছুটা হলেও। তাই এই বছরে সুদে আসলে উশুল করতে বদ্ধকর এলাকাবাসীরা।

মা দুর্গার অকাল বোধন হয় আমরা সবাই জানি, তা বলে দেবকারিগর বাবা বিশ্বকর্মার ও অকাল বোধন?
একালের আশ্বিনের শারদীয় দুর্গা পুজোর রমরমা তে আমরা ভুলতেই বসেছি, বাসন্তী দুর্গাপুজো হল মূল দুর্গাপুজো, শরতে হয় অকাল বোধন। সুরথ রাজা আর সমাধি বৈশ্য বাসন্তী দুর্গা পুজোর সূচনা করেছিলেন। হৃতরাজ্য আর ব্যবসা পুনরুদ্ধারের জন্যে যথাক্রমে। পরবর্তীকালে রামচন্দ্র লঙ্কা জয় করে সীতা উদ্ধারের জন্যে অসময়ে করেছিলেন মা দুর্গার আরাধনা, অসময়ে শরৎকালে, তাই এই পুজো রামচন্দ্রের দেবীর আরাধনা কে অকালের বোধন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে এসেছে।। শরৎকালের পুজো তাই শারদীয় দুর্গাপুজো নামে জানি সবাই।
এবারে অনেককেই অবাক করে দিয়ে বলি তা হলে, বিশ্বকর্মার অকাল বোধনের কথা। অনেকেই গ্রামবাংলার এই পুজো, এই উৎসবের কথা হয়তো সে ভাবে জানেন না।

বিশ্বকর্মার অকাল বোধন হয় শীতকালে। আর হয় বেশ জাঁকজমক করেই। আমরা সবাই যে বিশ্বকর্মার আরধনার কথা জানি সেটা আদতে শারদীয় বিশ্বকর্মা পুজো।
ঘন শীতে পৌষ মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে এই পুজো হয়ে। নিয়ম মতন পরের দিন দশমীতে এই পুজোর বিসর্জন। কখনও কখনও আবার সেই দিনটা মাঘ মাসেও পড়ে, যেবারে দুর্গাপুজো অনেকটা পিছিয়ে যায়, তখন এই পুজোর তিথি ও পিছিয়ে যায়।
এখনকার সময়ের সব উৎসব কেই আমরা তবে পাঁজি বা শাস্ত্রর তোয়াক্ক নাো করে এই প্রতিমা মণ্ডপে থেকে যায় আরও ২-৪ দিন। এলাকার আবেগ, জনজোয়ার আর উৎসবের আনন্দের কথা ভেবে।

“ছোট বেলায় বিশ্বকর্মা পুজো বলতে আমরা তো এই পুজোকেই জানতাম। পরে বড় হয়ে বাইরে বের হযে— আস্তে আস্তে জানলাম কলকারখানার বিশ্বকর্মা পুজোর কথা। সেই সঙ্গে আরও জানলাম— ভাদ্র সংক্রান্তির শারদীয় পুজোটা-ই তো আসল, আর এই পৌষ মাসে আমাদেরটা (তাঁত শিল্পীদের) বাবা বিশ্বকর্মার অকাল বোধন…” এমন সহজ সরল স্বীকারোক্তি তন্তুজীবি অঞ্চলের মানুষদের।
কেন এই অকাল বোধন বিশ্বকর্মার? এই প্রসঙ্গে অঞ্চলের মানুষদের মত হল, শারদীয় দুর্গোৎসবের জন্যে তাঁতের শাড়ী বোনা আর বেচার একটা চাপ থাকে। তাই ভাদ্র সংক্রান্তির ওই মূল পুজোয় অংশ গ্রহণ সম্ভব হয়না তাঁতিদের। অন্যদিকে শীতের দিনে উত্তুরে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে তাঁতঘরে কাজ করা অসুবিধা, মনও চায়না বাইরের রোদ্দুর ছেড়ে তাঁতে বসতে। শীতে শাড়ীর চাহিদাও থাকে কম। তাই মনে হয় এই সময়ে দেবকারিগরের বোধন তাঁতিদের তরফে। দেবমূর্তির চার হাতের পরিবর্তে দুই হাত যেন যেন একজন তাঁত শিল্পীর প্রতিকী। এক হাতে তাঁতের মাকু, অন্য হাতে ঘুড়ি লাটাই। দেখলে মনে হবে, যেন দেবসেনাপতি কার্ত্তিক মূর্তি — যা শুধু ময়ূর ছাড়া।

অনেকদিন ধরেই কলকাতার খুব কাছাকাছি এই পুজোর ধুমধাম হয়ে আসছে — খরসরাই, ছোট তাজপুর আর বেগমপুরে। অনেকে খবর-ই রাখেন না। প্রতিবেশি এই তিনটি গ্রামে তন্তুজীবিদের বহুল বসবাস। সাধারণত যে রকম বিশ্বকর্মা মূর্তি দেখে থাকেন এখানে পার্থক্য রয়েছে জানিয়েছি — মূল বিশ্বকর্মার মূর্তি চতুর্ভুজ হয়। হাতে থাকে ছেনি, হাতুড়ি ইত্যাদি। দেবতার বাহন মূলত হস্তি হয়ে থাকে। এখানে ঘোটক। তাঁতের খটাখট শব্দের সঙ্গে যেন ঘোড়ার অশ্বখুরের ‘টগবগ টগবগ’ ধ্বনি মিলেমিশে একাকার। এও একটা প্রতীকি। তাই ঘোড়সওয়ার দ্বিভূজ বিশ্বকর্মা মূর্তি পূজিত হয়ে থাকে তাঁত শিল্পীদের পুজোয়। তবে কোনও কোনও মণ্ডপে চার হাতের মূর্তি দেখা যায়। এলাকার প্রায় অর্ধশত বারোয়ারি পুজোয় নজর কাড়ে চন্দননগরের আলোকসজ্জা। নজরকাড়া আলোকসজ্জার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। প্রায় ১০-১২ টা পুজো সাড়ম্বরে সুবর্ণ জয়ন্তীবর্ষ স্পর্শ বা অতিক্রম করেছে।

তন্তুবায় বিশ্বকর্মা পুজোর উৎসবে ঘুড়ি ওড়ানোর মেলার জন্যে জমকালো ভাবে যেন ঝলমল করত অতীতে — এই খরসরাই গ্রামের দক্ষিণজলায়। গ্রামের দক্ষিণে বলেই এমন নাম। মনুষ্য বসতি বেড়ে মাঠের এলাকা কমে যাওয়ার জন্যে এখন তার জৌলুস স্তিমিত হলেও কত কী যে বিক্রি-বাটা, ওই তাঁত পুজোর ঘুড়ি ওড়ানোর মেলায়, কী আর বলব! কত দূরের মানুষ আসত ঘুড়ি ওড়াতে আর মেলা দেখতে। এখন হয়, তবে হৃত গৌরবে।

দক্ষিণ জেলায় ওই মেলায় সরস্বতী নদীর কিনারে কেনাকাটার নানান সম্ভার। খাবারদাবার, খেলনা, মেয়েদের সাজার জিনিস, ঘরের ব্যবহার্যর জিনিস কত কী! গুড়কাঠি, কাঠিভাজা, ছোলার চাকতি গুড আর চিনির, জিলিপি, পাপড়, তিলেখাজা, নৌকো ভর্তি রসগোল্লা আর পান্তুয়া। ছোটোদের প্রিয় একটা কাই (গ্রেভি) মাখানো গোটা কষা ডিম। এখানে যে নদীর তীরে বারুণীঘাটা সেখানেই ভাসান। এই নিয়ে এক আখ্যান রয়েছে।

বিহারের বারৌনিতে এক যোগে গঙ্গাস্নানের জন্যে দুরের মানুষরা যেতেন পদব্রজে। এক পরিবারে সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর প্রসব বেদনা ওঠায় তাদের আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। তারা এখানেই থেকে যান সরাইখানায়। কর্তার মন খারাপ, পুণ্যস্নানে ব্যাঘাতের জন্যে। রাত্রিবেলা মা গঙ্গার দেখা পান স্বপ্নে— তিনি জানান, চিন্তা নেই। যোগের দিনে আমি ত্রিবেণী সঙ্গম থেকে চাঁদ সওদাগরের সপ্তগ্রামের সপ্তডিঙার পথ ধরে এখানে প্রবাহিত হব। তোরা স্নান করলেই সাঁকরাইল দিয়ে আবার মূল ধারা হয়ে যাব কপিলমুনির আশ্রমে গঙ্গাসাগরে। সেই পুণ্যস্নান-এর জন্যেই জায়গার নাম বারুণীঘাটা। আর পান্থশালার অন্য নাম সরাইখানা। খরসরাই নামটার মধ্যে যেন আভাস রয়েছে।

এখন থেকে ৬০-৬৫ বছর আগে যখন সাড়ম্বরে এই বারোয়ারী পুজো আর উৎসব ছিল না, তখন প্রতি বাড়ির তাঁতঘরে ঘরোয়া ভাবে শোলার ছোট ছোট মূর্তি দিয়ে পুজো হত। তাঁত পিছু ২ টো ছোট শোলার মূর্তি। এখন সেই প্রথা যদিও রয়েছে, তবে ছাপিয়ে গিয়েছে বারোয়ারীর জাঁকজমক। প্রচুর আত্মীয়রা আসেন। আসেন নানা জায়গার মানুষজন। মণ্ডপ আর মূর্তি ছাপিয়ে আলোক সজ্জা চমকিত করে। যদিও প্রতি বিভাগেই কয়েক বছর আগে পুরস্কার ঘোষণা করে আঙ্গিক আবহ সুস্থ রাখতে সাহায্য করেছিল। মান বেড়েছে সেই থেকেই। এই পুজোয় মোয়া আর তিলেখাজা — নানা ফল-পাকুড়ের সঙ্গে থাকবেই প্রসাদে। এটাই বৈশিষ্ট্য।

হাওড়া আর শিয়ালদহ থেকে ২৩ আর ৩০ কিলোমিটার দূরে যথাক্রমে বেগমপুরের অবস্থান কর্ড লাইনে। ডানকুনি জংশন ছুঁয়ে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোকাল ট্রেন রয়েছে হাওড়া থেকে। শিয়ালদহ থেকে মাত্র দুটো বারুইপাড়া লোকাল বেগমপুর গেলেও ডানকুনিতে ট্রেন বদল করেও যাওয়া চলে। হাওড়া থেকে বারুইপাড়া, চন্দনপুর, গুড়াপ, মসাগ্রাম আর বর্ধমান (ভায়া – কর্ড) লোকালে বেগমপুরে আসা যায়। এখানে থাকার জায়গার অভাবে বহিরাগতদের অসুবিধা। তাই উচিত হবে বিকেলের দিকে এসে টোটোর বা অটোর মত যান-বাহনের সাহায্য নিয়ে প্রধান প্রধান মণ্ডপগুলো চুক্তিতে ঘুরে ফেরা ঘণ্টাপ্রতি হিসেবে। খুব বেশি রাত না করাই শ্রেয় হাওড়াগামী ট্রেনে শীতের দিনে যাত্রী কম থাকে বলে।
প্রথম ছাপার অক্ষরে লেখা প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে। আপাতত এক কুড়ি গ্রন্থের প্রণেতা। বাংলা গ্রন্থ জগতে ভ্রমণ, রেল, রেল-ভ্রমণ, রহস্য-ভ্রমণ ও অরণ্য-ভ্রমণের ওপরে নজর কেড়েছেন । প্রণীত করেছেন ভ্রমণ কাব্যগ্রন্থও।