(Bengali Language)
ভাষামাত্রেরই একটি শিকড় আছে। মাতৃভাষার অধিকার সর্বজনের, বাংলা ভাষা, প্রাণের ভাষা। সাহিত্যকে ধারণ করে। বাংলায় একাধিক প্রবাহমান শাখা নদীর মতন, আছে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা। তারা সংস্কৃতি ও নিজস্ব শব্দভান্ডারে সমৃদ্ধ। বাংলার মানুষ দেখেছে ভাষা আন্দোলন। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গণচেতনা সংঘটিত হয়েছিল। ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’। সেই ভাষা নিয়েও এই সময়ে বিতর্ক। তার প্রভাব পড়ছে রাজ্যের বাইরেও। কোনও আঁচড় ভাষায় পড়তে পারে না, এমন আশা আমরা করতেই পারি। (Bengali Language)
পৃথিবীতে এমন কোনও ভাষা নেই যেখানে নিজের ভাষার সঙ্গে বিদেশি শব্দ প্রবেশ করেনি। এমন প্রচুর উদাহরণ আছে। বাংলা ভাষাতেও বিদেশি শব্দ প্রচুর সংখ্যক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। একসময় বাংলাতে বাণিজ্যের কারণে ইউরোপীয় বণিকরা যাতায়াত করেছে। পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, দিনেমার, বৃটিশদের সংস্কৃতি বাঁধা পড়েছে বাংলায়। পর্তুগিজরা প্রথম বাংলায় আসে ১৫১৭ সালে। গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে হুগলীতে বাণিজ্য কেন্দ্র ও ঘাঁটি গড়ে। শুধু যে ছানা আর চিজ তৈরির কায়দা তাদের থেকে বাংলা সংস্কৃতিতে এসেছে এমনটা নয়, আরও অনেক উপাদান, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বেশ কিছু পর্তুগিজ শব্দ যা বাংলা ভাষাতে প্রয়োগ করা হয় জানেন কি? আলমারি, চাবি, আলপিন, ফিরিঙ্গি, বারান্দা ইত্যাদি সবই পর্তুগিজ ভাষা থেকে এসেছে। (Bengali Language)

বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যাকরণ ছাপা হয় ইউরোপীয়দের হাত ধরে। জানেন বাংলায় কাদের আগমনে ঘটে এই ঘটনা? আঠারো শতকে বাংলার ব্যস্ত দুটি বন্দর ছিল চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রাম। হুগলীর সপ্তগ্রাম ছিল তখন বাংলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। ইতিহাসবিদ জাও-ডি-ব্যারোস ও হেজেসের ভ্রমণ কাহিনি থেকে জানা যায় যে, সেই সময় বড় বড় জাহাজ হাওড়ার বেতড় পর্যন্ত আসত। তারপর ছোট ছোট জলযানে করে বিভিন্ন পণ্য বণিকেরা হুগলী নদীর পাড়ে সপ্তগ্রামে নিয়ে আসতেন। চালান করতেন সুতির কাপড়, মসলিন, মশলা ইত্যাদি পণ্য। পর্তুগিজরা বেতড়কে বলতেন ‘Butter’। হুগলীকে বলতেন ‘Ogouli’। পর্তুগিজ বণিকেরা চট্টগ্রামকে বলতেন বড় স্বর্গ বা ‘পোর্ট-গ্রান্ডী’। সপ্তগ্রামকে বলতেন ছোট স্বর্গ বা ‘পোর্ট পিকানো’। বণিক থেকে তারা হয়ে উঠেছিল জলদস্যু। বাংলার একাধিক জায়গায় তারা ক্যারাভেলে করে আক্রমণ চালাত। মোগলদের সঙ্গেও পর্তুগিজদের যুদ্ধ হয়েছিল। (Bengali Language)
“উপমহাদেশে পর্তুগিজরা প্রথম ছাপাখানা খোলে। সময়টা মুঘল যুগ, সম্রাট আকবরের আমল। পর্তুগিজ মিশনারিরা প্রথম বাংলা ভাষায় বই রচনা করেন।”
ভারতের গোয়াতে পর্তুগিজরা প্রথম ছাপাখানা চালু করে। যা মুদ্রণ শিল্পের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে প্রথম ব্যাকরণ বইটি তারাই প্রকাশ করেন। উপনিবেশবাদ বলে যারা ক্ষমতাবান, চিরকালই দমিত মানুষদেরকে তারা জানবার চেষ্টা করেছে। রীতিনীতি শেখবার আগ্রহ দেখিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনে। (Bengali Language)
“প্রথম বইটি রচনা শুরু হয় ১৭৩৪ সালে। আর প্রকাশকাল ১৭৪৩ সাল। যা বাংলা গদ্যের এক প্রাচীন নিদর্শন। বইটি রচনা করেন ম্যানুয়েল দা আস্সুম্পসাঁউ।”
উপমহাদেশে পর্তুগিজরা প্রথম ছাপাখানা খোলে। সময়টা মুঘল যুগ, সম্রাট আকবরের আমল। পর্তুগিজ মিশনারিরা প্রথম বাংলা ভাষায় বই রচনা করেন। যা ছেপে বের হয়। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তবে ছাপা হয় রোমান অক্ষরে। প্রথম মুদ্রিত বই হল ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থবেদ’ এরপর খ্রীষ্ট ধর্ম বিষয়ক লেখা, সংবাদ, ব্যাকরণ ও অভিধান নিয়ে আরও তিনটি বই পর্তুগাল শহর থেকে ছেপে বের হয়। (Bengali Language)
প্রথম বইটি রচনা শুরু হয় ১৭৩৪ সালে। আর প্রকাশকাল ১৭৪৩ সাল। যা বাংলা গদ্যের এক প্রাচীন নিদর্শন। বইটি রচনা করেন ম্যানুয়েল দা আস্সুম্পসাঁউ। তিনি বাংলা ভাষার প্রতি আসক্ত হন। তাঁরাই বাংলায় প্রথম খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করে। তাই এই বইখানি করেছিলেন। যা ঐতিহাসিক এক দলিল। এর দীর্ঘ বছর পরে পঞ্চানন কর্মকার বাংলা ও সংস্কৃত হরফের ছাঁচ নির্মাণ করলে হ্যালহেড বা হালেদ সাহেবের বাংলা বইটি মুদ্রিত হয়। (Bengali Language)

এরপর হুগলীতে কাঠের ছাপাখানা খোলা হয়। তখনও বাংলা হরফ আসেনি। পর্তুগিজদের মুদ্রিত বই এর হরফ ছিল রোমান। আঁতের কথাটি, আমরা যেভাবে ফোনে আজকাল এসএমএস করি অথবা ইন্টারনেটে পড়ি, সেই হরফে বাংলা ভাষাটি লেখা হত। পর্তুগিজরাই প্রথম বাংলায় আসে। আর সেই স্মৃতির পাতায় তাদের বাংলা ভাষা চর্চা ঔনিবেশিকতার ইতিহাসে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। সেই কাহিনি, এমনই কত স্মৃতি বহন করছে। বাঙালির মুখে মুখে আজও পর্তুগিজদের শব্দ ও সাহিত্য জ্ঞাত-অজ্ঞাতভাবে চর্চিত হয়ে আসছে। (Bengali Language)
তথ্য সূত্র:
১) নরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য
২) জাও ডি ব্যারস ও হেজেস
ছবি সৌজন্য- লেখক
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মুকুট তপাদার। ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিসার্চার। ইতিহাস-শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে ফটোগ্রাফি ও লেখালেখি। গবেষণার বিষয় গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের ইতিহাস ও শিল্পকর্ম।