জীবনটা জীবিকার চেয়ে বড়, অনেক বড়। এটা ভুললেই সব গন্ডগোল। মন যখন সন্তান চেয়েছে, কথাটা তখন নতুন করে টের পেয়েছি। একটা বয়সে সন্তান শুধু মন নয়, শরীরেরও চাহিদা হয়ে ওঠে। কোথাও কোনও চাপ ছিল না আমার ওপর, ছিল শুধু নিজের মনের টান। সেই টানেই সন্তানেরা এসেছে একে একে। সইফ, সাবা, সোহা।

‘আরাধনা’-র কাজ শেষ হওয়ার আগেই আমি সইফ-সম্ভবা। কেরিয়ারের সফলতম সময় সেটা, তবু আমার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। কারণ, আমি সব সময় বিশ্বাস করেছি, একজন মহিলার জীবনে যে যে ভূমিকা পালন করার থাকে, সে সংসারে হোক বা কেরিয়ারে, তার সবেতেই সফল হওয়ার জন্যে অতি-মানব হতে হয় না। পরিবার পাশে দাঁড়ালে, সঙ্গে থাকলে, কাজটা বরং অনেকটা সহজ হয়ে যায়। সইফ হওয়ার পর করেছি ‘অমর প্রেম’ (১৯৭২), সাবা হওয়ার পর ‘মৌসম’ (১৯৭৫), সোহা হওয়ার পর ‘গৃহপ্রবেশ’ (১৯৭৯)। কই, কিছু তো পাল্টায়নি, কেরিয়ারও শেষ হয়ে যায়নি!

বড় করার সময় বাচ্চাদের টেরই পেতে দিইনি যে ওদের বাবা-মা সবাই চেনে-জানে এরকম বিশেষ কেউ। সইফকে যখন স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছি, জিজ্ঞেস করেছে, তোমার বাবা-মার নাম বল। “আব্বা অ্যান্ড আম্মা”, নির্বিকার উত্তর দিয়েছে সইফ। বাচ্চাদের সময়ও দিতে পেরেছি যথেষ্ট, হৈচৈ করেছি সপরিবার। আবার কাজেও গিয়েছি সময় মতো। মা কাজের সময় বেরিয়ে যায়, আবার ফেরে যখন তখন মজা করে। এই দেখতে দেখতে আমার বাচ্চারা বড় হয়েছে। এখন সইফ-করিনার ছেলে তৈমুর, সোহা-কুনালের মেয়ে ইনায়াও তাই দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে। আর আমি তৈমুর-ইনায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবি, জীবনে নাতি-নাতনির হাসিমুখ দেখার চেয়ে বড় আনন্দ আর কি কিছু আছে?

আক্ষেপ শুধু একটাই। সিনেমায় আমার ওই অদ্ভুত হেয়ার স্টাইলের জন্যে। আমার ছেলেমেয়েরা এখন পুরনো ছবি দেখতে দেখতে হেসে কুটোপুটি খায়। কিন্তু তখন অনেক চেষ্টা করেও কেউ আমাকে কিছু বোঝাতে পারেনি। ‘অনুপমা’-র সময় হৃষীদা আমাকে বলেছিলেন, যে চরিত্রটা করছ, তার বাবা তাকে অবহেলা করে। সে কি ওইরকম করে চুল বাঁধবে? তুমি চুলের ধরনটা পাল্টাও। আমরা তোমাকে খুব ভালো একটা ব্যাকলাইট দিচ্ছি। দেখ, সুন্দর দেখাবে। কেন যে কথাটা কানে তুলিনি!
***
না, ঠাট্টা ছেড়ে সত্যি কথাটা বলি। টাইগারের চলে যাওয়াটা, আমাকে একা ফেলে যাওয়াটা, মেনে নেওয়া খুব সহজ হয়নি আমার পক্ষে। সেদিন একটা অনুষ্ঠানে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ বলছিলেন, টাইগার ২০১১ সালে চলে গেলেও টাইগারের ভাবনা-চিন্তা নাকি এখনও খুবই প্রাসঙ্গিক। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!
[the_ad id=”266918″]
টাইগারের খেলোয়াড়ি মন, সূক্ষ্ম রসবোধ, সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের রসিকতা, ওয়ান লাইনার, খুব মিস করি সেগুলো। অনেক দিন ধরেই ক্রিকেট খেলাটা জানি, ভালোবাসি। কিন্তু এখন যত ক্রিকেট দেখি, ক্রিকেট নিয়ে যত বই পড়ি, টাইগার বেঁচে থাকতে তার কিছুই করিনি। তখন ক্রিকেট এত খেলাও হত না, এত বইও লেখা হত না বোধহয়। টাইগারের কত গল্প, কত দুর্দান্ত ইনিংসের কথা জানতে পেরেছি নতুন হাতে আসা সব বই পড়তে পড়তে। আর খেলা থাকলে আমি তো টিভি ছেড়ে নড়তেই পারি না আজকাল। মাঠের মধ্যে কী চলছে সেটা আগের চেয়ে এখন যেন অনেক ভালো বুঝি।

খেলা দেখতে দেখতে টাইগারকে আজকাল খুব মিস করি। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি মিস করি, যখন কোনও কঠিন বা জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে টেরও পাই, টাইগার এই অবস্থায় আমাকে কী করতে বলত। বুঝতে পারি, টাইগারের শরীরটাই শুধু উপস্থিত নেই। মনের মধ্যে সে আছে, সব সময় আছে। তবু বিশাল কোনও পার্টিতে আজও টাইগারকে ছাড়া যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। কিছুতেই পারি না একা যেতে।

স্টার্ট সাউন্ড, ক্যামেরা আর কাট – এগুলো চিরকাল আমার সবচেয়ে প্রিয় শব্দ হয়ে থেকেছে। এই শব্দগুলোর মাঝখানে যে সময়টা, সেটা আমাকে একটা সাধনার জগতে নিয়ে গেছে। তার জন্যে আমি সাজলাম-গুজলাম, রিহার্সাল দিলাম, সব কিছু করলাম। কিন্তু তার পর – শ্যুটিং শেষের পর – সিনেমার যে জগত, সেখানে নিজেকে কেমন যেন বেমানান মনে হয়। চিরকাল।
[the_ad id=”266919″]
প্রিমিয়ারে যাওয়া, নেটওয়র্ক করা, পাবলিসিটির জন্যে পত্র-পত্রিকায়-টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া, এগুলোতে একেবারেই স্বচ্ছন্দ নই আমি। চব্বিশ ঘণ্টার একটা দিনে এসব করার সময় কখন? কাজের ব্যাপারে আমি সাঙ্ঘাতিক সিরিয়াস। কিন্তু নিজেকে, আমার স্টারডম, এই তারকা সত্ত্বাকে… না সিরিয়াসলি নেওয়া সম্ভবই নয় আমার পক্ষে। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।