(Kotagiri)
একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাতাসে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ। সামনে যতদূর চোখ যায় উপত্যকা জুড়ে নরম মখমলি সবুজ গালিচা পাতা। পিছনে সারিবদ্ধ পাহাড়, কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে অচঞ্চল প্রতীক্ষায়, কখন সূর্যদেব এসে প্রকৃতি রাণীর ঘুম ভাঙাবেন। এক বুক ফ্রেশ অক্সিজেন নিয়ে চা-বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

গতকাল বিকেল বিকেল এসে পৌঁছেছি কোটাগিরি। ব্যাঙ্গালোর থেকে লম্বা ড্রাইভ – প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা। মাঝে দুবার অল্পস্বল্প ব্রেক, টুকটাক খাওয়া, খানিক হাত পায়ের খিল ছাড়ানো। শেষের ঘণ্টায় পেরোতে হয়েছিল ৩৬টা খটমট হেয়ারপিন বাঁক ও উটি শহর। ইচ্ছে ছিল উটিতেই রাত্রিবাসের, কিন্ত দক্ষিণ ভারতের ‘Queen of Hill stations’ উটিতে আজকাল ভিড় এত বেশি যে সহজে জায়গা পাওয়া যায় না। অগত্যা উটিকে পেছনে ফেলে আরও একঘণ্টা ড্রাইভ করে আমরা চলে এলাম কোটাগিরি। রাত্রিবাস চা-বাগানের কোলে এক ছোট্ট সুন্দর নিরিবিলি হোমস্টেতে।

হোমস্টের কেয়ারটেকার দীনেশ চলেছে গাইড হয়ে, ভাষার বেড়া ডিঙিয়ে টুকটাক আলাপচারিতা চলছে। নীলগিরি মাউণ্টেন রেঞ্জ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট শহর কোটাগিরি, আদতে ‘কোটা’ ট্রাইবদের বসতি ছিল। ভারতের অন্য সব শৈল শহরের মতো কোটাগিরিও সাহেবদের হাতেই তৈরি। ১৮১৯ সালে জন সুলিভান (John Sullivan) নামে জনৈক ব্রিটিশ অভিযাত্রী, তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাদ্রাজ পরগনার হলফনামা নিয়ে গল্পে শোনা নীল পাহাড়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। একাজে তাকে সাহায্য করেন মাদ্রাজ রেজিমেন্টের স্থানীয় সেপাই দল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি প্রথমে কোটাগিরি, পরবর্তীকালে উটি (বর্তমান পোশাকি নাম উধাগামণ্ডলম), খুঁজে বার করেন।
আরও পড়ুন: লুসার্ণ থেকে ইয়ুনফ্রাউ – এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা
দীনেশ বলতে থাকে, “তখন অবশ্য এই অঞ্চল ছিল বুনো জন্তু জানোয়ারে ভরা, প্রায় অগম্য। কিন্ত সুলিভান প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন এখানকার শান্তিপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর। ভেবেছিলেন, গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদহে কাবু নরম ব্রিটিশ শরীরকে তরতাজা রাখবে। ব্যস! – শুরু হয়ে গেল বন কেটে শহর বানানোর কর্মযজ্ঞ। পরবর্তীকালে সুলিভান এখানে চাষবাস শুরু করালেন, বিশাল অট্টালিকা বানালেন সপরিবারে বাস করার জন্যে”। স্টোন হাউস নামে খ্যাত সেই অট্টালিকা এখনও আছে, তবে সময়াভাবে আমাদের যাওয়া হয়নি।
কোটাগিরি থেকে শুরু হলেও নীলগিরি উন্নয়ন প্রকল্পে পরে উটিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। সুলিভানই উটি লেক খনন করান ১৮২৩-২৫-এর মধ্যে। কিছুদিনের মধ্যে ইউরোপীয় সমাজে উটি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে, এবং ব্রিটিশ রাজের গ্রীষ্মকালীন শৈলাবাস হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করে। একে একে চার্চ, স্কুল, আর্মি ক্যান্টনমেন্ট, ব্রিটিশ বাংলো, নীলগিরি মাউণ্টেন রেলওয়ে থেকে উটি বটানিক্যাল গার্ডেন সব তৈরি হয়।

“মেমসাব আর মেয়ে এখানে হঠাৎ মারা গেলে সুলিভানসাব সব কিছু বিলি/বিক্রি করে চলে গেলেন। আমার দাদাজির চাচেরা ভাই দুটো চা বাগান পেয়েছিল, একদম ফ্রি-তে, সুলিভান সাবের কাছে কাজ করত কিনা!” অনেকদিন পরে সাব/মেমসাব শুনে মজা লাগল, কিন্তু দীনেশের বেদনা বিধুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিটা গিলে ফেললাম। ব্যথাটা মেমসাবের করুণ পরিণতির জন্যে, না ঠাকুরদার ভাইয়ের ফ্রি চা বাগান প্রাপ্তিতে – তা নিয়ে ধন্দ রয়ে গেল। তবে একথাও সত্যি, ভারতের অনেক পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে দেখেছি ব্রিটিশ সাহেব/মেমদের জন্যে অনেকের মনেই এখনও বেশ সহানুভূতি আছে। দোষও ঠিক দেওয়া যায় না, পাহাড়ি অঞ্চলের উন্নতির ভিত্তিস্থাপন তো তাদের হাত ধরেই, তা সে কারণ যাই হোক না কেন। (Kotagiri)
এদিকে রাতে বাইসন ঘুরে বেড়ায়। হোমস্টেতে ফেরার কিছুক্ষণ পর থেকেই দমাদ্দম বাজি পটকার আওয়াজে কান ঝালাপালা। দীনেশ জানাল বাইসন বেরিয়েছে। সদর দরজায় তালা মেরে আমরা দোতলার ব্যালকনিতে অধিষ্ঠিত বাইসন দেখব বলে। ঘণ্টাখানেক পরে হুসমুস করতে করতে গোটা চারেক বিশালবপু বাইসন মচমচ করে চা পাতা চিবোতে চিবোতে, হোমস্টের গেটে দু চারটে গোঁত্তা দিয়ে চলে গেল।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম শহরে। বেশ ঘিঞ্জি, ছোট্ট চৌহদ্দিতে অনেক দোকান ঠেসে ঢোকানো। বেশিরভাগই বেকারি, চকোলেট, খাবার আর জামাকাপড়ের দোকান। আমরা ‘অন্নপূর্ণা’য় পেটপুড়ে ধোসা, ইডলি, দই বড়া, ফিল্টার কফি সহযোগে ব্রাঞ্চ সেরে খানিক ঘোরাঘুরি করে ঘরে ফিরলাম। (Kotagiri)
বিকেল বিকেল গাড়ি নিয়ে গেলাম কোডানার ভিউ পয়েন্ট (Kodanad View Point), দূরত্ব প্রায় আঠারো কিমি। গাইড দীনেশের পাড়াতুতো ভাই লিও। সবুজ চা বাগানের মধ্যে দিয়ে ঘোরানো রাস্তা, লিও ফিসফিস করে জানালো, “অল আম্মা’স”। বুঝলাম জয়ললিতা গত হলেও, ‘আম্মা’ আজও ভীষণভাবে জীবিত। (Kotagiri)

এন্ট্রি করিয়ে গাড়ি পার্ক করে এগোলাম। ভিউপয়েন্টের দুটি ভাগ – আপার ডেক, লোয়ার ডেক। সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে আবারও খানিক ওঠা। ভারী সুন্দর প্যানোরমিক দৃশ্য। নীল আকাশের বুক জুড়ে নীলচে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ, খাঁজে খাঁজে আটকে থাকা সাদা মেঘ, এদিক ওদিক উড়তে থাকা প্রজাপতির দল, মন ভালো করার সব উপাদান থরে থরে সাজানো। (Kotagiri)
ফেরার পথে লিও নিয়ে গেল তার এক পাড়াতুতো বোনের মুদিখানা কাম চায়ের দোকানে। ছোট্ট একচিলতে গুমটিঘর, কিন্ত হেন জিনিস নেই, পাওয়া যায় না। এমনকি রান্নার সরঞ্জামও ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। “এদিকে অনেক হোমস্টে আছে, তারাই নিয়ে যায়”, জানাল সেবন্তী। (Kotagiri)

চা আর গরমগরম ম্যাগি খেয়ে তৃপ্ত হলাম। পাহাড়ে ম্যাগির স্বাদ সমতলের থেকে একদম আলাদা, যারা খেয়েছেন তারাই জানেন। সেবন্তীর স্বামী আর্মিতে কাজ করে, বর্তমানে কুমায়ুনে আছে। দুই মেয়েকে নিয়ে সে এখানে থাকে, মেয়ে দুটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, লেখাপড়ায় খুব মন। সেবন্তীর মুখে গর্ব ছলকায়। (Kotagiri)
বেশ চলছিল গল্পগাছা, লিওর তাড়ায় উঠতে হল। এদিকে রাতে বাইসন ঘুরে বেড়ায়। হোমস্টেতে ফেরার কিছুক্ষণ পর থেকেই দমাদ্দম বাজি পটকার আওয়াজে কান ঝালাপালা। দীনেশ জানাল বাইসন বেরিয়েছে। সদর দরজায় কষে তালা মেরে আমরা দোতলার ব্যালকনিতে অধিষ্ঠিত বাইসন দেখব বলে। ঘণ্টাখানেক পরে হুসমুস করতে করতে গোটা চারেক বিশালবপু বাইসন (আসলে গউর, ভারতে বাইসন পাওয়া যায় না) মচমচ করে চা পাতা চিবোতে চিবোতে, হোমস্টের গেটে দু চারটে গোঁত্তা দিয়ে চলে গেল। (Kotagiri)
প্রথম দিনের বেশ নাটকীয় সমাপ্তি যাকে বলে। (Kotagiri)
(চলবে)
ছবি:শুভাশীষ ব্যানার্জী , Wikipedia
মণিদীপার লেখায় কল্পনা ও বাস্তব হাত ধরাধরি করে চলে। সহজ ঝরঝরে ভাষায় শিশুদের জন্যে মজাদার গল্প বোনার পাশাপাশি, তিনি তথ্যনির্ভর ভ্রমণসাহিত্য রচনায় সমান মুনশিয়ানা দেখান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্রী একসময় চুটিয়ে লিখেছেন দ্য স্টেটসম্যান, সানন্দা, ভ্রমণ, Better Photography, Times Journal of Photography, The China Post এবং Travel in Taiwan-এর মতো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
তার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে বিশেষ নিউল্লেখযোগ্য—ঠামমা ও গাভাস্কর, The Misadventures of Teddy Tumbledore, এবং Jungle Beats