আজকের দিনটা খুব চমৎকার। ছেলের স্কুল নেই। ওরও বেরবার নেই কোথাও। রাতে ঘুমের মধ্যেই বৃষ্টির শব্দ পেয়েছিল। বঙ্গোপসাগরে ভয়াবহ নিম্নচাপের কথা কাল রাতের খবরে বলেছিল না? সকালে উঠে দেখল, চারদিকে জল থইথই করছে। ওর দশতলার ফ্ল্যাট থেকে মনে হচ্ছে ওরা একটা নদীর ওপর হাউস বোটে ভেসে আছে। নদী! হ্যাঁ একটা নদীর কাছে ওর যাওয়ার কথা অনেকদিন থেকে। সরকারী রেকর্ড বইয়ে নদীটার অন্য নাম থাকতে পারে, কিন্তু পৃথিবীতে দু’জন মানুষের কাছে তার নাম ঝিল্লি নদী। সেই ঝিল্লি নদীর কাছে পৌঁছতে গেলে তাকে অবন্তীনগর যেতে হবে। অবন্তীনগরে এখন ডাইরেক্ট বাস সার্ভিস। নাহ, এবার তাকে একদিন যেতেই হবে অবন্তীনগরে।
মাঝের কটা মাস যা গেল! মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার পর শরীর খুব ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পাচ্ছিল। কিন্তু চিড়িয়াখানার ঘটনাটার পর সে আবার টুকরো টুকরো হয়ে গেল। এক সপ্তা শুয়ে শুয়ে শুধু কেঁদেছে ঝিল্লি। তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। একদিন ব্যাগ গুছোতে গিয়ে একটা কার্ড উঠে এল হাতে। অর্ণব মুখার্জি, রেনবো ক্রিয়েশনস। কে অর্ণব মুখার্জি? কীসের রেনবো ক্রিয়েশনস ? কার্ডটা উল্টিয়ে দেখল উল্টোপিঠে বিদিতার নাম লেখা। তখন কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে সেই অল্প সময়ের দেখা হওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। ফোন করে দেখবে নাকি একবার? এর আগেও হয়তো দু-একবার ফোন করার কথা ভেবেছে ঝিল্লি, কিন্তু করে উঠতে পারেনি। তখনও মনে মনে ও বড়লকের আদুরে বৌ হয়েই ছিল। নিজেকে বিবাহবিচ্ছিন্না সিংগল মাদার হিসেবে কল্পনা করতে পারছিল না। কিন্তু মিথিলেশ যখন সামান্য চিড়িয়াখানার অ্যাপয়েন্টমেন্টটাই রাখতে পারল না, তখন ওর পৃথিবীটাই যেন চুরমার হয়ে গেল। তখন ও বুঝতে পারল সত্যিই ও কতটা একা। ফোনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা আর মেসেজ পাঠানোর বাইরে মিথিলেশের বন্ধু হয়ে ওঠার কোনও ক্ষমতাই নেই। ঝিল্লি অবশ্য নিজে জানে না, বন্ধু না প্রেমিক, ঠিক কী ভাবে ও মিথিলেশকে চেয়েছিল। ওর শেষ আশা যখন চলে গেল, তখন ও অর্ণব মুখার্জিকে ফোন করল।
সেদিনটা ছিল ২৬ জানুয়ারি। অরুণাভ রায়াকে নিয়ে মন্দারমণি গেছে। অরুণাভর সঙ্গে ওর অলিখিত একটা চুক্তি হয়েছে , ওরা থাকতে সে কখনওই রায়াকে নিয়ে এ বাড়িতে আসতে পারবে না। সেদিন ছেলের নেমন্তন্ন এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে। ছেলেকে সেখানে ছেড়ে ঝিল্লি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। সামনেই একটা মাঠে কোনও একটা স্কুলের স্পোর্টস হচ্ছে। সাদা শার্ট আর শর্টস পরা বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে। লালনীল ছোট ছোট পতাকা, ব্যান্ডের বাজনায় মনটা খুব ভালো হয়ে গেল ঝিল্লির। এতবড় একটা আকাশ, রোদে ভাসছে। এসবের মধ্যে তার একটুও জায়গা হবে না? নিশ্চয় হবে। ধাঁ করে ও ব্যাগ থেকে কার্ড বার করে অর্ণব মুখার্জি, রেনবো ক্রিয়েশনসকে ধরল। কিন্তু দিনটা যত সুন্দর ছিল, অর্ণব মুখার্জির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ঠিক তেমন ছিল না। ঝিল্লি ভেবেছিল পৃথিবীর প্রতিটা লোক তাকে মনে রাখবে মিথিলেশের মতো। ফোন পেলেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠবে ‘আরে ঝিল্লি, কী খবর, কেমন আছিস?’

অর্ণব তাকে প্রথমে চিনতেই পারল না। ঝিল্লির অমনি চোখে জল এসে গেল। তার মনে হল ফোনটা কেটে দেয়। কিন্তু সামনের এপ্রিল থেকে তাকে এক অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হবে যে। যার জীবন এই বাঁকে এসে দাঁড়ায়, তাকে অভিমান মানায় না। সে চোখ মুছে গলা ঝেড়ে বলল
– মনে পড়ছে না? আমি বিদিতার বন্ধু, ঝিল্লি।আপনাদের সঙ্গে কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে দেখা হয়েছিল।
– ও, আচ্ছা। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি আপনাকে কাল ফোন করি? আমি আসলে একটা পার্টিতে আছি।
সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসছিল তারস্বরে বাজা ভাংড়া পপ, চিৎকার, হাসি। অর্ণবের জড়ানো স্বর বলছিল সে খুব ভুল সময়ে ফোন করেছে।
– সরি, আমি ছেড়ে দিচ্ছি।
বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল ঝিল্লি।
সেই মুহূর্তে ফোনটা ওইভাবে কাটতে পেরে খুব ভালো লাগলেও, তারপর সারাটা দিন একটা ভুলের স্বাদ তার অন্নব্যঞ্জনে বারবার ফিরে ফিরে আসছিল। সেদিন শুধু নিজের জন্যে ঝিল্লি অনেকরকম রান্না করেছিল। আর তার বাজার করেছিল নিজের হাতে। বাজার করার সময় যদিও প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছিল সবাই তাকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু এর বেশি, অনেক অনেক বেশি কি জীবন তাকে ঠকায়নি? নিজের হাতে বাজার করা ও রাঁধা সেইসব তুচ্ছ কিন্তু প্রিয় পদগুলি– বড়ি দিয়ে যুক্তিফুলের চচ্চড়ি, পাঁপড়ের ঝাল, ঝুরো পোস্ত, ফুলচিংড়ির বড়া আর ডিমের অমলেট কেটে পিস করে পেঁয়াজ, লঙ্কা, ধনেপাতা দিয়ে মাখা মাখা ঝাল। টিফিনে বানিয়েছিল মূলোর পরোটা। প্রতিটা রান্নার মধ্যে তার কেটে দেওয়া ফোন চুলের মতো মিশে রইল।
রাতে অরুণাভ মন্দারমণি থেকে ফোন করল। সেই ফোন আসতেই মেজাজ হারাল ঝিল্লি। তার মুখে উঠে এল বস্তির ভাষা। সে অবাক হয়ে দেখল জীবন তাকে দিয়ে কত কী করিয়ে নিচ্ছে। আরও কত কী করিয়ে নেবে কে জানে! ঘুমন্ত ছেলেকে বুকে চেপে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখল সে একটা নদীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নীলচে রঙের দুপুর। কালো মেঘের ভারে আকাশ নদীর ওপর ঝুঁকে এসেছে। ঝিল্লির সমস্যা হল সে ওপারে যেতে চায়, কিন্তু একটাও নৌকো নেই। এদিকে সে আবার সাঁতার জানে না। হঠাৎ দেখল, ওপারে একটা লোক ফোনে কাউকে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষটাকে খুব চেনা লাগল তার। সে চেঁচিয়ে ডাকল ‘এই যে শুনছেন, একটা নৌকা পাঠিয়ে দেবেন?’ লোকটা ফোন থেকে এ কথায় মুখ ফেরাল, তারপর আবার মগ্ন হয়ে গেল ফোনে। আর সেই এক ঝলক দেখেই ঝিল্লি তাকে চিনতে পারল। সে চেঁচিয়ে ডাকল।
– মিথিলেশ, তুই কি আমায় ফোন করছিস? এই তো আমি, এসে গেছি। তুই একটা নৌকা পাঠিয়ে দে প্লিজ।
মিথিলেশ ফিরেও তাকায় না। বৃষ্টি নেমে গেল। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঝিল্লি ছুটছিল। কোথাও একটা চালাঘর পর্যন্ত নেই। ছুটতে ছুটতে সে হঠাত কীসে হোঁচট খেয়ে পড়ল। অমনি ঘুমটা ভেঙে গেল ঝিল্লির।
***
ঘুম ভাঙার পর ঝিল্লি অনেকক্ষণ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। গরমকাল নয় যে, ঘুরন্ত পাখার ব্লেডের দিকে তাকাবে। সব জানলাও বন্ধ, বাইরে দেখার উপায় নেই। কালকের দিনটা যতই অসফল হোক না কেন, লেপের তলা থেকে বেরিয়ে পড়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। শীতের লেপের উষ্ণতা জীবনের চরম সংকটকেও কিছুক্ষণের জন্যে সরিয়ে রাখতে পারে। ঝিল্লি অনেকক্ষণ সেই ওম নিল শুয়ে শুয়ে। তাছাড়া আজ ওঠার তাড়া নেই। কালকের রান্না অনেক রয়ে গিয়েছে। গরম করে নিলেই চলবে। প্রেশার কুকারে একটু ভাত করে নেবে ছেলের জন্যে আর মাছভাজা। শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ স্বপ্নটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল ঝিল্লি। ওটা তো নিশ্চয় ঝিল্লি নদী। অবন্তীনগরের ঝিল্লি নদী। কিন্তু মিথিলেশ ওকে চিনতে পারল না কেন? ও কি অন্য কাউকে ফোন করছিল? মিথিলেশ বলেছিল তার এক ছাত্রী তীর্ণা জোর করে তাকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে চেয়েছিল। কই, ঝিল্লি তো কোনওদিন ফেসবুকে মিথিলেশকে পায়নি! সেই মেয়েটিকেই কই ফোনে ধরতে চাইছে মিথিলেশ? আরও কত কী ভাবছিল, কিন্তু হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠতে তার ভাবনা ছিঁড়ে গেল। এত সকালে কে ফোন করবে তাকে? অরুণাভ, এমনকি মিথিলেশ হলেও অসহ্য। ফোন ধরার আগে সময় দেখে অবাক সে। এত বেলা পর্যন্ত সে শুয়ে আছে! অচেনা একটা নম্বর।
– হ্যালো
– গুড মরনিং, আমি অর্ণব, অর্ণব মুখার্জি। সরি কাল ভালো করে কথা বলতে পারিনি। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।