Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

স্মরণে কেয়া সরকার C/O ‘আলচা’

Alcha
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
(Alcha)

যেকোনও জীবনাবসানের খবর শুনলেই যা হয়, আমারও ঠিক তাই হল। পায়ে পায়ে সেই গাছের তলায় এসে, শুরু করলাম ফুল কুড়নো। নিমেষেই যেন মালায় গাঁথা হয়ে যেতে লাগল ফুলগুলি। টুকরো টুকরো ভাবে বিছিয়ে থাকা কেয়া। গত রবিবার মুম্বাই এসে পৌঁছনোমাত্রই মেয়ে জানাল যে, ‘কেয়াদি আর নেই, আজ সকালেই…’। মা-মেয়ে দুজনেই চুপ হয়ে গেলাম; অস্থির হয়ে ফোন করলাম অগ্রজ সোহিনীদিকে; শিক্ষায়তন কলেজের প্রাক্তনী এবং সম্পর্কে সে যে শুধু কেয়ার দিদি তাই নয়, তাদের পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ এক মানুষও। মেয়ের কাছে কেয়া এবং তার ‘আলচা’ সম্পর্কে সামান্য জানাটাই বেশ লম্বা এক সফর হয়ে গিয়েছিল। সোহিনীদির কাছ থেকে তার সম্পর্কে বিশদে জেনেছি। (Alcha)

রবীন্দ্রনাথের সমবায় ভাবনা: অমিত দে

পরম ভালোবাসায় সোহিনীদি জানিয়েছিল, মুম্বইতে কেয়ার সেই জবরদস্ত কর্মজীবন, Indian Craft Council -এর অন্যতম সদস্য হিসেবে তার মেতে থাকা এবং তার নিষ্ঠসঙ্গী সতীশকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিনিকেতনে সময় যাপন। শুনেছিলাম নিউ আলিপুরের বাড়িতে তার মায়ের আস্তানার গপ্পো এবং পরে তাঁর মৃত্যু সংবাদও। ততদিনে শান্তিনিকেতনে দাদামশাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া, চাতাল দেওয়া সেই একতলা বাড়িটাতেই তাদের এক নিজস্ব বসতি গড়ে ফেলেছে কেয়া আর সতীশ; একে যেন অন্যের পরিপূরক। এমন জুটি বেঁধে দুটিতে থাকা— এ তো প্রায় বিরল বললেই চলে। (Alcha)

Alcha
নতুনরা সোৎসাহে আমন্ত্রণ জানালো ‘আলচা’কেই

কেয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপ শান্তিনিকেতনেই। কলেজের কিছু ছাত্রীদের নিয়ে সেইবার শুধু আমার অগ্রজ সহকর্মী মহাশ্বেতাদি আর আমি। ট্যুরিস্ট লজে বুকিং না পেয়ে সবাই মিলে বোলপুর লজ। অবাঙালি মেয়েদের কথা ভেবেই আমরা তখন হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি ইডলি-ধোসা এবং পনির তরকারির বাইরে, একটু অন্য স্বাদের নিরামিষ খাবার; সেই সঙ্গে অন্তত কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার মতো একটা জায়গাও। ‘আলচা’র কথা মনে আসতেই সকলে রাজি হল, খানিক দোনামনা নিয়েই। (Alcha)

আমরা ঢুকতেই তালপাতার ছাউনির নীচে সাজানো সেই বসবার জায়গাগুলো যেন আহ্বান জানাল আমাদের। আপ্যায়ন করল কম তেলে বানানো সুস্বাদু সব খাবার নিয়ে। চূড়ান্ত শৌখিন মহাশ্বেতাদি তো পাতার ছাউনির নীচে বসে অ্যল-গ্রে চা পেয়েই একেবারে গৌরাঙ্গের ভঙ্গিতে তার খুশি প্রকাশ করে ফেলল। মেয়েরাও খুশি আঁশটেগন্ধ ছাড়া তাদের পছন্দ মতো বেশ বাহারি রকমের কিছু ‘Veg- Option’ পেয়ে। মহাশ্বেতাদি আর আমি খেলাম, সাদা তিল বাটার ডিপ্ সহযোগে মুগের ডালের চিল্লা আর পিঠে জাতীয় কোনও একটা মিষ্টি। (Alcha)

ঝকঝকে না-বাঁধানো মাটি লেপা চত্বর। আলগোছে সাজানো কিছু গাছের আয়োজনেই সুস্থ নিঃশ্বাস আর আলস্যঘন মুগ্ধ সময়।

মাটি আর সেরামিকের থালায় সাজানো সেই সব খাবার চর্মচোক্ষে দেখাটাও ছিল বেজায় আরামের। আর মজা পেয়েছিলাম টুকরো টুকরো সাদা কাগজে অর্ডার স্লিপ লেখার ব্যবস্থা দেখে। দুপুর গড়াতে-না-গড়াতেই ভিড় বাড়তে লাগল। মূলত বিশ্বভারতীর মাষ্টারমশাই আর ছাত্ররা; সঙ্গে কিছু জাপানী, কোরিয়ান এবং মণিপুরী মানুষও। ঝকঝকে না-বাঁধানো মাটি লেপা চত্বর। আলগোছে সাজানো কিছু গাছের আয়োজনেই সুস্থ নিঃশ্বাস আর আলস্যঘন মুগ্ধ সময়। গোধূলির রাঙা আলো মেখে চারিদিকে জ্বলে উঠতে লাগল বাদামী কাচের ভেতর চল্লিশ পাওয়ারের ছড়ানো ছিটনো ঢিমে ‘লাইট’। চারজোড়া টেবিল পাতা, খোলা চত্বরের মাথার দিকে ছোট্ট একখান বাড়ি আর তার অন্যদিকে মস্ত এক ফার্নেস। (Alcha)

বিরাট এবং ইয়া মোটা একটি পুরুষ্টু শিক দু-হাতে বাগিয়ে ধরে, শক্তিমান প্রহরীর মতোই শাসনে রাখছে একজন, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা সেই ফার্নেসের আগুনশিখাগুলিকে। আর সময়ান্তরে সেখান থেকেই বেরিয়ে আসছে, ট্রে -ভরা ফুলো-ফুলো পাউরুটি। না, সেই ফার্নেসের তাপ যে এদিকে আসছে তা নয়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, মেদহীন ওই সুগঠিত মানুষটিই সতীশ। বুঝলাম যে এরই তদারকিতে ‘আলচা’-এ এমন এক বাহারি ‘ক্যাফে’ গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে আমারই কাছাকাছি বয়সের একজন মহিলাকে দেখলাম, যে সমস্ত টেবিলে ঘুরে ঘুরে বসে, জমজমাট গপ্পো করে চলেছে। কথা কম বললেও হাসিটি ভারি সুন্দর। হালকা চন্দন রঙের তাঁত বেশ ‘পাটফিট’ করে পরা। সরু ফ্রেমের চশমার আড়ালে, এক জোড়া অতি উজ্জ্বল চোখ, যা থাকলে মুখে আর কিছুই বলতে লাগে না। (Alcha)

ভ্রু-মধ্যে কালো পেন্সিলে আঁকা লম্বাটে টিপের রেখা; একটু উঁচু করে বাধা পরিপাটি খোঁপাটিতে লাগানো, ফুল নয় পাতা সমেত একগুচ্ছ বেল কুঁড়ি; কিছুক্ষণ বাদে যা আপনিই ফুটে উঠবে। তার সাজ-পোশাক এবং শরীরী ভাষায় যেন বিকেলের গা-ধোয়া সেই বাঙালি আরাম।

ভ্রু-মধ্যে কালো পেন্সিলে আঁকা লম্বাটে টিপের রেখা; একটু উঁচু করে বাধা পরিপাটি খোঁপাটিতে লাগানো, ফুল নয় পাতা সমেত একগুচ্ছ বেল কুঁড়ি; কিছুক্ষণ বাদে যা আপনিই ফুটে উঠবে। তার সাজ-পোশাক এবং শরীরী ভাষায় যেন বিকেলের গা-ধোয়া সেই বাঙালি আরাম। এখানেই যেন এই প্রথম দেখলাম যে, পুরুষটি ভালোবাসে হেঁশেল সামলাতে, আর মহিলাটির পছন্দ হল, বিকেল বেলা সেজেগুজে বসে এটা-সেটা গপ্পো জমানো। এও বুঝলাম যে, মুম্বাই— স্টক এক্সচেঞ্জ— কর্পোরেট ফাইনান্স এবং অমিতাভ বচ্চনের গাঁটের কড়ি সামলানোর ইমারতি জীবন ফেলে কেন তারা এখানে এসে বাসা বেধেছে! না, তখনও যে সবটা বুঝেছি তা নয়। সেটা বুঝতে আরও একটু কৌতূহল জাগানো সময় দিতে হয়েছে কেয়া এবং সতীশের জীবন-ভাবনা বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে। (Alcha)

Alcha
আলচা’র বিভিন্ন কাজ

ইতিমধ্যেই শান্তিনিকেতনের নতুন একটা আউটলেট হিসেবে ‘আলচা’র খবর বেশ জানাজানি হতে শুরু করেছে। বিশেষত কলকাতার রসিক মহলে। ‘আলচা’র খেসের শাড়ি এবং কাঁথা-ফোঁড় নকসার দু’হাতলের ব্যাগ ও হাতসই পার্স তুলনায় দামী হওয়া সত্ত্বেও, বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; মানে ‘স্বদেশী’, ‘খাদি’ বা ‘গ্লোবাল- দেশি’ এমন সব তাক লাগানো তকমার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। কারণ তো নিঃসন্দেহে অভিনবত্ব এবং জবরদস্ত ভাবে শৈল্পিক। ‘Ethnic and Aesthetics’-এর এমন এক যথার্থ যুগলবন্দী, যা থেকে চোখ ফেরানো শক্ত। ফলে একই দামে সিল্ক-তসর থেকে মুখ ফিরিয়েও সে সব কিনতে আগ্রহী হল, বিশেষত মেয়েরা। শান্তিনিকেতনের ‘কারুসঙ্ঘ’ তখন বেশ ম্রিয়মান; ‘আমার কুটির’ এবং ‘শ্রীনিকেতন’ও সেই পুরনো আঁকড়েই। ফলে নতুনরা সোৎসাহে আমন্ত্রণ জানালো ‘আলচা’কেই। (Alcha)

অধীরদা জানালেন যে ‘আলচা’তে গাঙচিলের বই রাখার ব্যবস্থা হয়েছে; ফলে শান্তিনিকেতনে তাঁর প্রকাশনাও পা রাখার মতো অন্তত একটা জায়গা পেল। ঠিক হল যে, আমার লেখা ‘আন্টিগিরিবালা’ এবং অধীরদার লেখা ‘উড়োজাহাজ’- সদ্য প্রকাশিত এই দুটি বই নিয়েই একটা অনুষ্ঠান হবে ‘আলচায়’।

‘আলচা’ যে ক্রমেই এক নব্যরুচির কেন্দ্র হয়ে উঠছে সেটা বুঝতে পারলাম, গাঙচিল প্রকাশনীর অধীর বিশ্বাস এই পরিসরটির নামোল্লেখ করায়। সে-সময় আমার দুটি বইই তাঁর প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে। অধীরদা জানালেন যে ‘আলচা’তে গাঙচিলের বই রাখার ব্যবস্থা হয়েছে; ফলে শান্তিনিকেতনে তাঁর প্রকাশনাও পা রাখার মতো অন্তত একটা জায়গা পেল। ঠিক হল যে, আমার লেখা ‘আন্টিগিরিবালা’ এবং অধীরদার লেখা ‘উড়োজাহাজ’- সদ্য প্রকাশিত এই দুটি বই নিয়েই একটা অনুষ্ঠান হবে ‘আলচায়’। মেয়ে মধুজার সুবাদে কেয়া তো তক্ষুনি রাজি। ওখানকার ‘আলচা’-প্রেমীরাও মেতে উঠল এই অনুষ্ঠান ঘিরে টুকিটাকি ব্যবস্থাপনায়; বিশেষত বিশ্বভারতীর ইংরেজীর অধ্যাপক দীপঙ্কর। কেয়ার পরিকল্পনায় সাজানো হল দু’কামরা ঘরের সেই একতলা বাড়িখানি। আর সতীশের অদম্য উৎসাহও বেশ সাড়া জাগানো— চা এবং টায়ের ব্যবস্থাপনায়। (Alcha)

কেয়া ভীষণ খুশি হয়েছিল, কুমোরের চাকে বানানো কারুকাজ এবং পালিশবিহীন একখানি মাটির শাঁখ আমার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়ে। এদিনই বুঝেছিলাম যে, কেয়া কতখানি ধী-ময়ী। অনায়াসে অনর্গল বাংলায় এবং সংক্ষিপ্তভাবে মূল কথাগুলি বলে অনুষ্ঠানের মুখপাত করেছিল কেয়া। আর এই বোঝার সঙ্গে-সঙ্গেই মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম ঘর-গেরস্থালি ঘিরে তার রুচিবোধ। বিশেষত স্নানঘরটি। এলোমেলো মাপের শ্যাওলা, বাদামি আর কালো রঙের টাইলস বসিয়ে এমন দুটো ধাপ দিয়ে স্নানঘরটির শুরু যে, পর্দা সরিয়ে পা দিতেই মনে হবে, কোনও পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালাম নাকি! ভেতর দেওয়ালের গাছের বিন্যাসও সেই রকম স্বতঃস্ফূর্ত। সবচেয়ে মজা লেগেছিল, স্নানঘরের পাঁচিলের কোণা চিড়ে চাঁদ-আঁকা আকাশ দেখার আহ্লাদটুকু পেয়ে। চন্দ্রমাখচিত এমন এক স্নানঘর সে আর কোথায় দেখেছি! এখানে নিশ্চয়ই বারোমাস এভাবেই চলে, আলো-ছায়া আর মেঘেদের লুকোচুরি! (Alcha)

উধাও হয়ে গেল সতীশের সেই মস্তানি-মশগুল ফার্নেসটি। এ-চত্বরটায় আবার দু’দিক দিয়ে ঢোকা যায়। একদিকে ক্যাফে আর অন্যদিকে ক্র্যাফ্ট, যেখানকার জিনিসগুলোতে ট্যাগানো থাকে ‘অবকাশ’।

তবে এর কিছুদিন পরেই শুনলাম যে, ‘আলচা’ ওদের সেই শ্যামবাটীর আস্তানাখানি ছেড়ে উড়ে এসেছে, রতন পল্লীর বাঁকে, কোনও এক ‘নীলিমা’ বাড়িতে। পুরনোবাড়ির খোলা বারান্দায়, লম্বা এক মাছ ধরার ঝুড়ির মধ্যে অচিরেই জ্বলে উঠল সেই একই রকম হলুদ আলো। তাতে সুবিধে হল এই যে, আমার চিরস্থায়ী আস্তানা পূর্বপল্লীর ‘জোড়াবাড়ি’ থেকে বেরিয়ে অবনপল্লী পেরোলেই একেবারে নাকের ডগায় এসে গেল ‘আলচা’। কিন্তু উধাও হয়ে গেল সতীশের সেই মস্তানি-মশগুল ফার্নেসটি। এ-চত্বরটায় আবার দু’দিক দিয়ে ঢোকা যায়। একদিকে ক্যাফে আর অন্যদিকে ক্র্যাফ্ট, যেখানকার জিনিসগুলোতে ট্যাগানো থাকে ‘অবকাশ’। এ আস্তানাটি তাদের পূর্বপল্লী- ‘অবকাশ’ বাড়ির থেকেও বেশি দূর নয়। ফলে ‘আলচা’ এবং কেয়া- সতীশের বসবাসের ধরণটা ক্রমেই, মিলেমিশে এক হয়ে যেতে লাগল বেশ অনায়াসে। (Alcha)

একদিকে শ্যামলী খাস্তগীরের অনুপ্রেরণা এবং অন্যদিকে নিজেদের ইচ্ছেগুলোর দুর্বার স্রোত—দু’টোকেই যাপন করতে লাগল তারা। শান্তিনিকেতনে যে পুবের জানলাটা উপহার হিসেবে আমি পেয়েছি, সেটা আসলে সৌম্য’র দেওয়া আলো; ফলে বিগত তিরিশ বছর ধরে কত-না মানুষ দেখলাম, তার সাহচর্যে এসে! ‘আলচা’র বাইরে যে কেয়া এবং সতীশ তাদের নিকটে পেলাম সৌম্য- সঙ্গ করে। লেক গার্ডেন্সের ঠিক কোন তামিল পড়শিদের কাছাকাছি তাদের কলকাতার আস্তানা, শান্তিনিকেতনে কোথায় কোন জমিতে তারা অরগ্যানিক চাষ জমিয়েছে, কোন কোন গ্রাম থেকে কারিগর আসছে তাদের কাছে কাজ পেয়ে, কী ভাবে লাগাতারভাবে তারা চালিয়ে যাচ্ছে প্লাস্টিক বিরোধী আন্দোলন, ‘আলচা’ মানে যে স্থানীয় ভাষায় ‘আলচানো’ বা সবার ‘অলক্ষে’ খানিকক্ষণ নিভৃতে ‘বকবক’— এমন সবও জানতে পারলাম কত অনায়াসে! দেখলাম যে, তাদের ঘিরে আরও যে অসংখ্য মানুষ, তারাও পা-মিলিয়েছে ওদের উৎসাহে। (Alcha)

আমার অগ্রজ সহকর্মী অমিতাদি, সৌম্য’র মা- শান্তিনিকেতন যাওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে তাদের আমি নিকটে পেলাম। জোড়াবাড়ির খোলা বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসা অমিতাদিকে ঘিরে সকাল থেকে বেলা গড়িয়ে আড্ডা— কেয়া, সতীশ, মুনিয়াদি- আলপনা রায়, মিঠুদি- রঞ্জনা সরকার, শিনা পাঁজা, সৌম্য আর আমি।

আমার অগ্রজ সহকর্মী অমিতাদি, সৌম্য’র মা- শান্তিনিকেতন যাওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে তাদের আমি নিকটে পেলাম। জোড়াবাড়ির খোলা বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসা অমিতাদিকে ঘিরে সকাল থেকে বেলা গড়িয়ে আড্ডা— কেয়া, সতীশ, মুনিয়াদি- আলপনা রায়, মিঠুদি- রঞ্জনা সরকার, শিনা পাঁজা, সৌম্য আর আমি। দুর্গাপুজোর সময় শিবুদার গাড়ি নিয়ে মুলুক গ্রামের ‘হাট সেরান্দি’ পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখি আর একটা গাড়িতে কেয়া- সতীশ। প্রতি শুক্রবার সতীশকে দেখা যাবে মুখ-মাথা একখানি গামছায় মুড়ে গ্লাভস পরা হাতখানি বাড়িয়ে, গেটে ঝোলানো ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের পোঁটলাটা সংগ্রহ করে নিজের ঝুড়িতে ফেলতে। (Alcha)

Times of India লিখল—’A Tamil-man is keeping Tagore’s Santiniketan’। সত্যিই তো! শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বা বসন্ত— সতীশের হাজিরার বিরাম নেই। অন্দরে থাকা মানুষগুলোও শিখে গেল, প্লাস্টিককে কীভাবে আলাদা বর্জ্য হিসেবে বেছে রাখতে হয়। অন্তত পূর্বপল্লী, তাদের নিজেদের পাড়াটুকু প্লাস্টিক মুক্ত করে ফেলল সতীশ। (Alcha)

এইরকম অযাচিতভাবেই বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে গেছে তাদের সঙ্গে, প্রত্যন্ত গ্রামের মেলাতেও। মাসাঞ্জোরে ময়ূরাক্ষী ড্যামের নীচে বসা এক বুড়ির কাছ থেকে দু’খানি বাঁশের ডালা কিনেই দেখি যে, কেয়া এসেছে তার কাছ থেকে অর্ডারি ঝুড়ি-কুলো নিয়ে যেতে। অতখানি তেল পুড়িয়ে এসেও, ওই বিশিষ্ট ঝুড়ি-কুলোগুলোই তার চাই; কারণ এ-অঞ্চলের বীরভূমে এসে মিশেছে, ঝাড়খন্ডিদের বুনন এবং অন্য জাতের বাঁশ। মাটির বাসনে রান্না করে খাওয়া, আয়েঙ্গার শৈলীর যোগাভ্যাস, নিপুণ করে আঁকা টিপ ও কাজল এবং দূষণমুক্ত এক জীবন— এই চাহিদাই ঘিরে রেখেছিল কেয়ার যাপনকে। (Alcha)

Alcha
কেয়া সরকার

কেয়ার মনন ও ভাবনা

নার্সারি ক্লাসে বিপরীতার্থক শব্দ শিখতে গিয়ে আমার মেয়ে জোরে জোরে পড়ছিল— ‘শহুরে/ গ্রামুরে’। সেই থেকে ওই শব্দটাই মাথায় ঢুকে আছে। শহুরের বিপরীত গেঁয়ো হলেও, এ-দু’য়ের মাঝখানে তো বসিয়ে নেওয়াই যায় ওই ‘গ্রামুরে’ শব্দটাকেও; আদপে যা বোঝাবে, সক্ষমতার সঙ্গে সচেতনভাবেই বেছে নেওয়া এক গ্রাম্য জীবন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার বিভিন্ন ইংরেজি আর্টিকেলগুলিতে কেয়া তো এসব কথাই নিরন্তর লিখে গেছে। শান্তিনিকেতনের হাওয়া-বাতাস, স্থানীয় কারিগরদের কুটির শিল্প, কলাভবন এবং রবীন্দ্রনাথের প্রবর্তন করা নানা উপলক্ষে মেলাগুলির আয়োজনও অনুপ্রাণিত করেছে তাকে। তারই মধ্যে অবাক হয়ে গেছে এই দেখে যে, শান্তিনিকেতনের নানা কর্মকাণ্ডের উল্লেখে কোনও এক আন্তর্জাতিক বুলেটিনে ‘আলচা’র নাম একেবারে শীর্ষে। ক্যানালের পাড়ে রাঙামাটির না-বাঁধানো সাঁওতাল পল্লীতে নেমে যাওয়া রাস্তার ওপর তারাই তো শুরু করে ‘অন্যরকম হাট’- এই নামে প্রতি শনিবারের এক জমায়েত। ছোট ছোট কারিগরদের সঙ্গে জুটতে থাকে কলাভবনের কিছু ছাত্রও। প্রথম দিকে নিজেরাই একে অপরের কাছে কেনা-বেচা করে সেই উদ্যোগকে টিকিয়ে রাখলেও, কিছু পরে আসতে থাকে অচেনা ক্রেতারাও। বিক্রি এবং যোগান বাড়তেই উদ্যোক্তাদের মধ্যেও প্রশ্ন জাগতে থাকে। ইকোনমিক্স পড়া এবং মুম্বই কর্পোরেট জগতে কাজ করা কেয়ার কাছে স্বচ্ছ হয়ে আসে আসন্ন সমস্যার চালচিত্রটি। (Alcha)

বাকিরা বুঝে ওঠার আগেই সে ধরতে পেরে যায় যে, সংশয়গুলি অচিরেই পাক খাবে – ‘Tourists’ Friendly Productions’ এবং ‘High-Life Style Products’— এমন সব ইশারায়। কেয়া লিখছে, “We founders often lamented that what had started ‘small and beautiful’ had turned ‘big and ugly’”. (Alcha)

সরকারি উদ্যোগে ব্যাপক বিক্রির ওই সোনাঝুরি হাট এবং সিন্থেটিক শাড়ির কস্ট্যুম পরে ক্রেতা টানতে ‘সাঁওতালি’ নাচ শুরু হওয়ার আগেই কেয়ার মাথায় আসে নিজস্ব একটা আউটলেট বানানোর। তারই ফসল ‘আলচা’। নানা আয়োজনে সে গড়ে তুলতে লাগল তার এই নতুন স্বপ্নকে। খেশের শাড়ি তো তারই উদ্ভাবন। পুরনো কাপড় দিয়ে বানানো খেশের চাদর তো আমরা সবাই ব্যবহার করেছি। তাই শাড়িই বা কেন নয়! আঁচলটা বুনোটের জেরে ভারি হয়ে গেলে, শাড়ির জমিতেও জুড়ে দিল লম্বা-লম্বা খেশের ডুরে। সেই সঙ্গে পাওয়া যেতে লাগল খেশের ব্যাগও। সহজলভ্য ‘সস্তা’র সঙ্গে আপোষ না করে কেয়া মন দিল, ভিন্ন রুচির ক্রেতা খুঁজে বার করতে। (Alcha)

শ্যামবাটী থেকে ‘আলচা’ চলে এল, রতনপল্লীর বাঁকে। ক্যাফেটাকে একটু খাটো করে, বাড়িয়ে নিল ক্র্যাফ্টের আয়োজন। চিন্তা হল, ক্যাফের সাহায্যকারীদের নিয়ে। তাদের আয়ে যাতে টান না পড়ে, সেজন্য নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য কিছু উদ্যোগও নিল তারা।

শ্যামবাটী থেকে ‘আলচা’ চলে এল, রতনপল্লীর বাঁকে। ক্যাফেটাকে একটু খাটো করে, বাড়িয়ে নিল ক্র্যাফ্টের আয়োজন। চিন্তা হল, ক্যাফের সাহায্যকারীদের নিয়ে। তাদের আয়ে যাতে টান না পড়ে, সেজন্য নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য কিছু উদ্যোগও নিল তারা। হোম-স্টে থেকে শুরু করে, দুপুরের খাবারের হোম ডেলিভারি; সন্ধেবেলা সতীশের নেশাই তো ছিল নিয়ম করে চকোলেট বানানো। শুরু করল তাদের কর্মীদের সাহায্যেই নানা জায়গায় কর্ম শিবির বা Workshop-ও। আশপাশের গ্রামের বেশ ভাল সংখ্যক মুসলিম মেয়েদের নিয়ে গড়ে তুলল কাঁথা এবং টেলারিং ইউনিট।

কথায়-কথায় জানতে পারি যে, প্রায় শ-দুয়েক পরিবারের অন্ন সংস্থান হত আলচার সঙ্গে যুক্ত থেকে। ফলে আউট সোর্সিং ট্রেডিং-এর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে অল্পদামে কিনে, বেশি দামে বেচার পথে না গিয়ে কেয়া গড়ে তুলেছিল, তার ম্যানুফাকচারিং ইউনিটটিও। কলকাতার কিছু বিপণিতেও পাওয়া যেত ‘অবকাশ’ ব্রান্ডের এইসব কাজ। একইভাবে, নিত্য-নতুন জিনিসের আমদানি করে আমাদের পছন্দকে বর্ণময় করে তুলেছে বারবার। (Alcha)

‘নীলিমা’ বাড়ির মালিক যখন আর ভাড়া দিতে চাইলেন না, তখনই সিদ্ধান্ত নিল, সতেরো বছর ধরে গড়ে তোলা এই সংস্থাকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার। কেয়ার মনে হল যে, এটাই সঠিক। কোভিডের সময় তিনমাস বিক্রি বন্ধ থাকলেও খরচ তো চালিয়েই যেতে হয়েছে। এই প্রথম সে ভাবল ডিস্কাউন্ট দিয়ে অর্ধেক দামে সব কিছু বিক্রি করে দেবে। দেখতে-দেখতে খালিও হয়ে গেল, তাক আলমারি এবং রকমারি জিনিসে ভরা বাক্সগুলো। লোকে জানতে চাইল, আসবাবগুল বিক্রি আছে কী না! সেগুলো বিক্রি হয়ে গেলে ভারি নিশ্চিন্ত হল কেয়া। তার দাদামশাইয়ের যে বাড়িতে তারা থাকত সেখানেই চালু রাখল, ‘অবকাশ’ নামে ম্যানুফাকচারিং ইউনিটটি। সরাসরি বিক্রি হতে লাগল সেখান থেকেও। (Alcha)

মুম্বাই এসে, এক ছাত্রীর কাছ থেকে উপহারে পাওয়া চামড়া বাঁধানো কাঁথার পার্সটি সদ্য হাতে পেয়েই যখন ভাবছি, এ- পার্স তো ‘আলচা’ ছাড়া পাওয়া যায় না! দেখলাম লেখা আছে ‘অবকাশ’। নিঃসন্দেহ হলাম ‘আলচা’র সাম্প্রতিকতম ওয়েবসাইটটিতে এই ‘অবকাশে’র উল্লেখ দেখে।

মুম্বাই এসে, এক ছাত্রীর কাছ থেকে উপহারে পাওয়া চামড়া বাঁধানো কাঁথার পার্সটি সদ্য হাতে পেয়েই যখন ভাবছি, এ- পার্স তো ‘আলচা’ ছাড়া পাওয়া যায় না! দেখলাম লেখা আছে ‘অবকাশ’। নিঃসন্দেহ হলাম ‘আলচা’র সাম্প্রতিকতম ওয়েবসাইটটিতে এই ‘অবকাশে’র উল্লেখ দেখে। কয়েকদিন হল, চলে গেছে কেয়া। অথচ তার কাজ এখনও আমাদের কাছে এক সেরা উপহার। সব জেনে সেই ছাত্রীটি লিখল, ‘This Universe has its own design……’
আর কী সুন্দর করে যে এই সবকিছু লিখে গেছে কেয়া! কুড়ি বছর মুম্বাই-বসবাসের কর্পোরেট জীবন ছেড়ে কীভাবে এবং কেনই বা সে শান্তিনিকেতনে এসে ‘আলচা’কে ঘিরে বাঁচল! (Alcha)

Women’s empowerment, reproductive labour of women, GST and the handicraft items, unprofessional administration, severe illiteracy, lower income for men— এসব নিয়েও ক্রমাগত লিখে গেছে কেয়া। Business Standard-এ ধারাবাহিকভাবে Keya Sarkar নামে লেখা তার collum পড়ে মনে হচ্ছিল, আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, কেয়া অন্তত নিজেকে খুব সঠিকভাবেই বুঝেছিল। যে দায়িত্ববোধ থেকে সে এটা গড়ে তুলেছিল, ঠিক একইরকম দায়িত্ব বোধের প্রকাশ হয়ে রইল, এই সব কিছু থেকে সরে যাওয়াও। (Alcha)

‘আলচা’ থেকে ‘অবকাশ’— দুটোর মধ্যে বেশ একটা যোগ রেখে গেল। ‘আলচানো’ মানে বকবক বা আলোচনাও তো হতে পারে! তাই আলোচনা শেষে, হয়তো বা এই জীবন থেকে বিশ্রাম পেতে, আসলে সেই চিরবিশ্রামের পথে হাঁটা!
অনেকটা সময় কাটল, কেয়াকে নিয়ে এ-লেখা লিখতে বসায়। হয়তো তার অন্যতম কারণ এই যে, আমাদের দুজনের নামেই ফুটে আছে দু-দুটি ফুল; মন্দার যদি হয় বসন্তের, তো কেয়া হল সজল বর্ষার। (Alcha)

শেষে তাই লিখি,
কেয়াকে, এই স্মরণ-অর্ঘ্যে মন্দার।

ছবি সৌজন্য- লেখক

Author Mondar Mukherjee

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

সংস্কৃতি

আহার

শমিতা হালদার
অমৃতা ভট্টাচার্য
শ্রুতি গঙ্গোপাধ্যায়

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

শক্তিপদ ভট্টাচার্য
নির্মাল্য চ্যাটার্জি
নির্মাল্য চ্যাটার্জি

উপন্যাস

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com