‘গান তৈরি করবার সময় তাঁর কাছে বসে থেকে আমার বারবার মনে হয়েছে যে সুরের পাগলামিকে তিনি কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারছেন না;- খাবার তাড়ায়ও না, কাজের তাড়ায়ও না। একটা গানের সুর দিচ্ছিলেন, সেটা হচ্ছে ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’। সুর অভিমানিনী প্রেয়সীর মত মুখ ঘুরিয়ে বসল, মানভঞ্জনের পালা শেষ করে কবির মন যখন সুরকে লক্ষ্য করে বললে, ‘আচ্ছা নাও, তোমার হাতে আমার বাণী সমর্পণ করলুম’ – অমনি গানটি তৈরি হলো; কথা বললে আমি ধন্য, সুর বললে আমি পূর্ণ। আমার মূল বক্তব্য এই গানগুলি সম্বন্ধে এই যে, মধ্যযুগের কবিদের সঙ্গে বাণীর ভাবের মিল থাকতে পারে কিন্তু গান হিসেবে অর্থাৎ শিল্পসৃষ্টির হিসেবে কবির গানগুলিকে বোধহয় আরও উচ্চস্থান দেওয়া যেতে পারে। অন্ততঃ আমার এই মনে হয়, আর ‘বুঝিবে কি ধন রসিক যে জন’!

আজ কবির গানকে আপামর বাঙালি-সহ সকলেই যে নামে চেনে সেই ‘রবীন্দ্র-সংগীত’ নামটি তিনিই প্রথম ১৯২৯ সালে এই নিবন্ধের শিরোনামে লিখে প্রকাশ করেছিলেন। এর আগে কেউই রবীন্দ্রসংগীত কথাটি ব্যবহার করেননি। এরপর রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে তাঁর নামটিও যেন ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল। ‘ফাল্গুনী’র উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া এই উৎসর্গীকৃত প্রাণ সম্পর্কে লিখেছিলেন,
‘সেই বালকদলের সকল নাটের কাণ্ডারী
আমার সকল গানের ভাণ্ডারী…’
এমনকি ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের নতুন গানের বই ছাপার কালে বইয়ের নাম নিয়ে সুধীরচন্দ্র করের উপর দায়িত্ব পড়েছিল বই প্রস্তুতির তত্ত্বাবধানের। তিনি এই ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’র কাছে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দেন। যেমন একটি, ‘গুরুদেব শুধু নাম সম্বন্ধে একটু মত দিয়েছেন। নাম আপনি ঠিক করিয়া জানাইবেন। সূচীর উপর যদিও আমি কাজ চালাইবার মত একটা নাম লিখিয়াছি তবু সেইটাকে কিছু মনে করিবেন না। আপনি একটা নাম ঠিক করিয়া লিখিবেন। ভূমিকা গুরুদেব যখন কিছুই লিখিয়া পাঠান নাই তখন বোধহয় সেটা বাদই যাবে। আপনি এ সম্বন্ধে সঠিক জানিবার জন্য চিঠিতে গুরুদেবকে কিছু না হয় লিখিয়া পাঠাইবেন।’

এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে ‘গীতবিতান’ নামটি কি তবে কবির সকল গানের কাণ্ডারীরই দেওয়া? কেন না সুধীরচন্দ্র কর কিন্তু তাঁকেই অনুরোধটি করেছিলেন। সে কথা স্পষ্ট ভাবে জানা যায় না।
এরপর এল সেই অপ্রত্যাশিত দিনটি। ১৯৩৫ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখ। ঠিক তার একটি বছর আগে বড়ো অভিমান নিয়ে কবির ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’ শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে জোড়াসাঁকো চলে আসেন, আর ফিরে যাননি। খবর এল তাঁর দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবার সংবাদ। শান্তিনিকেতন মন্দিরে উপাসনায় বসলেন কবি। সেদিন দিনের অবসানে আচার্যের আসনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এই আশ্রমকে আনন্দনিকেতন করবার জন্য তরুলতার শ্যাম শোভা যেমন, তেমনি প্রয়োজন সংগীতের উৎসবের। সেই আনন্দ উপাচার সংগ্রহের প্রচেষ্টায় প্রধান সহায় ছিলেন ‘তিনি’। একথাও বলেছিলেন, তাঁর কবিপ্রকৃতিতে তিনি যে গান করেছেন, সেই গানের বাহনও ছিলেন ‘তিনি’। শেষে সেদিন শোকের উপাসনায় তাঁর দানকে আনন্দেরই রূপ হিসেবে দেখতে বললেন।

এরপরই সেই অমোঘ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল কবির কন্ঠে, ‘যতদিন ছাত্রদের সংগীতে এখানকার শালবন প্রতিধ্বনিত হবে, বর্ষে বর্ষে নানা উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন চলবে, ততদিন তাঁর স্মৃতি বিলুপ্ত হতে পারে না। ততদিন তিনি আশ্রমকে অধিগত করে রাখবেন।’
সেই অকাল প্রয়াত মানুষটিই একবার একটি চিঠিতে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন এমন,
”দ-এ হ্রস্ব ই — ন-এ কার,
— ন-এ দ-এ র-ফলা,
বিফল জীবন মম হল আজি স-ফলা…”
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
3 Responses
লেখাটি পড়ে সম্বৃদ্ধ হলাম।
Satyi bhalo laglo
ঋদ্ধ হলাম —-খুবই ভালো লেখা — ধন্যবাদ জানাতেই হবে