Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

চা-পানের জার্নাল

কুহকী

জানুয়ারি ১৫, ২০২৫

Kuhaki_Short Story_Tea_15.1
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

ট্রেনটা বর্ধমান ছাড়ল। এসি টু’টায়ার কামরায় আমরা মাত্র তিনজন। স্যার, মানে– বরেন মল্লিক, আমি– অর্থাৎ ওঁর সেক্রেটারি সুজয় মিত্র আর আমাদের সহযাত্রী এক তরুণী। চতুর্থ বার্থটি খালি। রাতের খাওয়ার পর, স্যার পাইপ স্মোক করতে বাথরুমের দিকে গেছেন। আমার আবার কবিতা লেখার একটা বাতিক আছে। এই ধরনের ট্রেন যাত্রায় আমায় ‘কবিতায় পেয়ে’ বসে। ওরকম নিরস এক বসের সঙ্গে দিনের বারো-তেরো ঘণ্টা কাটানোর পরে এটাই আমার একমাত্র বিনোদন। (Short Story)

আরও পড়ুন: ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা: অধ্যায় ছেচল্লিশ

এখনও বিয়ে-শাদি করিনি… বন্ধুরা তাই টিপ্পনি-মস্করা করে যে আমি প্রেমে তাড়িত হয়ে কবিতার আশ্রয় নিয়েছি। যাইহোক আজ আমার ঠিক কবিতা লেখার ভাব আসছিল না। উৎসাহের আশায় আড় চোখে আমার সহযাত্রিণীকে একবার নিরীক্ষণ করে নিলাম। দেখলাম এক মনে উনি ওকাকুরার বিখ্যাত বই “দা বুক অফ্‌ টি” পড়ছেন। বেশ আকর্ষণীয় ফিগার। (Short Story)

Kuhaki_Short Story_Tea_15.1

অনেকটা গজল গায়িকা পিনাজ মাসানির মতন দেখতে। মাথার চুল কোঁকড়ানো, কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। পরনে পেস্তা রঙের শিফন শাড়ি। মুখে ন্যুড মেক্‌-আপ, টিকোলো নাক, ঠোঁটে হাল্কা লিপ্‌-গ্লস, বাঁ গালে একটা তিল। খালি হাত। কোনও চুড়ি বা অন্য গয়নাগাটি নেই। শুধু ডান হাতে একটা ঘড়ি আর বাঁ কব্জিতে প্রজাপতি আঁকা ট্যাটু। শিড়দাঁড়া সোজা করে, একটা পায়ের উপর অন্য পা তুলে লম্বা সরু আঙুল গুলো দিয়ে একের পর এক পাতা উলটে এক নিমেষে বইটি পড়ে যাচ্ছেন। স্যার সিটে ফিরে ভদ্রমহিলাকে বইটি পড়তে দেখে অযাচিত ভাবে মন্তব্য করলেন– শুধু বই পড়ে কি চায়ের মাহাত্ম্য বোঝা যায়? ইউ নিড টু টেস্ট ইট টু এক্সপিরিয়েন্স ইট। (Short Story)

আরও পড়ুন: ম্যাথিউ ব্লেক এর উপন্যাস ‘অ্যানা ও’: ভাষান্তর- মোহনা মজুমদার

এই স্যারের এক দোষ। দার্জিলিং গ্রীন ভ্যালি টি এস্টেটের ম্যানাজিং ডাইরেক্টর হওয়ার সুবাদে ওঁর নাকটা একটু উঁচু। চায়ের ব্যাপারে যেন সবজান্তা। ভদ্রমহিলা বই নামিয়ে মুচকি হেসে বললেন– এ ব্যাপারে আমি একমত। টি টেস্টিং এই ইন্ডাস্ট্রির একটা অন্যতম গুরূত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে, সেই ব্যাপারে যে আমার কোনও জ্ঞান নেই, সেটা আপনি নিশ্চিত হলেন কীভাবে?
-সরি ম্যাডাম, কিন্তু কিছু জব প্রোফাইল আমার মতে খুবই জেন্ডার স্পেসিফিক্‌। সে আপনি আমাকে সেক্সিস্ট ভাবতে পারেন, কিন্তু তাতে সত্যিটা তো বদলে যাবে না। আসলে কী বলুন তো, এটা ঠিক রান্নাঘরে মা-মাসিদের মতো চামচে করে আলগোছে টেস্ট করার ব্যাপার নয়। তার চেয়ে অনেক গভীর, অনেক খুঁটিনাটি সংক্রান্ত ব্যাপার। যাঁরা টেস্ট করেন তাঁদেরকে টি সোমেলিয়ার বলে। ওয়াইন টেস্টিং যেমন একটা হাইলি-পেড প্রফেশন, তেমনই টি টেস্টিংও। ইট্‌ কল্‌স ফর মেনি স্যাক্রিফাইসেস। আর সমস্ত টি সোমেলিয়াররা কিন্তু পুরুষ। (Short Story)

-তাই কি? ভদ্রমহিলা উস্কে দেন যেন ।
-এক্সেপশন ডাজেন্ট ডিসপ্রুফ দা রুল। দু-একজন ব্যতিক্রমকে জেনেরালাইজ করা ঠিক নয়। স্যারও ছাড়ার পাত্র নন।
আমি ভদ্রমহিলার সাথে এই প্রথম কথা বলার সুযোগ পেলাম। আগ্‌ বাড়িয়ে বলি- পরিচয় করিয়ে দিই, উনি বরেন মল্লিক- দার্জিলিং গ্রীন ভ্যালি টি এস্টেটের ম্যানাজিং ডাইরেক্টর। আজ বত্রিশ বছর চায়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। আর আমি ওঁর সেক্রেটারি, সুজয় মিত্র। (Short Story)

আরও পড়ুন: শূন্যের মাঝার

স্যার একটা কপট গাম্ভীর্য্য আরোপিত করে গলা খাঁকরানি দিলেন।
ভদ্রমহিলা এবার বুকমার্ক দিয়ে বইটা বন্ধ করে নিজের কোলের উপর রাখলেন। আমার পরিচয়টাকে বিশেষ আমল না দিয়ে বরং স্যারের দিকে ফিরে বললেন –আমি চিনি আপনাকে। ইন্ডিয়া টুডে’তে আপনার সাক্ষাৎকারটা আমি পড়েছি। ছবি দেখেছি। আপনার স্টুডেন্ট লাইফ, পড়াশুনো, বড় হওয়া, কেরিয়ার অ্যাচিভমেন্ট সব কিছু ভেরি ইন্সপায়ারিং। শুধু টি ইন্ডাস্ট্রিকে আপনি ‘মেল-ওয়ার্ল্ড’ বলাতে আমার একটু আপত্তি লেগেছিল। (Short Story)

আই অ্যাম সরি টু হার্ট ইওর সেন্সেবিলিটিজ্‌ ম্যাডাম, কিন্তু আমি সোজা কথা স্পষ্ট করে বলা পছন্দ করি। ইন ফ্যাক্ট ঠোঁট-কাটা বলে আমার একটা বদনাম আছে। লাইক আই সেড, চা শিল্পটা ঠিক মা-মাসিদের রান্নাঘরের চা বানানো নয়।

ক্যামিলিয়া। ভদ্রমহিলা দু-হাত জুড়ে নমস্কার করেন।

সরি? স্যার আবেগে কথা বলছিলেন। একটু হক্‌চকিয়ে যান।

আমার নাম ক্যামিলিয়া… তাই বলছি, ম্যাডাম নয়, আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারেন। আপনার থেকে আমি বয়েসে অনেক ছোট। তবে অভিজ্ঞতা কম থাকলেও, আমি কিন্তু গুঁড়ো চায়ের গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারি কোনটা কী চা। বলতে পারেন এটা আমার একটা বিশেষ ক্ষমতা। (Short Story)

ভদ্রমহিলা বই নামিয়ে মুচকি হেসে বললেন– এ ব্যাপারে আমি একমত। টি টেস্টিং এই ইন্ডাস্ট্রির একটা অন্যতম গুরূত্বপূর্ণ অঙ্গ।

বটে!
বুঝলাম স্যারের আঁতে ঘা লেগেছে। স্যার অকপট বলে চললেন- টি সোমেলিয়াররাও কিন্তু চা তৈরির পরে তা টেস্ট করে, আগে নয়। আর আপনি গুঁড়ো চা শুঁকেই বলে দিতে পারেন কী চা! কেয়া বাত! আসলে কী বলুন তো, ঐ যে বললাম চা ভালোবেসে বা বই পড়ে তারিফ করা যায় কিন্তু কনোশিয়ার হওয়া যায় না। (Short Story)

আমার আন্ডারে গত বত্রিশ বছরে তিন জন তুখোড় টি সোমেলিয়ার কাজ করেছে। তিনজনেই নিজ প্রফেশনে প্রসিদ্ধ। ইন ফ্যাক্ট শেষের জন তো জাস্ট দু’সপ্তাহ আগে রিজাইন করে ব্রিটেনে বিরাট পে প্যাকেজ নিয়ে একটা টি কোম্পানি জয়েন করেছেন। ওঁর রিপ্লেসমেন্টও নেওয়া হয়নি এখনও। ছেলেটি এখনও আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।…
তারপর একটু থেমে স্যার আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সুরে যোগ করলেন
– আই নো আ থিং অর টু অ্যাবাউট মাই জব, মাই লেডি। তাই আপনার দাবী যে আপনি গুঁড়ো চায়ের গন্ধ শুঁকেই বলে দেবেন কোনটা কী চা, আই বেট ইয়ু ক্যান নট্‌… (Short Story)

আরও পড়ুন: আংরেজ বিবির অসম্পূর্ণ উপাখ্যান

সুযোগ থাকলে অবশ্যই বাজি লড়তাম।
মহিলাও নাছোড়বান্দা। ঠোঁটের কোণায় যেন একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি লেগে আছে ।

সুযোগ নেই সেটা কে বলল ম্যাডাম। কত টাকার বেট লড়বেন ভেবে দেখুন। আমি কিন্তু সঙ্গে করে সবসময় পাঁচ-ছটা ছোট চায়ের কৌটো ক্যারি করি… হেঃ হেঃ, এটা বোধহয় আপনি ভাবতে পারেননি।
– স্যার তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন। (Short Story)

বেশ তো, বার করুন না… এতটা সময়ের ট্রেন জার্নি, এই মজার খেলাটা খেলাই যাক্‌ না।
দেখলাম স্যারের ভ্রূ’দুটি সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়ে গেছে। অর্থাৎ এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিটা ওঁর একদম পছন্দ হয়নি। একটা গোটা এস্টেটের কত কর্মীর দন্ডমুন্ডের কর্তা আমাদের বরেন মল্লিক। ইগো তো একটা আছেই। তার উপর তাঁরই মূল পারদর্শিতার জায়গায় কেউ এসে এরকম চালিয়াতি করে যাবে সেটা কি বরদাস্ত করা যায়? স্যার হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন – কী যেন নাম বললেন আপনার, ক্যামেলিয়া? ভেরি ফানি, চা গাছের সাইন্টিফিক্‌ নেম ধার করে আপনার নাম, অ্যাঁ? (Short Story)

আরও পড়ুন: মহাকাব্য থেকে

হাঃ হাঃ হাঃ… জানেন নিশ্চয়ই চা গাছের সাইন্টিফিক্‌ নাম ক্যামিলিয়া সাইনেন্সিস… বেশ বেশ, তা নামটা আবার আপনার ছদ্মনাম গোছের কিছু নয় তো?
মেয়েটি শুধু হাসল। আর আমার মনে পড়ে গেল রবিঠাকুরের কবিতা “ক্যামিলিয়া”
 “মনে মনে ভাবি, আর-কোনও সম্বন্ধ না থাক্‌,
         ও তো আমার সহযাত্রিণী।
      নির্মল বুদ্ধির চেহারা
             ঝক্‌ঝক্‌ করছে যেন।
         সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
                 উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে ভাবি একটা কোনও সংকট দেখা দেয় না কেন,
             উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি–
                 রাস্তার মধ্যে একটা কোনও উৎপাত,
                     কোনও-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা।”

আরও পড়ুন: নিজস্ব সংবাদদাতা

এক মিনিটের জন্য স্যারকেই মনে হল সেই গুন্ডা। তারপর নিজের ঘোর ভাঙিয়ে আমি বাঙ্কে বিছানা করতে উঠতে গেলাম। হঠাৎ স্যার হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন
– সুজয়, আমার কৌটো গুলো বার করো তো। ম্যাডামকে আমাদের দুনিয়ার সাথে একটু পরিচয় করানো যাক্‌। শুধু ওকাকুরার থিয়োরিতে কী হবে, একটু প্র্যাকটিক্যাল হয়ে যাক্‌। তবে ম্যাডাম, ফ্রীতে তো হবে না। বত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার তো একটা দাম আছে, নাকি? অতএব বাজি আপনাকে লড়তেই হবে। আমি হারলে আপনাকে আমি দু’হাজার টাকা দেব। কিন্তু আপনি গন্ধ শুঁকে বলতে না পারলে, আপনাকেও ঐ একই জরিমানা দিতে হবে। কি, রাজি তো? (Short Story)

বেশ, বার করুন। তবে আপনি হেরে গেলে আপনাকে টাকাও দিতে হবে না। বরং আপনার ঐ বাহারী ক্লে স্মোকিং পাইপটি আমার চাই।
আবাহাওয়া হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ধর্মতলার মোড় থেকে কেনা পাইপটা বড়জোর তিনশো টাকা দাম হবে। কিন্তু স্যারের খুব প্রিয়। যেন ওঁর পদমর্যাদার প্রতিক। স্যারের হাতে তখনও পাইপটা ধরা। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়ালটা শক্ত করে আছেন, মাথার পাশে রগ্‌ দুটি দপ্‌দপ্‌ করছে। আমি দুজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি এমন সময় স্যার বিরক্ত হয়ে গর্জে উঠল। (Short Story)

Kuhaki_Short Story_Tea_15.1

– কি জেগে, জেগে ঘুমোচ্ছ নাকি? কৌটো গুলো বার করতে বললাম না?
ট্রেন পরের স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে। এক স্টেশন হকার ‘চায়ে-চায়ে’ বলে কামরায় কামরায় উঁকি দিচ্ছিল। স্যার প্রায় খিঁচিয়ে উঠল
– এগুলো চা, না গরম জল? এসি কামরায় কে যে এগুলোকে এরকম উঠতে দেয়।
লোকটাও কীসব গজ্‌গজ্‌ করতে করতে এগিয়ে গেল। স্যার পিছু হটবেন না আমি জানি। তাই অগত্যা কৌটোগুলো বার করলাম। ছ’টা আলাদা আলাদা রঙের একই রকম দেখতে ছোটো কৌটো। কোনওটার লেবেল নেই। টেবিলের উপর এক এক করে সাজিয়ে রাখলাম। স্যার জামার হাতা গুটিয়ে নিচ্ছেন। লক্ষ্য করলাম, ক্যামিলিয়া মুচকি হেসে, বইটা কোল থেকে নামিয়ে পাশে রেখে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছেন। সম্মুখ সমরে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ। শুরু হল খেলা।
স্যার প্রথম কৌটোটা খুললেন। (Short Story)

স্যার জামার হাতা গুটিয়ে নিচ্ছেন। লক্ষ্য করলাম, ক্যামিলিয়া মুচকি হেসে, বইটা কোল থেকে নামিয়ে পাশে রেখে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছেন।

তাহলে সহজ দিয়েই শুরু করা যাক্‌ কী বলেন? বলুন তো এটা কোন চা?
ক্যামিলিয়া, চোখ বন্ধ করে, কৌটোটা হাতে নিয়ে লম্বা একটা ঘ্রান নিলেন।
– উঁহু, খুব একটা সহজ নয়, মিঃ মল্লিক… এটা হোয়াইট টি অথবা গ্রীন টি যেকোনও একটা হতেই পারতো… দুটোর ফ্লেভারই একই রকমের, খুব কাছাকাছি। তবে হোয়াইট টি টা গ্রীন টির মতন অতটা সেঁকা হয় না, অনেক কম অক্সিডাইজ্‌ড। চায়ের পাতাগুলো অনেক বড় আর ড্রাই। অতএব এটা হোয়াইট টি। কি ঠিক বললাম, মিঃ মল্লিক? (Short Story)

স্যারের চশমাটা নাকের উপর ঝুলে পড়েছে দেখলাম। বুঝলাম ক্যামিলিয়া একশ শতাংশ সঠিক। আমি অবিশ্যি অভিভূত হয়ে ক্যামিলিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ঐ যে একটা কথা আছে না, রূপে সরস্বতী, গুণে লক্ষ্মী। আহা কী পার্সোনালিটি। আমি জন্ম-হাবা, মুখটাও বোধহয় অবাক বিষ্ময়ে ও তারিফে হাঁ হয়ে গিয়েছিল। সম্বিত ফিরে পেলাম স্যারের গর্জনে।
-হাঁ করে গিলছ কী, পরের কৌটাটা খোলো, ম্যাডামকে প্রথম ধাপটা ওত্‌রাতে এন্‌কারেজ করলাম বলে আবার ওঁর ওভার কনফিডেন্স না হয়ে যায়। ঐ সবুজ রঙের কৌটোটা এবার খোলো। (Short Story)

আরও পড়ুন: জোনাসকে লেখা চিঠি

কথাটা শুনে ক্যামিলিয়া এই প্রথম আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি ওরকম ক্যাবলা হয়ে তাকিয়েছিলাম খেয়াল হওয়াতে ভীষণ লজ্জিত বোধ করলাম। একই সঙ্গে খুব রাগ হল স্যারের উপর। আবার কবিগুরুর “ক্যামিলিয়া” কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে গেল –

“কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
         ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
      কোনও ছুতো পাই নে, হাত নিশ্‌পিশ্‌ করে।”

রাগ সংবরণ করে সবুজ কৌটোটা খুললাম। স্যার গলা খাঁকরানি দিলেন
– তা ম্যাডাম, আপনার ওকাকুরার বইটি কি এইটার সাথে পরিচয় করিয়েছে এখনও অবধি?
ক্যামিলিয়া আবার চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। চোখ খুলে কিছুক্ষণ যেন কী ভাবলেন। আমরা সবাই চুপ। ট্রেন চলার আওয়াজটা শুধু যেন অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে। স্যার দেখলাম তাঁর পাইপটা শক্ত করে ধরে আছেন। এসি কামরাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এটা অবিশ্যি সত্যি ওকাকুরার বইয়ে থাকতেই পারে। পড়াটা শেষ হয়নি এখনও। কারণ এটা জাপানি গ্রীন টি। সোজা ভাষায় বললে

– মাচা টিও বলা যায়। এই চা গাছটি ছায়ায় থাকে, চা গাছের পাতা থেকে ম্যাটারটা বার করা হয়। এটিকে বলে টেঞ্চা। তারপর তাকে আরও গুঁড়ো করা হয়। কি স্যার, ঠিক বলছি?
স্যার গম্ভীর। বাকরুদ্ধ। আমার মনে মনে বেশ আনন্দ হচ্ছিল স্যারের আসন্ন পরাজয় দেখে। শেষে আমিই মৌনতা ভঙ্গ করলাম। বললাম

– পরেরটা খুলি স্যার, এইবার এই বাদামি রঙেরটা, কি বলেন?
স্যার হাতের ইশারায় সম্মতি দিলেন। ক্যামেলিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আবার স্মিত হাসলেন। শিহরিত হলাম যেন। কম্পিত হাতে বাদামি কৌটোটা খুললাম। মনে কোথাও আশঙ্কা এবার যদি না পারে। তাহলে আর আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। কিছু পরেই মনের ভুল ভেঙ্গে গেল। কবির একই কবিতার লাইন উদৃত করেই বলি – (Short Story)

Kuhaki_Short Story_Tea_15.1

“ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে,
             আমাকে কোনও দরকারই ছিল না।” একে একে উলং চা, পুয়ের চা, হার্বাল চা সব নির্ভুল ভাবে নির্ধারণ করে ফেললেন। আর শুধু নির্ধারণ নয়, সঙ্গে দারুণ সব ট্রিভিয়া। ‘উলং চা প্রধানত চারটে এলাকায় হয়। অনেকে একে শুধু আংশিকভাবে অক্সিডাইজ্‌ড চা হিসেবে চেনে, কিন্তু এর আরও বিশেষত্ব আছে।’ আবার কখনও বললেন
– ‘আপনার সংগ্রহটিকে তারিফ না করে পারা যাচ্ছে না। পুয়ের চায়ের স্যাম্পেলও আছে! এ তো আপনি চীনের উনান প্রদেশেই প্রধানত পাবেন।’
অত্যাশ্চর্য্য ব্যাপার। স্যারও ঘোর বিস্ময়ে অস্ফুটে শুধু বলে উঠলেন
– বাঃ। (Short Story)

জানি না আনন্দে আমার বুকটা কেন ভরে উঠল। শেষ কৌটোটা খোলার সময় দেখলাম স্যার নিজের পাইপটাকে হাল্কা করে পরম মমতায় হাত বোলাচ্ছেন। এতদিনের সঙ্গী। কষ্ট তো হওয়ারই কথা।
ক্যামিলিয়া শেষ কৌটোটা দেখে বললেন
– এই যে ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকেন্ড ফ্লাশ নামগুলো এখন কলকাতাবাসীরা সবাই জানে, এটার পেছনে কিন্তু একজন মহিলার অবদান আছে। তাঁর নাম ডলি রায়। ভারতের অন্যতম প্রথম মহিলা টি সোমেলিয়ার, তিনিই প্রথম কলকাতায় ‘টি-বার’ খোলেন। আর এখন চা নিয়ে কতরকম এক্সপিরিমেন্টেশন হচ্ছে। শুধু চা গাছে থেকে নয়। (Short Story)

‘আপনার সংগ্রহটিকে তারিফ না করে পারা যাচ্ছে না। পুয়ের চায়ের স্যাম্পেলও আছে! এ তো আপনি চীনের উনান প্রদেশেই প্রধানত পাবেন।’

যেমন হিবিসকাস টি খুব স্বাস্থকর, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। আমার নিজস্ব ফেবারিট অবিশ্যি ক্যামোমিল চা। সুন্দর সাদা ফুলের থেকে তৈরি মেয়েদের শরীরের জন্য খুব উপকারি । আমার নামের সঙ্গেও মিল আছে, তাই না?
– ক্যামিলিয়া হেসে ওঠেন। দাঁতগুলো যেন মুক্তো দিয়ে বাঁধানো। আমি অভিভূত। আমার হলদেটে দাঁতগুলিও বোধহয় প্রকট হয়ে পড়েছিল। সম্বিত পেলাম সুরেলা কণ্ঠে
– এটা অবিশ্যি সোজা। এটা আর্ল গ্রে টি। দাঁতের ক্যাভিটি উপশমে খুব উপকারি।
শুনেই মুখটা বন্ধ করে নিলাম। ক্যামিলিয়া স্যারের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন
– আর্ল গ্রে মুড চাঙ্গা করতেও খুব ভাল কিন্তু।
স্যার কোনও কথা না বলে হাতে ধরা পাইপটা বাড়িয়ে দিলেন। স্যার কেমন যেন চুপসে গেছেন। আমারও এবার একটু খারাপ লাগছিল। (Short Story)

Kuhaki_Short Story_Tea_15.1

ক্যামেলিয়া হেসে বললেন
– ওটা রেখে দিন। লাগবে না। আমার নাম আসলে কমলা। আমিও একজন টি সোমেলিয়ার। এ ক্ষেত্রে প্রথাগত ভাবে টি টেস্টিঙের সুযোগ না পেলেও, গন্ধ শুঁকে বলে দেওয়া আমার পক্ষে বিশেষ কষ্টকর নয়। আর ইন ফ্যাক্ট দার্জিলিং গ্রীন ভ্যালি টি এস্টেটের খালি টি সোমেলিয়ার পোস্টটা ‘জব ভ্যাকান্সিতে’ দেখে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। ইন্টারভিউ দিতেই যাচ্ছিলাম। ঘটনাচক্রে ট্রেনে ওঠার সময় রিজারভেশন চার্ট দেখতে গিয়ে আপনার নাম দেখে প্রথম সন্দেহ হয়। আপনাকে দেখেই চিনতে পারি। বুঝি আপনিও কাজের জায়গায় ফিরছেন। তারপরের ঘটনাগুলো একের পর এমন ঘটে গেল, আসল পরিচয়টা আর দিয়ে ওঠা হল না। আমাকে মাফ করবেন।
স্যার এক গাল হেসে পাইপটা ফেরত নিয়ে বললেন
– ও তাই নাকি? তা, তোমার ইন্টারভিউটা ট্রেনেই নেওয়া হয়ে গেল, কী বলো? (Short Story)

পাশ না ফেল? ক্যামেলিয়া ওরফে কমলা সরল ভাবে প্রশ্ন করলেন।

হান্ড্রেড পার্সেন্ট পাশ। কবে জয়েন করছ? সুজয় তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে ।
আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলাম। ট্রেন তখন সবে বোলপুর ছাড়িয়েছে। (Short Story)

অলংকরণ: আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়

Kuhoki alias Souvik Maiti

‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এই নামে লেখক এর আগে প্রকাশ করেছেন 'একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প' বইটি যা পাঠকমহলে যথেষ্ঠ প্রশংসা লাভ করেছে । এছাড়াও দুই বাংলার লেখকদের নিয়ে অভিযান পাবলিশারের 'থ্রীলার অভিযান' সংখাতেও কুহকীর লেখা স্থান পেয়েছে । নবকল্লোল, আনন্দমেলা ও অন্যান্য পত্রিকাতেও গল্প লিখছেন। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।

Picture of কুহকী

কুহকী

‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এই নামে লেখক এর আগে প্রকাশ করেছেন 'একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প' বইটি যা পাঠকমহলে যথেষ্ঠ প্রশংসা লাভ করেছে । এছাড়াও দুই বাংলার লেখকদের নিয়ে অভিযান পাবলিশারের 'থ্রীলার অভিযান' সংখাতেও কুহকীর লেখা স্থান পেয়েছে । নবকল্লোল, আনন্দমেলা ও অন্যান্য পত্রিকাতেও গল্প লিখছেন। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।
Picture of কুহকী

কুহকী

‘কুহকী’ তাঁর ছদ্মনাম। এই নামে লেখক এর আগে প্রকাশ করেছেন 'একলব্য অতঃপর ও অন্যান্য গল্প' বইটি যা পাঠকমহলে যথেষ্ঠ প্রশংসা লাভ করেছে । এছাড়াও দুই বাংলার লেখকদের নিয়ে অভিযান পাবলিশারের 'থ্রীলার অভিযান' সংখাতেও কুহকীর লেখা স্থান পেয়েছে । নবকল্লোল, আনন্দমেলা ও অন্যান্য পত্রিকাতেও গল্প লিখছেন। কুহকীর জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। আইআইটি থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পেশা হলেও দেশবিদেশের সিনেমার বিশেষ অনুরাগী। নেশা, সাহিত্যচর্চা ও ছবি আঁকা।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com