সেদিন স্কুল থেকে ফিরে মিথিলেশ দেখল সীমার ধূম জ্বর। সকালের রান্না সবই আছে। রাতে শুধু ভাত হয়। ভাত চাপিয়ে মিথিলেশ বারবার সীমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর বোঝার চেষ্টা করছিল। সীমা নিজেই প্যারাসিটামল খেয়ে নিয়েছে। এতক্ষণে জ্বর কি একটু কমা উচিত ছিল না? মিথিলেশকে বারবার আসতে দেখে সীমা ক্ষীণ গলায় বলল,
— ভাতটা গলে পাঁক হয়ে যাবে। বারবার কী দেখছ? এ জ্বর তিনদিনের আগে সারবে না। ঘরে ঘরে হচ্ছে। মিথিলেশের মুখ শুকিয়ে গেল। কাল বৃহস্পতিবার। তার মানে বৃহস্পতি, শুক্র- এই দুটো দিন তাকে ছুটি নিয়ে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। ছেলে এ দু’দিন স্কুলে না গেলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়? কালকে হেডমাস্টার অজিত পাল কী একটা বিষয়ে কথা বলবেন বলে মিটিং ডেকেছেন। কালই মিথিলেশ যেতে পারবে না। আগে আগে সীমা অসুস্থ হলে অনেকবারই ছেলেকে স্কুলে যেতে দিতে হয়েছে মিথিলেশকে। কিন্তু তখন তো ও চাকরি পায়নি। এই একটা বছর, প্রবেশন পিরিয়ডে, এরকম হুট বলতে সুট কামাই করা যায়? সীমার বেয়াক্কলে জ্বর আসার আর সময় পেল না।
রাগ হল বটে, কিন্তু মিথিলেশ পরিপাটি করে কাজ করে সব। ছেলেকে ভাত মেখে, মাছ বেছে খাওয়ায়। সীমাকেও দুধ-পাঁউরুটি খাওয়াবার চেষ্টা করে। সীমা একটু খেয়ে বমি করে দ্যায় সব। তারপর নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চা করে খায় বিস্কিট দিয়ে। সীমাকে দেখে একটু আশা জাগে মিথিলেশের। উঠে নিজে চা করে খাচ্ছে যখন, কাল সকালের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে নিশ্চয়। ছেলেকে আস্তে আস্তে নিয়েও যেতে পারবে ঠিক। খুব শরীর খারাপ নিয়েও এ কাজটা করে যায় সীমা, ওখানে ওর একটা বন্ধুবৃত্ত তৈরি হয়েছে। ওরা গড়িয়াহাট ঘুরে ঘুরে টিপের পাতা থেকে বিছানার চাদর কেনে, সবাই মিলে সোনার দোকানে গিয়ে পুরনো সোনার গয়নার বদলে নতুন গয়না কেনে, ফুচকা খায়, হাতে পয়সা থাকলে হাটারিতেও খায়, নিজেদের এবং বাচ্চাদের জন্মদিন পালন করে। তাই হাজার শরীর খারাপ নিয়েও মরে মরে ছেলেকে ইস্কুল দিতে যায় সীমা। মুখে বলে একদিন স্কুল কামাই করলে ভীষণ ক্ষতি। পরের দিন গিয়ে এর ওর কাছে চেয়েচিন্তে আগের দিনের পড়া জোগাড় করা নাকি দারুণ কঠিন কাজ।কিন্তু মিথিলেশ বোঝে একদিনও নতুন বন্ধুদের না দেখে থাকতে পারে না সীমা।

রাতটা ছটফটিয়ে কাটল। ছেলের আফটারনুন স্কুল। তাও এখান থেকে সাড়ে নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। ছটার মধ্যেই উঠে পড়ল মিথিলেশ। রান্নাটান্না করে তৈরি করে দিলে যদি সীমা আস্তে আস্তে ছেলেকে নিয়ে যেতে পারে, এরকম একটা আশা তখনও পর্যন্ত ছিল তার। নিজের ওপর রাগও হচ্ছিল খুব। কেন যে তার গাড়ি নেই! নিজেদের গাড়ি থাকলে সীমা জ্বর গায়েও যেতে পারত, সারাদিন গাড়িতেই রেস্ট নিত, অসুবিধে কী? পরমেশ বেঙ্গালুরুতে সেটল করার ফলে বাড়িটা আপাতত পুরো তার। মা দিদির কাছে সারাবছর চন্দননগরে। খুব কম আসে। সীমার সঙ্গে মায়ের একদম বনে না। বাড়িভাড়া দিতে হয় না বলে চাকরিহীন, টিউশনি-নির্ভর জীবনও চলে গেছে একসময়। আবার গাড়ি! তার অমনি মনে হল, ঝিল্লির নিশ্চয় গাড়ি আছে। থাকবেই। তাহলে তো ও যেদিন অবন্তীনগর আসবে, গাড়ি করেই আসতে পারে। ভিড় বাসের ঠেলা খেতে হবে না। ফেরার পথে ওর গাড়িতেই ফিরতে পারে মিথিলেশ।
মিথিলেশকে ঝিল্লির গাড়িতে উঠতে দেখলে হেডমাস্টারের মুখে কী কী রঙ খেলবে, তার ছাত্ররা কী চোখে তাকাবে তার দিকে, সেটা মিথিলেশ ভাবলই না। ঝিল্লির গাড়িতে ওঠার চিন্তা তাকে এমন উজ্জীবিত করে তুলল যে আজকের স্কুল কামাই হবার ব্যাপারটাও তাকে ছুঁতে পারল না। সে তরতর করে দুটো আভেনে ভাত ডাল ও ডিমভাজা করে ফেলল। ভাতের মধ্যে উচ্ছে আর আলু সেদ্ধ দিল। সীমা যদি একটু খেতে পারে গরম ভাতে মেখে। উচ্ছে ওর জিভে রুচি ফেরাবে। একটু টাটকা মাছ এনে দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু কে ধোবে, কেই বা রাঁধবে? মিথিলেশের ক্ষমতার শেষ সীমা ভাত, ডাল ও ডিম। মা থাকলে… নাহ, মা থাকলে এ বাড়িতে এত চাপা অশান্তি, তার চেয়ে এই ভালো। ছেলের টিফিন রাস্তায় কিনে নিলেই চলবে। মিথিলেশ ওয়াটার বোতলে জল ভরে নিতে নিতে বলল ছেলেকে,
— দেখ পটি করিস তো করে নে, রাস্তায় করবি বলবি না কিন্তু।
— করেছি তো কাল।
মিথিলেশ আর ঘাঁটালো না। সীমার গায়ে জ্বর আছে, আন্দাজে ১০০ বলেই মনে হচ্ছে। থার্মোমিটার ভেঙে যাবার পর আর কেনা হয়নি। সীমা চা খাচ্ছে বিছানায় বসে বসে। মিথিলেশকে দেখে বলল,
— কাল আমি যেতে পারব।
মিথিলেশ আর ওসব নিয়ে ভাবছেই না। সে ব্যস্তভাবে বলল,
— না, না, তুমি সোমবার থেকে যেও। এই দু’তিনটে দিন রেস্ট নাও। আমি শনিবার টুক করে স্কুল ঘুরে আসব।
বেরবার মুহূর্তে ছেলে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। ‘এ বাবা’ কী যেন ভীষণ জরুরি কথা মনে পড়ে গেছে ছেলের। মিথিলেশ বিরক্ত গলায় বলে,
— কী হল আবার? তাড়াতাড়ি চলো।
— ও মা, কাল তো ছুটি। স্কুল থেকে নোটিস দিয়েছে ফ্রাইডে ছুটি, স্কুল ফেস্ট আছে না?
সীমার মুখে হাসি ফুটল।
— যাক, আজকের দিনটা ছুটি নিলেই চলবে তোমার।
মিথিলেশ কিন্তু তেমন খুশি হতে পারল না শুনে। ঝিল্লির বাড়ি দক্ষিণ কলকাতায়, মিথিলেশের ছেলের স্কুলও ওদিকে। মিথিলেশ কি ভেবেছিল ছেলেকে স্কুলে ঢুকিয়ে ঝিল্লির বাড়ি চলে যাবে সে? দক্ষিণ কলকাতা কত বড়, সে সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই তার। হয়তো দুটো জায়গা যথেষ্ট দূর। ঝিল্লির বাড়ি গিয়ে সে হয়তো সময় মতো স্কুল ছুটির সময় পৌঁছতেই পারল না। বিশাল স্কুল চত্বরে একদম একলা একটি বাচ্চা স্কুলব্যাগ আর জলের বোতল নিয়ে বসে আছে, ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেছে, এক্ষুনি সে কেঁদে ফেলবে। ছবিটা ভাবলেই ঝিল্লির বাড়ি যাবার ইচ্ছেটা মরে যাচ্ছে মিথিলেশের। তবু, কয়েক ঘণ্টার জন্যে সে ঝিল্লির বাড়ির কাছাকাছি থাকবে– এই নিশ্চয়তা তাকে উষ্ণ করে তুলেছে। আর সেই মেসেজ- ‘রাতটা আমার সঙ্গে থেকে যাস’- মনে পড়লেই শিরশির করে ওঠে ভেতরটা। বহুবছর আগে ভিড় বাসে তার হাত কোনও অভিপ্রায় ছাড়াই ঝিল্লির বাম স্তন ছুঁয়ে গেছিল। সেই স্পর্শ তার স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে আছে। কিন্তু ঝিল্লির শরীর পাবার কথা সে কোনওদিনই ভাবেনি। রাতের বা দিনের কোনও স্বপ্নেই না। ওরকম অসম্ভব কথা ভাবার সাহসই হয়নি তার।
ঝিল্লির গাড়িতে ওঠার চিন্তা তাকে এমন উজ্জীবিত করে তুলল যে আজকের স্কুল কামাই হবার ব্যাপারটাও তাকে ছুঁতে পারল না। সে তরতর করে দুটো আভেনে ভাত ডাল ও ডিমভাজা করে ফেলল। ভাতের মধ্যে উচ্ছে আর আলু সেদ্ধ দিল। সীমা যদি একটু খেতে পারে গরম ভাতে মেখে। উচ্ছে ওর জিভে রুচি ফেরাবে। একটু টাটকা মাছ এনে দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু কে ধোবে, কেই বা রাঁধবে? মিথিলেশের ক্ষমতার শেষ সীমা ভাত, ডাল ও ডিম।
চাকরি পাবার পর মনে হয়েছিল পুরনো বন্ধুদের জানালে বেশ হত। কিন্তু পুরনো বন্ধুরা, মানে ইউনিভার্সিটির পুরনো বন্ধুরা কেউই তো কলকাতায় আর থাকে না। একজন ইমামবাড়া কলেজে পড়ায়, চুঁচুড়ায় ফ্ল্যাট কিনেছে। তার নম্বর নেই মিথিলেশের কাছে। বাকিরা কেউ রাজ্যের বাইরে, অনেকে দেশের বাইরে। দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মিথিলেশ যেহেতু একসময় প্রচুর টিউশনি করেছে, এখনো দু’ চারটি নাছোড় ছাত্রীকে তাকে পড়াতে হয়, তাই তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে তার একটা যোগাযোগ থেকেই গিয়েছে। তারা প্রত্যেকেই মোবাইল, ইন্টারনেটে তুখোড়। তারা মিথিলেশকে বলল ফেসবুক এবং আরও অনেক সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের মাধ্যমে পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। মিথিলেশ সবে বছর দেড়েক মোবাইল নিয়েছে, তার বাড়িতে কম্পিউটার পর্যন্ত নেই, ইন্টারনেটে লোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কী যে মজা পায়— এসব তার মাথায় ঢোকে না। বহু কষ্টে সে ছাত্রীদের বোঝাল সে এইভাবে উদ্যোগ করে হারানো বন্ধুদের খুঁজে পেতে চায় না, সে সঠিক মুহূর্ত আসার অপেক্ষায় বিশ্বাস করে।

এ কথা শুনে, মেয়েগুলো যেন আশ্চর্য এক জন্তু দেখছে, এভাবে তার দিকে তাকায়। ওদের মধ্যে তীর্ণা বলে একটি মেয়ে, একেবারেই অদম্য। সে মিথিলেশের মুখের ওপর বলে দিল
— আপনি স্যার বড্ড ব্যাকডেটেড। কত বুড়ো বুড়ো লোক সারাক্ষণ চ্যাট করছে, আপনি তো কোয়ায়েট ইয়াং। দাঁড়ান এক্ষুনি আপনার একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছি।
বলেই সে পটাপট করে মিথিলেশের ছবি তুলতে শুরু করে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারের জন্যে। সেযাত্রা মিথিলেশ তাকে কোনওরকমে নিরস্ত করে। সে তীর্ণাকে বলতে পারে না কোনওরকম চেষ্টা না করেই একটি পুরনো বন্ধুকে সে কুড়িয়ে পেয়েছে পথ থেকে। বারুইপুর স্টেশনে হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেছিল তার সঙ্গে, মিথিলেশকে সে নিজের নম্বরও দিয়েছে। ঝিল্লির লালচে রঙ করা চুল, জিনস আর লাল টপ, চুলের ওপর উঁচু করে তুলে রাখা সানগ্লাস— পুরনো মফসসলি মেয়েটার সঙ্গে কোথাও মিল নেই। শুধু হাসিটা একইরকম। নাহ, ঝিল্লি আগের মতোই আছে। বরং আরও বেশি সুন্দর। এত বছরের দূরত্ব যেন সেই সৌন্দর্যকে রহস্যম্যতা দিয়েছে। মিথিলেশ ঠিক করল ঝিল্লিকেই সে চাকরি পাবার খবরটা দেবে। শেষবার দেখা হতে ঝিল্লি তার টিউশনি সর্বস্ব জীবন নিয়ে উদ্বেগ দেখিয়েছিল। মেকি নয়, খাঁটি উদ্বেগ। মিথিলেশের ছেলে কলকাতায় দামি স্কুলে পড়ে শুনে সে উদ্বেগ আরও বেড়ে গিয়েছিল।
— তাই তো, তোর একটা চাকরি ইমিডিয়েট দরকার।
— চাকরি পাবার আর বয়স আছে নাকি আমার?
এর কোনও উত্তর ঝিল্লির মুখে জোগায়নি। তার চোখে ফুটে উঠেছিল নিখাদ ভয়। ঝিল্লিকে খবরটা জানিয়ে মিথিলেশ বলতে চেয়েছিল,
— আর ভয় নেই রে। আমি একটা চাকরি পেয়ে গেছি।
তারপর অসংখ্যবার ফোনে কথা হয়েছে তাদের। ঝিল্লি অবন্তীনগরে আসতে চেয়েছে। প্রতিবারই কোনও না কোনও কারণে ভেস্তে গিয়েছে সেই প্ল্যান। মিথিলেশ কত কী ভেবেছে ঝিল্লির আসা নিয়ে। কিন্তু কখনো ঝিল্লির শরীর আসেনি তার ভাবনায়। কেবল ওই মেসেজটা পাবার পর থেকে ঘুমে জাগরণে, ক্লাস নিতে নিতে, ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে জিনস টপের নীচে ঝিল্লির লালচে রঙের শরীরটা একটা লাইন ড্রয়িংয়ের মতো ভেসে উঠছে তার মনে। গড়িয়া শীতলা মন্দিরে অটো থেকে নেমে ছেলের হাত ধরে কবি নজরুল মেট্রোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে মিথিলেশ হঠাৎ দেখতে পেল বাথরুমে স্নান করছে ঝিল্লি। স্বচ্ছ কাচের দরজার মধ্যে দিয়ে ঝিল্লির জলকণা খচিত শরীর বিকেলের রোদের আভা মাখা মেঘপুঞ্জের মতো তার চোখে সামনে ভেসে উঠল। শরীরে বিদ্যুত তরঙ্গ খেলে গেল নিমেষে। সেই অভিঘাতে সে দাঁড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের জন্যে। ছেলে তার হাতে টান দিয়ে বলল,
— কী হল বাবা, তাড়াতাড়ি চলো, মেট্রো পাব না তো…
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Good Housekeeping, Pinterest
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
One Response
লেখার প্রসাদ গুণে ওদের সংসারে দিব্যি ঢুকে পড়েছি।
আগের সূত্র : কিন্তু রান্নাঘরে , ঝিল্লি কেন রক্ত মেখে পড়েছিল রে!