(Sudhindranath Dutta)
ওঁর চিঠিতে ডাক্তাররা হতভম্ব! একবার পেটব্যথায় হাসপাতালে ভর্তি হলে, ডাক্তাররা বললেন— অপারেশন করতে হবে। কবি, অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগেই নিজের জন্য লিখে ফেললেন একটি কবিতা— হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে! এমনই মানুষ ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত— শব্দ ও সাহিত্যের এমন এক ধ্যানমগ্ন সাধক, যিনি দৈনন্দিন জীবনকে অনায়াসে কবিতার রসায়নে রূপান্তর করতে জানতেন।
তিনি ছিলেন এমন এক কবি— যিনি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে কবিতা লেখার চ্যালেঞ্জ জিতে নিয়েছিলেন! একটি কবিতা তিনি লিখেছিলেন ৩০ বার, দুই বছর ধরে। অথচ এই তিনিই মৃত্যুর ৩৬ বছর আগে থেকেই অবগাহন করেছিলেন নীরবতায়।
১৯০১ সালের ৩০শে অক্টোবর এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। পিতা হীরেন্দ্রনাথ ছিলেন দার্শনিক ও থিওসফিস্ট, মা ইন্দুমতী— কলকাতার খ্যাতনামা পটলডাঙা মল্লিক পরিবারের সন্তান। তাঁর বেড়ে ওঠা ছিল বই, দর্শন বিষয়ক আলোচনা আর বিতর্কের আবহে।
তাঁকে পাঠানো হয়েছিল বারাণসীর অ্যানি বেসান্টের থিওসফিকাল স্কুলে। সেখানে ইংরেজি, সংস্কৃত— দুই ভাষাতেই পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরে পড়াশোনা করেন স্কটিশ চার্চ কলেজে, ইংরেজি বিভাগে। ডিগ্রি অর্জন না করেও তিনি পরে শিক্ষক হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে!
ভিডিও: বাংলা কথাসাহিত্যের হীরে-‘মানিক’ – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
তাঁর জীবনটাই যেন এক আশ্চর্য বিদ্রোহের গল্প। ভাষার অমনোযোগী ব্যবহার তাঁকে রুষ্ট করত। তাঁর অভিষ্ট ছিল ভাষাকে অমোঘ অস্ত্রের মতো ব্যবহার। তাঁর কবিতা “উট পাখি” তিনি ৩০ বার সম্পাদনা করেছিলেন দু’বছর ধরে!
তিনি বিশ্বাস করতেন— কবিতা চিন্তার শিল্প। সংস্কৃত ছন্দ, ইংরেজি ব্যাকরণ, জার্মান শব্দচয়ন— সব মিলিয়ে তাঁর ভাষায় ছিল মেধা, বৈদগ্ধ ও আবেগের এক আশ্চর্য বুনন।
তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গতাপ্রিয়। খ্যাতনামা অনেক কবি, সাহিত্যিক ছিলেন তাঁর সমসাময়িক, কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠতা রাখতেন না তাঁদের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা, কিন্তু আবার রবীন্দ্রবাদের ছায়া থেকে নিজেকে বের করে আনতেই তাঁর লেখালেখির ভিন্নতর অভিমুখ। নিজের কাব্যধারাকে নির্মাণ করতে গিয়ে ‘অসামাজিক’ হতেও তাঁর দ্বিধা ছিল না। (Sudhindranath Dutta)
তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা “পরিচয়” ছিল সেই যুগের সাহিত্যচিন্তার প্রাণকেন্দ্র। সুধীন্দ্রনাথের সুচারু সম্পাদনায় পরিচয় হয়ে ওঠে আধুনিকতাবাদের প্রগতিশীল মুখপত্র। তরুণ কবিদের উত্থানের মঞ্চে পরিণত হয় এই পত্রিকা, আর সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন তার সুদক্ষ পরিচালক।
তারপর নেমে এল নীরবতা। প্রায় ১৯৪০-এর দশক থেকে মৃত্যু পর্যন্ত— বারবার তিনি লেখালেখি থেকে সরে গেলেন। ১৯৩৪ থেকে ৩৭, ৪২ থেকে ৪৪, এমনকি ৫৭ থেকে ৬০— বছরের পর বছর তিনি চুপ করে থাকতেন। (Sudhindranath Dutta)
ভিডিও: মুক্তারামের রামকথা – জন্মদিনে শিবরাম
তবু নীরবতা মানে শূন্যতা নয়। এই সময়ে তিনি ছিলেন নিজের পুরনো লেখার সঙ্গে নিবিড় সংলাপে— চিন্তার গভীরে নতুন আর পুরনোর সংঘাতে সৃষ্টির অগ্নিরচনায় রত।
রবীন্দ্রনাথ একবার কবিকে মোরগ নিয়ে লেখার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন। আত্মবিশ্বাসী সুধীন্দ্রনাথ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে লিখে ফেলেন কুক্কুট কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেন, “তুমি জিতলে।”
কিন্তু জীবন তাঁর প্রতি কিছু নির্মম কৌতুকও করেছে। ক্রমে তিনি সামাজিক মঞ্চ থেকে সরে যান, বিক্রি করে দেন “পরিচয়” পত্রিকাও। শেষদিকে সম্পাদনা করেন The Marxian Way নামের ইংরেজি পত্রিকা। (Sudhindranath Dutta)
১৯৬০ সালের ২৫ জুন— খাওয়া শেষে হঠাৎ স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেন সুধীন্দ্রনাথ। তাঁর কবিতা নিছক ভাবপ্রকাশের বাহন নয়, এক আত্মানুসন্ধান। এই আত্মানুসন্ধানের জন্যই অনেকে তাঁকে তুলনা করেন ইউরোপীয় কবি টি.এস.এলিয়ট-এর সঙ্গে। দুজনের কবিতাতেই রয়েছে ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন আর নিঃসঙ্গতার এক অসাধারণ সংশ্লেষ। তাঁর মতে, “Poetry must be earned, not consumed.” তাই তাঁর কবিতা বুঝতে গেলে পাঠককেও বুদ্ধি, সংবেদনশীলতা ও ধৈর্য নিয়ে এগোতে হয়। (Sudhindranath Dutta)
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন এক নিঃসঙ্গ স্থপতি। তিনি শব্দ, ভাষা, ও ভাবনার অন্তঃসলিলা প্রবাহ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বতন্ত্র কাব্য-জগৎ। তাঁর কবিতা আজও পাঠককে চ্যালেঞ্জ করে, ধন্দে ফেলে, আবার নাছোড় আকর্ষণে টেনেও রাখে। (Sudhindranath Dutta)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।
