গল্পটা শেষ করতে হবে খুব দ্রুত। টানা বলে যেতে পারলে ভালো। দম টানার সময়টুকুও যদি বাঁচিয়ে নেওয়া যায় দু একটা কথা বলা যাবে আরও। সময়সীমা সাত মিনিট। কুড়িয়ে বাড়িয়ে কি চুরি চামারি করে আরও মিনিট খানেক বড় জোর। তার মধ্যেই। গল্পটা মোটামুটি তৈরি আছে। সাজিয়ে নিতে হবে শুধু। সবটা বলা যাবেনা। সম্ভব নয় কোনওমতেই। কী বলব, কী এড়িয়ে যাব, কতটা বলা ঠিক, কোন ঘটনা একটু কেবল ছুঁয়ে চলে যাব এগুলো-ই গুছিয়ে নিতে হবে মনে মনে। ঘটনাক্রম সাজাতে হবে। সেখানে খানিকটা কারসাজি খুবই জরুরি।
শুরুটা কোথা থেকে। কুন্তল স্যরের ব্যাপারটা একেবারে বাদ দিয়েই শুরু করা যাক আপাতত। বিয়ের আগের ঐ চ্যাপ্টারটা এতদিন পর পোড়া ছাইএর মতো উড়িয়ে দেওয়াই যায়। স্যরের তো আগে থেকেই একটা বিয়ে ছিল। আমিই শুধু জানতাম না। আমার সঙ্গে সব চুকে বুকে যাবার পর যে বিয়ে সেটাও যখন টিকল না, তখন সেই ডানাকাটা পরীর মতো বউ মধুজার কথাও বলার বা কি দরকার। তাছাড়া মধুজার সঙ্গে আমার পরে খানিকটা বন্ধুর মতোই যেন… এটা অবশ্য যে শোনে সেই আমার ন্যাকামি বলে। অথচ মধুজা নিজে আমার বুদ্ধির তারিফ করে। ঠিক সোজাসুজি নয়, তবু বলে তো — তোর যে এতটা বুদ্ধি ইন ফ্যাক্ট আমি বুঝিই নি। খানিকটা বোকা মতোই যেন ভাবতাম আমি তোকে, কনফেস করছি তোর কাছে খোলাখুলি। আমি ওর কথা কিছু বুঝছিনা দেখে তখন পরিস্কার করে বলেই দিল — এই যে ফাইনালের আগে মাস খানেক ট্রায়াল দিলি, আমার মাথায় আসেইনি। মধুজা বলে চলে — এই ধর আমি – সকলে তো বলে, সত্যি বলতে আমিও নিজেকে বেশ স্মার্ট আর প্র্যাক্টিকালই ভাবি, অথচ প্রথমেই সই, রেজিস্ট্রি, আর যত রিসেপশনের চক্করে পড়ে গেলাম। মধুজার কথাগুলো ঠিক ধরতে পারিনি আমি। প্রথমে একটু খুশি মতো। পরে খুব খারাপ লেগেছিল। তখনই কিছু বলতে পারিনি। পরে বলেছি আমার সঙ্গেও কুন্তল স্যরের কিন্তু বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে না করে ফুর্তি লোটার মেয়ে আমি নই। মন্দিরে গিয়ে সিঁদুর দিয়ে … হেসে গড়িয়ে পড়েছিল মধুজা।
আচ্ছা যদি ঠিকঠাক বিয়েই হবে তোর তবে ডিভোর্স করলি না কেন কোর্টে গিয়ে সুপ্রতীমকে বিয়ে করার আগে। সত্যি বিয়ে হলে বাথরুমে গিয়ে আয়না দেখে একটু শ্যাম্পু আর জল দিয়ে সিঁদুর ধুয়ে দিলেই কি ঝামেলা চুকে যেত সোনা?
মধুজার সঙ্গে আমার এই সব কথা এত ডিটেলে এই গল্পে রাখা পুরোটাই অপচয়। অনেকটা সময় ফালতু খেয়ে নিল এটা। সুপ্রতীমের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যাপারটাই হয়তো চেপে যেতাম। মধুজাই তুলল প্রসঙ্গটা। উঠলই যখন কথাটা, ছোট করে বলি একটু। সম্বন্ধটা বেশ এগিয়ে গেছে তখন। আধা সরকারি কোম্পানিতে অফিসার সুপ্রতীম। আমাদের সম্বল বলতে পুরনো বাড়িটা। কোনওক্রমে উঠোনে একটু ঘিরে আলাদা রান্না আর কলঘর করে ভাড়া দেওয়া। সব দেখে শুনেই এগিয়েছে ওরা। এর মধ্যে হঠাৎ ওর বৌদি ফোন করে দেখা করতে চাইল – একাই আসিস কিন্তু।
– একা এখন বেরতে দেবেনা বাবা। তুমি বলে দেখো না হয়।
–স্যান্ডেল কিনতে আসছিস আমার সঙ্গে, কি দর্জির মাপ টাপ কিছু বলে বেরিয়ে আয়। ফালতু ন্যাকামি রাখ। যখন ডবল বয়সের বিয়েওলা কোচিং এর মাস্টারের সঙ্গে পালিয়েছিলিস তখন বাপের পারমিশন নিয়েছিলিস?
শক্ত হয়ে গেলাম তখনই।
কফির কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে বৌদি বলল আমি আর প্রতীম ছাড়া তোর পাস্ট আমাদের বাড়ির কেউ জানেনা। খোঁজ খবর করে আমিই জোগাড় করেছি সব খবর। নিজের দরকারেই। ফস করে বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে দরকার মানে আমাকে ব্ল্যাকমেল?- ধর তাই। এক আধটা তাস তো আমাকেও হাতে রাখতে হবে। ধরা তো আমরাও পড়ে যেতে পারি। আমার কেমন কাঁপুনি মতো লাগছিল। বৌদি সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল তুই আমাদের, মানে আমাকে আর প্রতীমকে ঘাঁটাসনা। আমরাও মুখ খুলব না। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমি হাত মেলাতে দু সেকেণ্ডও দেরি করিনি। কারণ এ নিয়ে সময় নষ্ট করতে গেলে শেষ করতে পারব না গল্প।
তাড়াটা যেন আমারই বেশি। শ্রাবণের মাঝামাঝি দিন ফেলা হল। সেই সুতো ধরে ফুলশয্যার আগে স্ত্রী আচারের সময়ে বৌদি চোখ মটকে বলেছিল ভাদ্রের আগেই বিয়ে টিয়ে চুকে যাওয়া ভাল। একটা কেমন মস্তানি এসে গেল আমার হাবেভাবে। বাবাকে বললাম একদম নমো নমো করে সব ব্যবস্থা করও। নমস্কারি – টারি সব কাটিয়ে দাও। দেবার মধ্যে শাশুড়ি আর বুড়ি দিদিশাশুড়ির দুটো গরদ। ব্যাস। সুতোর মতো চেন একটা গলার, ব্রোঞ্জের চার গাছি চুড়ি আর কানের পল্কা ঝুমকো শুধু। মায়ের একটা বালা ভেঙেই হয়ে গেল। দেনাপাওনার এসব কথা সামনে থেকে বলেছে বাবা। আড়াল থেকে শিখিয়েছি আমি। তবে শেষ অব্দি আমাকে লুকিয়ে বাবা একটা গোদরেজ একশ পঁচাশি লিটার আর নগদ পঞ্চাশ হাজার শাশুড়ির হাতে দিয়ে এসেছে। জানতে পেরেও বলিনি আর কিছু। মায়া হল। চলেই তো যাচ্ছি।
রাত ঘন হয়ে উঠছিল। ঘরের বাতাস রজনীগন্ধার গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল। ঘুমের ভান করে দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়েছিলাম নিঃসাড়ে। কতক্ষণ কাটল কে জানে। সুপ্রতীম আস্তে আস্তে উঠে বসল টের পেলাম। একটু অপেক্ষা করে খুব সাবধানে খাট থেকে নেমে একটুও শব্দ না করে ছিটকিনিটা খুলে বেরিয়ে গেল। খুলে বেরিয়ে গেল।
মা‘কে আবছা আভাস দিয়েছিলাম বৌদি আর সুপ্রতীমের ইয়ের ব্যাপারে। মা বলেছিল এরকম কম বেশি অনেক সংসারেই। বাঁজা বৌদি কি কাকিমা টাকিমার সঙ্গে থাকে একটু। নিজের একটা দুটো হোক, গায়ে পিঠে উঠুক, কেটে যাবে বদ বাতিক যত। মা বলে মানুষটাকে সংসারে কেউই আমরা তেমন গুরুত্ব দিইনি কোনওদিন। কিন্তু সেদিন মা‘র এই কটা কথা বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলাম।
ও বাড়িতে যে কত রকম টানাপোড়েন আর কত রকম ঘাপলা। সব ডিটেলে বলতে গেলে আমার গল্প আর শেষ হবেনা। সুপ্রতীম আর বৌদির রিলেশনের ধাক্কাটা সামলে নিয়েছিলাম। তবে এটাও ঠিক ঠাণ্ডা কফিশপে বসে একটা ঘটনা শোনা আর নিজে তার ভেতরে ঢুকে পড়া এক নয়। গল্পটা এখান থেকেই শুরু হোক। আমার বধূবরণ থেকে।
এই বৌদি আমার মেজ জা। বড়জন মারা গিয়েছিল বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়। কানাঘুষো রটেছিল কিছু। থানা পুলিশ। বড় ভাসুর সে সময়ে নাকি বিস্তর কান্নাকাটি, ঘুমের ওষুধের নাটক অবধি। এই মরতে যাচ্ছে তো এই গেরুয়া নিচ্ছে। শেষ অবধি নাকি বাচ্চা মেয়েটার মুখ চেয়েই। তখন বছর তিনেকের, এখন তার মানে এগারো বারো। দেখে মনে হয় নয় দশ। বাড় বৃদ্ধি নেই কিছু। খয়াটে, কেমন ভীতু ভীতু। বৌদি দেখলাম এই মেয়েটা কাছে এলেই কেমন সিঁটিয়ে মতো যায়। কেন কে জানে বাচ্চাটাকে দেখেই আমার বুকটা টনটন করে উঠল। কে আছে ওর এই দুনিয়ায়। আমাকে তো শুধু বরের বেচাল সামলাতে হবে। আর এই মেয়েটার? মা নেই। কেন নেই? বাবার বদমায়েশিতে। যায় কার কাছে তবে?
ও বাড়ি গিয়ে দেখি বৌদির লোক দেখানো ঢং ষোল আনা। লাল পাড় সাদা কোরা নতুন শাড়ি পেতেছে সদর থেকে উঠোন, সিঁড়ি পেরিয়ে ঘরের চৌকাঠ অবধি। এসব কথায় ফালতু সময় নষ্ট হচ্ছে। বৌদি আর সুপ্রতীম-এর জুয়া খেলার মাঝে আমি সাজানো ঘুঁটি। কুন্তল স্যরের লাথি খেয়েও শিক্ষা হয়নি আমার। কিন্তু ঐ যে সাদা কাপড়ে আলতা ছাপ ফেলে ঢুকলাম ঘরে — জানি সে ঘরের ভিত ফোঁপড়া, তবু চোখটা ভিজে উঠছিল। আর তারই মধ্যে ঐ পুঁচকেটা এসে আঙুলটা ধরল — কি ঠাণ্ডা ওর ছোট্ট হাতটা – আমার বুক ফাটিয়ে সব কান্না তখনই। সামলাতে গিয়ে বাচ্চাটাকেই আঁকড়ে ধরলাম বুকে। আশেপাশে অনেকে দেখলাম চোখ মুছছে। পুরো সিরিয়ালমার্কা হল যদিও ব্যাপারটা তবু পয়লা দানেই বৌদিকে অনেকটা পেছনে ফেলে দিলাম। এই জেতার কি দাম। আমার চূড়ান্ত হেরে যওয়ার আসল খেলার জন্যে সামনে গোটা রাত। যাকে নাকি বলে ফুলশয্যা। বাইরের লোক সব চলে যেতে, নিজেদের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকল। কী সব কড়ি খেলা টেলা তারপর। কুলোয় খানিক আতপ চাল ফাল দিয়ে খানিক ধাষ্টামো। পুঁচকেটা সারাক্ষণ আমার গা ঘেঁষে। এক এক ঢিপি চাল থেকে ও–ই খুঁজে বার করে দিল গোটা সুপুরিগুলো আমার জন্যে। হঠাৎ বৌদির হাতটা টেনে ধরে বলে কাকিমণি তোমার কাছে শুই? নতুন মণি আর ছোটকা ফুলের ঘরে থাক। সুপ্রতীম আর বৌদির চোখে চোখে কথা হচ্ছে। শাশুড়িও যে সব জেনে ন্যাকা সেজে আছে বুঝে গেলাম। ঘর ভর্তি লোকের সামনে ঢং করে বলে আর আমার যে একা ভয় করবে দিদুন?
রাত ঘন হয়ে উঠছিল। ঘরের বাতাস রজনীগন্ধার গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল। ঘুমের ভান করে দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়েছিলাম নিঃসাড়ে। কতক্ষণ কাটল কে জানে। সুপ্রতীম আস্তে আস্তে উঠে বসল টের পেলাম। একটু অপেক্ষা করে খুব সাবধানে খাট থেকে নেমে একটুও শব্দ না করে ছিটকিনিটা খুলে বেরিয়ে গেল। খুলে বেরিয়ে গেল।
নতুন মণি – ডাকটা শেষ হবার আগেই আচমকা থেমে গেল। আমাকে এই মুহূর্তে গল্পটা শেষ করতে হবে। আর সময় বাকি নেই এক ফোঁটাও। লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে কোণায় রাখা ফুলদানিটা মাটিতে ঠুকে দু টুকরো করে লম্বা ধারাল কাচের ফালিটা নিয়ে বেরিয়ে দেখি গামছাটা ততক্ষণে পুঁচকেটার গলায় পেঁচানো হয়ে গেছে। টানতে যাবে, ধারাল ফলাটা গেঁথে গেল শয়তানিটার খোলা পিঠে। গামছার ফাঁসটা আলগা করে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে পড়লাম যখন রাস্তায় তখনই বুঝলাম গল্পটা ঠিক সময়ে শেষ করতে পেরেছি।
" data-author-type="
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 18
" data-author-archived="
Warning: Undefined array key "archived" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 19
">
Warning: Undefined array key "id" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 39
-"
Warning: Undefined array key "archive" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/html-layout.php on line 40
itemscope itemid="" itemtype="https://schema.org/Person" >
Warning: Undefined array key "img" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-avatar.php on line 4
Warning: Undefined array key "show_social_web" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-socialmedia.php on line 6
Warning: Undefined array key "show_social_mail" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-socialmedia.php on line 7
Warning: Undefined array key "show_social_phone" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-socialmedia.php on line 8
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 17
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 19
Warning: Undefined array key "type" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 21
Warning: Undefined array key "archive" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 37
Warning: Undefined array key "name" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-name.php on line 41
Warning: Undefined array key "job" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 10
Warning: Undefined array key "job" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 15
Warning: Undefined array key "company" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 17
Warning: Undefined array key "phone" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 26
Warning: Undefined array key "mail" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 36
Warning: Undefined array key "web" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-meta.php on line 46
Warning: Undefined array key "bio" in /www/banglalivecom_170/public/wp-content/plugins/molongui-authorship/views/author-box/parts/html-bio.php on line 8
2 Responses
দারুণ । জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে এরকম গল্প খুব কম পড়েছি।
খুবই ভাল গল্প। বিষয় ও স্টাইল দুই মিলেই।