(Rajshekhar Basu)
একটিমাত্র ছোটগল্প নিয়ে একটি আস্ত বই। বই না বলে অবশ্য গ্রন্থমালা বলাই ভাল। নাম ছোটোগল্প। প্রকাশিত হত বাংলা সাহিত্যের সেই বহু বিখ্যাত বাড়িটি থেকে। কবিতাভবন। ঠিকানা, ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। সম্পাদক ও প্রকাশক প্রতিভা বসু। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ উদ্যোগ রীতিমতো ঐতিহাসিক হয়ে উঠল যখন প্রকাশিত হল এ গ্রন্থমালার ২৫ নম্বর বইটি, গামানুষ জাতির কথা। লেখক রাজশেখর বসু, পঁয়ষট্টি বছর আগের এক এপ্রিলে যাঁর মৃত্যু হয়েছিল। হ্যাঁ, রাজশেখর বসুই, পরশুরাম নন। (Rajshekhar Basu)
ছোটগল্প রাজশেখর বসু লিখতেন পরশুরাম নামে। একশো দুই বছর আগে সেই ১৯২৩-এ ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ দিয়ে শুরু।
ছোটগল্প রাজশেখর বসু লিখতেন পরশুরাম নামে। একশো দুই বছর আগে সেই ১৯২৩-এ ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ দিয়ে শুরু। তার বছরখানেক পরে প্রকাশিত হল গড্ডলিকা, প্রথম ছোটগল্পের বই। তারপরে কজ্জলী, হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প। পরবর্তীতে আট বছর ছোটগল্পের পরশুরাম উধাও। তখন রাজশেখর বসু লঘুগুরু প্রবন্ধাবলী লিখছেন, অনুবাদ করছেন কালিদাসের মেঘদূত আর বিশ্বভারতী-র বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ গ্রন্থমালার জন্য লিখছেন ভারতের খনিজ আর কুটীর শিল্প নিয়ে। (Rajshekhar Basu)
আরও পড়ুন: সন্জীদা খাতুন (১৯৩৩-২০২৫): সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে
আশি বছর আগে, ডিসেম্বর ১৯৪৫-এ আরও একবার ফিরে এলেন ছোটগল্পে। কিন্তু পরশুরাম নন, রাজশেখর বসু নামেই। সে বছরই শেষ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ৩০ এপ্রিল আত্মহত্যা করেছেন হিটলার। আর এই বিশ্ব-পরিস্থিতি এমনই প্রভাবিত করছে রাজশেখর বসুকে যে হাসির গল্পের পরশুরাম-এর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন তিনি, লিখছেন গামানুষ জাতির কথা, স্বনামে। (Rajshekhar Basu)

গামানুষ কারা? রাজশেখর লিখছেন—
‘এই নবাগত অলাঙ্গুল দ্বিপাদচারী প্রতিভাবান প্রাণীদের ইঁদুর বলে অপমান করতে চাই না, তা ছাড়া বার বার চন্দ্রবিন্দু দিলে ছাপাখানার উপর জুলুম হবে। এদের মানুষ বলেই গণ্য করা উচিত মনে করি। আমাদের মতন প্রাচীন মানুষের সঙ্গে প্রভেদ বোঝবার জন্য এই গামা-রশ্মির বরপুত্রগণকে ‘গামানুষ’ বলব।’ (Rajshekhar Basu)
আসলে এ গল্প আক্ষরিক অর্থেই সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা। গল্পের ঘটনার সময় যা তার প্রায় তিরিশ বছর আগে পৃথিবী থেকে মানবজাতি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কী ভাবে? রাজশেখর লিখছেন—
‘বড় বড় রাষ্ট্রের যাঁরা প্রভু তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য অনেক দিন থেকেই চলছিল। ক্রমশঃ তা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় দাঁড়াল যে মিটমাটের আশা আর রইল না। সকলেই নিজের নিজের ভাষায় দ্বিজেন্দ্রলালের এই গানটি ন্যাশনাল অ্যানথেম রূপে গাইতে লাগলেন— ‘আমরা ইরান দেশের কাজী, যে বেটা বলিবে তা না না না সে বেটা বড়ই পাজী।’ (Rajshekhar Basu)
গল্পের ঘটনার সময় যা তার প্রায় তিরিশ বছর আগে পৃথিবী থেকে মানবজাতি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
অবশেষে যখন কর্তারা স্বপক্ষের জ্ঞানী-গুণীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে নিঃসন্দেহ হলেন যে বজ্জাত বিপক্ষ গোষ্ঠীকে একেবারে নির্মূল করতে না পারলে বেঁচে সুখ নেই তখন তাঁরা পরস্পরের প্রতি অ্যানাইহিলিয়াম বোমা ছাড়লেন। বিজ্ঞানের এই নবতম অবদানের তুলনায় সেকেলে ইউরেনিয়ম বোমা তুলো-ভরা বালিশ মাত্র। প্রত্যেক রাষ্ট্রের বোমা-বিশারদগণ আশা করেছিলেন যে অপরাপর পক্ষের যোগাড় শেষ হবার আগেই তাঁরা কাজ সাবাড় করবেন। কিন্তু দুর্দৈবক্রমে সকলেরই আয়োজন শেষ হয়েছিল এবং তাঁরা গুপ্তচরের মারফত পরস্পরের মতলব টের পেয়ে একই দিনে একই শুভলগ্নে ব্রহ্মাস্ত্র মোচন করলেন। সভ্য-অর্ধসভ্য-অসভ্য কোনও দেশ নিস্তার পেলে না। সমগ্র মানবজাতি, তার সমস্ত কীর্তি, পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ গাছপালা, মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হল।’ (Rajshekhar Basu)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটে যাওয়া প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু গভীরভাবে বিচলিত করেছিল রাজশেখর বসুকে। তার ছাপ এই ছোটগল্পের সর্বত্র। কিন্তু মানুষের মৃত্যু হলে তবুও গামানুষ থেকে যায়। তারা সব মূষিক-মানুষ। গামা-রশ্মির প্রভাবে তাদের মনুষ্য-চেহারা প্রাপ্তি…
‘কিন্তু প্রাণ বড় কঠিন পদার্থ, তার জের মেটে না। সাগরগর্ভে পর্বতকন্দরে জনহীন দ্বীপে এবং অন্যান্য কয়েকটি দুষ্প্রবেশ্য স্থানে কিছু উদ্ভিদ আর ইতর প্রাণী বেঁচে রইল। তাদের বিস্তারিত বিবরণে আমাদের দরকার নেই, যাদের নিয়ে এই ইতিহাস তাদের কথাই বলছি। লন্ডন প্যারিস নিউইয়র্ক পিকিং কলকাতা প্রভৃতি বড় বড় শহরে রাস্তার নীচে যে গভীর ড্রেন ছিল তাতে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর বাস করত। তাদের বেশীর ভাগই বোমার তেজে বিলীন হল কিন্তু কতকগুলি তরুণ আর তরুণী ইঁদুর দৈবক্রমে বেঁচে গেল। শুধু বাঁচা নয়, বোমা থেকে নির্গত গামা-রশ্মির প্রভাবে তাদের জাতিগত লক্ষণের আশ্চর্য পরিবর্তন হল, জীববিজ্ঞানীর যাকে বলে মিউটেশন। (Rajshekhar Basu)
আরও পড়ুন: ‘রায় বাহাদুর’ মিত্রমশাই
(Rajshekhar Basu) কয়েক পুরুষের মধ্যেই তাদের লোম আর ল্যাজ খসে গেল, সামনের দুই পা হাতের মতন হল, পিছনের পা এত মজবুত হল যে তারা খাড়া হয়ে দাঁড়াতে আর চলতে শিখল, মস্তিষ্ক মস্ত হল, কণ্ঠে তীক্ষ্ণ কিচকিচ ধ্বনির পরিবর্তে সুস্পষ্ট ভাষা ফুটে উঠল, এক কথায় তারা মানুষের সমস্ত লক্ষণ পেলে। কর্ণ যেমন সূর্যের বরে সহজাত কুণ্ডল আর কবচ নিয়ে জন্মেছিলেন, এরা তেমনি গামা-রশ্মির প্রভাবে সহজাত প্রখর বুদ্ধি এবং ত্বরিত উন্নতির সম্ভাবনা নিয়ে ধরাতলে আবির্ভূত হল। এক বিষয়ে ইঁদুর জাতি আগে থেকেই মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল—তাদের বংশ-বৃদ্ধি অতি দ্রুত। এখন এই শক্তি আরও বেড়ে গেল।’

তিরিশ বছরেই গামানুষেরা মানুষের চেয়েও ঢের বেশি উন্নতি করল। তারপরে, বার বার মারাত্মক সংঘর্ষের পর বিভিন্ন দেশের দূরদর্শী গামানুষদের মাথায় এই সুবুদ্ধি এল— ঝগড়ার দরকার কী, আমরা সকলে একমত হয়ে কি শান্তিতে থাকতে পারি না? আমাদের বর্তমান সভ্যতার তুলনা নেই, আমরা বিশ্বের বহু রহস্য ভেদ করছি, প্রচণ্ড প্রাকৃতিক শক্তিকে আয়ত্ত করে কাজে লাগিয়েছি, শারীরিক ও সামাজিক বহু ব্যাধির উচ্ছেদ করেছি, দর্শন ও নীতিশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান লাভ করেছি। আমাদের রাষ্ট্রনেতা ও মহা মহা জ্ঞানীরা যদি একযোগে চেষ্টা করেন তবে বিভিন্ন জাতির স্বার্থবুদ্ধির সমন্বয় অবশ্যই হবে। তাই জনহিতৈষী পণ্ডিতগণের নির্বন্ধে রাষ্ট্রপতিগণ এক মহতী সভার আয়োজন করলেন। সেই সভার গল্পই এই গামানুষ জাতির কথা। পরশুরামের নির্মল হাসি এখানে নেই। বরং এক তিক্ত বিষাদ যেন ছেয়ে আছে এ গল্পে। (Rajshekhar Basu)
এক বিষয়ে ইঁদুর জাতি আগে থেকেই মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল—তাদের বংশ-বৃদ্ধি অতি দ্রুত। এখন এই শক্তি আরও বেড়ে গেল।
আচার্য ব্যোমবজ্র দর্শনবিজ্ঞানশাস্ত্রী এখানে যে বিশ্বব্যাপক শান্তিস্থাপক বোমাটি আবিষ্কার করেছেন তা থেকে ‘যে আকস্মিক রশ্মি বার হয় তা কস্মিক রশ্মির চেয়ে হাজার গুণ সূক্ষ্ম। তার স্পর্শে চিত্তশুদ্ধি, কাম, ক্রোধ লোভাদির উচ্ছেদ এবং আত্মার বন্ধনমুক্তি হয়।’ সে বোমা সদস্যদের টানাটানিতে পড়ে ভুঁইপটকার মতো ফেটে গেল আর তারপরে সভার রাষ্ট্রনায়কদের একজন বিশ্বের কয়লা তেল গম গরু ভেড়া শুয়োর তুলো চিনি রবার লোহা সোনার জন-পিছু সমান হিসসার বাটোয়ারা করতে চাইলেন। কিন্তু ততক্ষণে সেই গামানুষেরা নশ্বর দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে নিরালম্ব বায়ুভূত হয়ে গেছেন। আর এক আশ্চর্য নিরাসক্তি থেকে রাজশেখর বসু লিখছেন,

‘মৃতবৎসা বসুন্ধরা একটু জিরিয়ে নেবেন তারপর আবার সসত্ত্বা হবেন। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানের বিলোপে তাঁর দুঃখ নেই। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। তিনি অলস-গমনা, দশ-বিশ লক্ষ বৎসরে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি হবে না, সুপ্রজাবতী হবার আশায় তিনি বার বার গর্ভধারণ করবেন।’ আজকের যে পৃথিবীর রাজনীতি আর রাষ্ট্রনীতিকে মুনাফা-কেন্দ্রিক অর্থনীতি আর ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে, রাজশেখর বসুর এ গল্প সে পৃথিবীতেও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। (Rajshekhar Basu)
ছবি সৌজন্যে: অরিজিৎ মৈত্র ও লেখক
আশিস পাঠক বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের প্রকাশনা ও বিপণন আধিকারিক।
আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা সময়ে যুক্ত থেকেছেন সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা আকাদেমি, কেন্দ্রীয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা বিভাগের নানা প্রকল্পে, নানা পুরস্কারের বিচারক হিসেবে। সংস্কৃতির নানা মহলে তাঁর আগ্রহ, বিশেষ আগ্রহ রবীন্দ্রনাথ ও গ্রন্থবিদ্যায়।