(Kaliprasanna Singha)
সাহিত্যে ব্যঙ্গাত্মক ভাবের প্রকাশ সাধারণত সমালোচনা ও তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়ে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবিন্দুতে কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রথাগত চালচিত্র ভেঙে গড়ে তুললেন নতুন কাঠামো। যেখানে কলকাতার বাবু জীবনের মাটি লেপে দিলেও তা বিকৃত ও কর্দমাক্ত হয়নি, বরং তা হয়ে উঠেছে সামাজিক পট-কথা। যেখানে তিনি সাহিত্যগুণকে বেঁধেছেন রসবোধের বিভিন্ন আঙ্গিকে। (Kaliprasanna Singha)

সময়ের ওঠা-পড়ায় দ্বিধাবিভক্ত ১৮৪০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জোড়াসাঁকোর বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বাবা নন্দলাল সিংহ’কে হারান ছয় বছর বয়সেই। জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও মা ত্রৈলোক্যমোহিনী দেবী’কে আইনি লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বহুদিন। পারিবারিক হিসাবরক্ষক হরপ্রসাদ ঘোষ তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই অসহায়তার সময়ে। (Kaliprasanna Singha)
জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও মা ত্রৈলোক্যমোহিনী দেবী’কে আইনি লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বহুদিন।
হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। যদিও কার্ক প্যাট্রিক নামে এক ইউরোপীয় ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে ইংরেজি শিখেছিলেন বাড়িতেই। ইংরেজী ও সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান লাভ করলেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভিড়ে হারিয়ে ফেলেননি বাংলা তথা কলকাতার জীবনবোধ। কালীপ্রসন্ন সিংহ সমালোচনার দিকটিও করে তুলেছেন খাঁটি, এক্ষেত্রে কখনই উপহাসের মতন তরল ভণিতাকে আঁকড়ে ধরেননি তিনি। নবজাগরণের মুহূর্তে সাহিত্যের সমসাময়িক ভাবনায় প্রাচীন ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব, সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। (Kaliprasanna Singha)
আরও পড়ুন: ফসলের আগুনের ভিতর ‘মানুষের মুখ’
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের সমালোচনায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, “শুদ্ধ নীল বপনানুরোধে ঐ সুখসংসার শ্রীভ্রষ্ট ও শ্মশানতুল্য হইয়া উঠিল। ‘নীলদর্পণ’ গ্রন্থকারকে প্রস্তাবটি অমূলক অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করিতে হয় নাই।”
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’ নিয়ে যখন বাংলা সাহিত্য তোলপাড়। তাঁকে রীতিমতো আক্রমণ করা হচ্ছে। সে সময় পাশে এসে দাঁড়ান কালীপ্রসন্ন সিংহ। ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’কে বাংলা কবিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এ প্রায়ই গ্রন্থ সমালোচনা লিখতেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। পরবর্তীতে ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। যদিও সম্পাদনার মতন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তিনি এর আগেও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পরিচালনা করেছে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা। (Kaliprasanna Singha)
রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এ প্রায়ই গ্রন্থ সমালোচনা লিখতেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। পরবর্তীতে ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন।
প্রসঙ্গত, মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে নিজের বাসভবনে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার উদ্যোগে বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ(১৮৫৬) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভার উদ্যোগে ‘বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা’(১৮৫৫) প্রকাশিত হয় কালীপ্রসন্ন সিংহের সম্পাদনায়। ‘সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা’, ‘পরিদর্শক’ নামে অন্য দু’টি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। তাঁর সম্পাদনায় ‘কলকাতা পুলিশ অ্যাক্ট’ নামে একটি ইংরেজি বইও প্রকাশিত হয়। (Kaliprasanna Singha)
ছাত্রদের বাংলা রচনায় উৎসাহিত করার জন্য সে সময়ে পুরস্কার ও পদক বিতরণ করতেন তিনি। ১লা জুন, ১৮৫১ তারিখের ‘হিন্দুরত্ন কমলাকর’ পত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় যে, ওরিয়েন্টাল সেমিনারির চারজন ছাত্রকে বাংলা বিষয়ে লেখার জন্য পদক প্রদান করেছিলেন। অনেক ছাত্র আবার তাঁর কাছে অর্থসাহায্য পেতেন বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য। একক প্রচেষ্টাতেই ‘বিদ্যোৎসাহিনী পাঠশালা’ ও ৭টি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং আরও একটি বিদ্যালয়ে মাসিক একশ টাকা বেতনে ইংরেজির শিক্ষক নিযুক্ত করেন। (Kaliprasanna Singha)
থিয়েটারের মঞ্চেও কালীপ্রসন্ন ছিলেন সমান সাবলীল। ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’-এর জন্য লেখেন ‘বিক্রমোর্বশী’ নাটক। এই নাটকে তিনি অভিনয়ও করেছেন। তাঁর রচিত ‘বাবুনাটক’ প্রহসন হলেও গদ্যধারায় এক স্বতন্ত্র ও প্রবহমান ভাষা-পথ। ‘সাবিত্রী-সত্যবান’, ‘মালতী মাধব’ প্রভৃতি নাটকগুলি দর্শকমহলে প্রশংসিত হয়। ভাষার মাত্রা-চেতনা দক্ষতার সঙ্গে তিনি নাটকের সংলাপে ব্যবহার করেছেন। (Kaliprasanna Singha)

১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার ‘বাবু সমাজ’-এর টিকিতে টান পড়ে। প্রহসন ও নকশাধর্মী গদ্যে দেখা যেত শ্লেষের আবরণ। কালীপ্রসন্ন সিংহ তা থেকে বের করে নিয়ে আসেন চলিত ভাষার মাধ্যমে। কলকাতার জনজীবনের কথা উঠে আসে সে লেখায়। অবশ্য, এই রীতির ব্যবহার প্যারীচাঁদ মিত্র শুরু করেছিলেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রহসনে। কিন্তু তাঁর ভিত ছিল সাধু ভাষা। (Kaliprasanna Singha)
১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার ‘বাবু সমাজ’-এর টিকিতে টান পড়ে।
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ প্রহসনে মানুষের মৌখিক ভাষার যে উচ্চারণভিত্তিক বানান ব্যবহার করা হয়েছিল তার রেশ এসে পড়েছে তৎকালীন সাহিত্য থেকে সংবাদপত্রে। প্রসঙ্গত, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’র চিত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন তাঁর ‘সেই সময়’ উপন্যাসে।
হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন, “শোভাবাজারের রাজাদের ভাঙা বাজারে মেছুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা মাছ ও লোনা ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের ‘ও গামচা কাঁদে ভাল মাছ নিবি?’ ‘ও খেঁরা গুঁপো মিনসে চার আনা দিবি’ বলে আদর কচ্চে।” (Kaliprasanna Singha)
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমালোচনা করে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় লেখেন, “হুতোমী ভাষা অসুন্দর। যিনি হুতোমী ভাষা লিখিয়াছেন, তাঁহার রুচি বা বিবেচনায় আমরা প্রশংসা করি না।” যদিও সাহিত্য সম্রাট ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের গুণমুগ্ধ। মহাভারত অনুবাদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “যেখানে মহাভারত হইতে উদ্ধৃত করিবার প্রয়োজন হইয়াছে, আমি কালীপ্রসন্নের অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছি।” (Kaliprasanna Singha)

প্রসঙ্গত, মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিদ্যাসাগরের পরামর্শে মহাভারত অনুবাদ শুরু করেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। আট বছরের চেষ্টায় ১৭টি খণ্ডে প্রকাশিত হয় মহাভারত। প্রকাশের খরচ জোগানোর জন্য বিক্রি করেছেন সম্পত্তি। প্রতিটি খণ্ডের ৩ হাজার কপি বিনামূল্যে দিয়েছেন বলেও জানা যায় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র বিজ্ঞাপন থেকে। এরপর, ঋণ জর্জরিত অবস্থায় দাঁড়ান আসামীর কাঠগড়ায়। একদিকে অসমাপ্ত উপন্যাস ‘বঙ্গেশ বিজয়’ অন্যদিকে কর্পদকশূন্য জীবন হয়ে পড়েছে মাদকাসক্ত। এই পরিস্থিতিতে মাত্র ৩০ বছর বয়সে ভেসে যায় তাঁর নকশার পট।
আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিন, তাই জন্মদিনের প্রাক্কালে এই গুণি মানুষটি সম্পর্কে সামান্য স্মৃতিচারণ… (Kaliprasanna Singha)
তথ্যসূত্র:
১) বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ – পরেশচন্দ্র দাস
২) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ – শিবনাথ শাস্ত্রী
ছবিঋণ: বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ – পরেশচন্দ্র দাস

অরিন চক্রবর্তী
অরিন চক্রবর্তী। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা। ছোট পত্রিকা প্রিয়, শব্দের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জীবন।