তিব্বতে কৈলাস-মানস যাত্রার অনেক হ্যাপা। নানা রকম শাসন, অনুশাসন, একুশে আইন, বাইশে আইন পেরিয়েও শেষে রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের গেরোতে আটকে যেতে পারে যাত্রা। আমার এক হিমালয়প্রেমী বন্ধুর থেকে জানলাম যে আমাদের হিমাচলেও একখানা কৈলাস আছে। তাকে বলে চাম্বা-কৈলাস। হিমাচল প্রদেশের চাম্বা জেলায় এর অবস্থান। এই কৈলাসের পায়ের কাছেও আছে এক হ্রদ, যার নাম মণিমহেশ হ্রদ। যাওয়ার ব্যাপারে তিব্বতি কৈলাসের মতো ঝুট ঝামেলা নেই, তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা হলেই হল। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি যে মণিমহেশ যাত্রার প্রশস্ত সময় হোল জন্মাষ্টমির দিন থেকে রাধাষ্টমির দিন পর্যন্ত। কিন্তু ওই সময়ের প্রবল ভিড় এবং ধর্মীয় উন্মাদনা হিমালয়ের স্বরূপ আস্বাদনে বাধার সৃষ্টি করতে পারে, তাই ঠিক করি রাধাষ্টমির দু’একদিন পর থেকে হাঁটা শুরু করব। সেই মতো ব্যবস্থা করি।
রেলগাড়িতে হিমাচল ভ্রমণের সিংদরজা পাঠানকোট। সেখান থেকে বাসে চাম্বা শহর। দূরত্ব ১২০ কিমি। সময় লাগে ঘণ্টা পাঁচেক। বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই রাস্তা ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বমুখী। পথের ধারের গাছপালা বর্ষার জলে স্নান করে ঝকঝকে সবুজ। অনতিউচ্চ টিলাগুলো যেন ঘন সবুজ রঙের বাহারি চাদর মুড়ি দিয়ে উবু হয়ে বসে রয়েছে। অনেক নিচ থেকে উঠে আসা পাইন, ফার, দেবদারুর পাতা আলতো ছোঁয়া দিয়ে যায় বাসের জানালায়। তাদের কোন মাটিতে পা, দেখতে পাই না। শুধু মুখছোঁয়া বাতাস আর ঝিমধরা গন্ধ আবিষ্ট করে। মনে হয়, এই বিশুদ্ধ নিষ্পাপ আকাশ বাতাস আলো জল জঙ্গল সবার মধ্যে নতুন করে বেঁচে উঠি। বাসের ড্রাইভার সাহেবও বুঝি আমার মনের ভাবটি ধরে ফেলেছেন, তাই একখানা মোক্ষম গান চালিয়ে দিয়েছেন-“… আজ ফির জিনেকি তমান্না হ্যায়।”
অধিত্যকার ওপর মসৃণ চওড়া রাস্তা দিয়ে বাস চলেছে। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে নীলচে ধোঁয়ার মতো পাহাড় শ্রেণি। ছোট ছোট জনপদ, বাজার, দোকানপাট, মানুষজনের ওঠানামা। আড়াই তিন ঘণ্টা পর একটা বড়সড় জংশন মতো এলাকায় বাস দাঁড়ায়। ভিড়ভাট্টা, খাবারদাবার, প্রকৃতির ডাক। হঠাৎ আবিষ্কার করি, এখান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে হিমাচলের বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় শৈলশহর ডালহৌসির দিকে। আগে গিয়েছি সেখানে। মনে হয় যেন পরিচিতজন, এই রাস্তা ধরে গেলেই তার দেখা পাব।
প্রায় এক ঘণ্টা বিরতির পর বাস আবার ছাড়ে। এবার বুঝতে পারি বাস আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছে। গঞ্জ শেষ হয়ে আবার পিরপঞ্জাল হিমালয়ের অনাবিল প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে পথ। কখন বুঝি না পথ পাহাড় থেকে নামতে নামতে একেবারে ঝমঝমিয়ে বয়ে চলা নদীটির পাশে পাশে চলেছে। এই তবে ইরাবতী! এরই উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে চাম্বা শহর! বাস থেকে নদীর অন্য পাড়টা ছবির মতো দেখায়। একটা লোহার পুল দিয়ে বেগবতী রাভিকে টপকে চাম্বার বাস-আড্ডায় অবশষে যাত্রার প্রথম পর্বের সমাপ্তি।
“এখনও কিন্তু বেলা আছে, ভারমোর চলে যাওয়া যায় না? ওখানে তো থাকার জায়গা ঠিক করা আছে”- সঙ্গীর প্রস্তাবে খোঁজখবর করে দেখি গাড়ি ছাড়া উপায় নেই, অগত্যা সে ভাবেই রওনা হই। ভারমোরের আরেক নাম গদ্দেরান- যাযাবর পশুপালক গদ্দী উপজাতির দেশ। কিছুক্ষণ পথ চলে ইরাবতীর ঢেউয়ের দোলে নামি। নদী বাঁক নেয়। পথও ছুট্টে গিয়ে তার আঁচল ধরে। দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তি নামে দেহে- চোখজোড়া বুজে আসতে চায়। কিন্তু প্রকৃতি জাগিয়ে রাখে। এ বার ইরাবতী আমাদের ছেড়ে অন্য দিকে মোড় নেয়। পাহাড় থেকে লাফিয়ে নামে আর একজন সঙ্গী- বুধল বা ভুডল নালা। সে আবার ইরাবতীর সঙ্গে মিশে তাকে অন্য দিকে যাবার অনুমতি দিয়ে আমাদের পথের সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলো ভুডল ভ্যালি বা ভারমোরের দিকে।
চারিদিকে ঘন গাছগাছালিতে ছাওয়া উঁচু পাহাড়, তারই পায়ের কাছে বিছিয়ে আছে ভারমোর। সূর্য ডূবে গেছে পাহাড়ের পিছনে, ছায়া ঘনিয়ে আসছে উপত্যকায়- টিপ টিপ আলো জ্বলে উঠছে। গাড়ি আমাদের দোকানপাটওলা একটা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। এবার খোঁজ লাগাই কোথায় পিডব্লুডি বাংলো। আমি বলি পিডব্লুডি বাংলো- ওরা বলে লোক করম বাংলা। ভাষার এই ভুলভুলাইয়াতে কিছুক্ষণ সময় যায়। শেষমেশ খুঁজে পাই মাথা গোঁজার আস্তানা। পরের দিন সকালে সেই ঘরের দরজা খুলে মনটা প্রশান্ত এক আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। রাজার পথে তখনও লোকের ছোটাছুটি শুরু হয়নি। চারপাশে নিম্ন পীরপঞ্জালের ঢেউখেলানো শাখাপ্রশাখার পান্নাসবুজ বিস্তার। উপত্যকার আনাচ কানাচ থেকে চাপ চাপ মেঘ উঠে আসছে। উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের গা ছুঁয়ে আকাশের দিকে। আর আকাশে আলো ক্রমে আসিতেছে। সামনের বাতিস্তম্ভে ভুশন্ডির কাক তারস্বরে সকালের আগমনি গাইছে।
যে দেবীর নাম থেকে ভারমোর নামের উৎপত্তি, সেই ভারমোনি মাতার মন্দিরে আজ যাব। দেবীর নিবাস মূল রাস্তা থেকে চার কিমি চড়াই পথে পাহাড়ের ঢালে। ওখানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য দু’টি। প্রথমতঃ শরীরটাকে প্রাথমিকভাবে চড়াইপথে হাঁটার সঙ্গে খানিকটা খাপ খাওয়াতে, দ্বিতীয়তঃ মণিমহেশ যাত্রার আগে দেবীর অনুমতি নিতে। অনুমতি পেয়েও যাই, দর্শন শেষে বেরোবার সময় গর্ভগৃহের দরজার উপরের চৌকাঠে ব্রহ্মতালুটি ঠকাস করে ঠুকে গেল। ব্যথা লাগল ঠিকই, কিন্তু মনে পড়ে গেল- মস্তকে আঘাত, কার্যসিদ্ধি!
অতিরিক্ত মালপত্তর কেয়ারটেকার এর জিম্মায় রেখে প্রয়োজনীয় রসদটুকু পিঠঝোলায় ভরে শেয়ার জিপে করে রওনা হয়ে যাই এই পথের শেষ গ্রাম হাডসার। ১২/১৩ কিমি বৈচিত্রহীন পথ। পাহাড় কেটে। এক দিকে পাথরের দেওয়াল থেকে বর্শার ফলার মতো কাটা পাথরের খোঁচাগুলো বেরিয়ে রয়েছে। অন্য দিকে গভীর খাদের ও পাশে, পাহাড়ের ঢালে ঢালে প্রকৃতির রংবাক্সের খোপে খোপে কতরকম সবুজ, হলুদ, সর্পিল পথ, মেঘ আর মেঘভাঙা রোদ্দুর। এ পথে লোকজন বিশেষ ওঠানামা করে না। গাড়ির ভিতরে পাহাড়িয়া সুর শুনতে শুনতে পথ ফুরায়। পৌঁছে যাই হাডসার। রাধাষ্টমির তিথি চলে গেছে, ভিড়ভাট্টা কম। ভাঙা দানসত্রে বিনামুল্যে কিঞ্চিৎ জলযোগ সেরে হাঁটা শুরু করি। গন্তব্য ধানছো- ৬/৭ কিমি রাস্তা।

ভুডল নালার ওপর পাকা পুল পেরিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে থাকি। বাঁ হাতে ভুডল নালার খাত গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। প্রথম দিকে পথ মোটামুটি সহজই। এক দিকে পাহাড়ের পাথর কাটা শরীর, অন্য দিকে গভীর জঙ্গল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধাপে ধাপে নিচে নেমে নালা পার হয়ে ও পাশের পাহাড়ের গা বেয়ে আবার ওপরের দিকে রওনা হয়েছে। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে লোহার রেলিং দেওয়া। আস্তে আস্তে অনেকটা ওপরে উঠে আসি, ভুডল নালার সমতলে। এখানে নালার সম্পূর্ণ অন্য রূপ। এতক্ষণ যে জলধারা দেখছিলাম অনেক নিচে শীতার্ত অজগরের মত শ্লথ চলনে, এখানে সে যেন মদমত্ত উদ্দাম ঐরাবত। বিশাল বিশাল পাথরের কঠিন বাধাকে হেলায় অতিক্রম করে বীরবিক্রমে বইছে। কয়েকটা পলিথিন চাদরের অস্থায়ী আস্তানা। পথ এক পাক ঘুরে উপরের দিকে। দূরে পাহাড়ের মাথায় ঘন মেঘের ফাঁক দিয়ে অনিচ্ছুক রোদ্দুর উঁকি দিয়ে আবার পালাবার অছিলা খুঁজছে। পথচারী মানুষেরা একে অপরের কল্যাণ কামনায় “জয় ভোলে বাবা” ধ্বনি তুলছে। এগিয়ে চলি গন্তব্যের পথে। পথরেখা পরিষ্কার থাকলেও বিরাট বিরাট বোল্ডার কন্টকিত। বেশ কষ্ট করে পার হচ্ছি। মাঝে মাঝে পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, পকেটের কর্পূরের ডিব্বা শুঁকে আর অমিত শক্তিধারী সেই চলমান জলপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে শরীরের ব্যাটারিটা রি-চার্জ করে নিচ্ছি।
ধানচো আর বেশি দূরে নয়। চড়াই ক্রমাগত, কিন্তু তেমন তীব্র নয়। এ দিকে পিঠের বোঝাটাও বেশ ভারী ভারী ঠেকছে। একজন মালবাহকের আশায় সতৃষ্ণ নয়নে তাকাই। ধুপ ধুপ করে নেমে যাওয়া এক পাহাড়িয়া যুবকের কাঁধে ফেলা মোটা কাছির বান্ডিল দেখে আন্দাজ করি, নিশ্চয় মালবাহক। “কী ভগবান? ভক্তের বোঝাটি একটু বয়ে দেবে নাকি?” “হাঁ হাঁ, কিউ নহি?” বিট্টুর কাঁধে বোঝাটি যেই চাপিয়েছি, অমনি মনে হল এ বার একটু বসলে হয়। অস্থায়ী পান্থশালায় খানিক জিরিয়ে আবার পথে নামি। কিছুটা এগিয়ে ভুডল নালার উপর একটা বেশ শক্তপোক্ত কাঠের পুল। গায়ে তার অজস্র মানসিকের সুতো আর কাপড়ের টুকরো ঝুলছে। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে ভয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। প্রকৃতির অন্তর্লীন শক্তিপুঞ্জের কী সাঙ্ঘাতিক প্রকাশ! কিন্তু দাঁড়ালে তো চলবে না। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাইকে ভজনের সুর। রাস্তার রূপবদল হয়ে এখন বোল্ডারের বদলে পাথরের স্ল্যাব বাঁধানো। আমরা এসে পড়েছি ধানচো। (চলবে)
পেশায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। নেশা বহুল। গ্রুপ থিয়েটার, পাখির ছবি তোলা আর পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্রমণ তার মধ্য়ে তিন। খেপে ওঠেন সহজে। হেসে ওঠেন গরজে! খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন। আর পছন্দ টেলিভিশন দেখা!