banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

হনিমুনে যেমন হয়

ডিসেম্বর ২৮, ২০১৯

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

বিয়ে হয়েছিল শেষ রাতে। বাসরঘরে যেতে যেতেই আকাশ ফর্সাঁ। মেয়েরা আক্ষেপ করেছিল এই রকম বিয়ের কোনও মানে হয় না। বাসর জেগে বরবউ-এর সঙ্গে রসিকতা করা গেল না, গানবাজনা হল না, এ কেমন বিয়ে! অবশ্য সবাই জানত ওই রাত ছিল মরশুমের শেষ বিয়ের রাত আর তার লগ্ন যদি শেষ রাত্রে পড়ে তাহলে কারও কিছু করার নেই।

রাত জাগতে হয়েছিল, সকালে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেই বিছানায় গিয়েছিল প্রতীক। দুপুর অবধি ঘুমাতে পেরেছিল। আজ কালরাত্রি, বউ-এর পাশে যাওয়া দূরের কথা, মুখ দেখতে নেই বলে পিসিমারা ফতোয়া দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় তালিবান হলেন বড় মাসিমা। বলেছিলেন, “খবরদার ছায়াও মারাবি না।’

বন্ধুরা আড্ডা মারতে এসেছিল। বলেছিল, আজ তোর লাস্ট নাইট অফ ব্যাচেলার্স লাইফ। কাল থেকে তো সারাজীবনের ফুলশয্যা । মনে মনে রোমাঞ্চিত হলেও মুখের চেহারা পাল্টায়নি প্রতীক। যে বন্ধুরা বিবাহিত এবং অভিজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ার সময় তারা দুদলে ভাগ হল। একদল বলল, “প্রথম রাত্রে বড়জোর হাত ধরবি, তার বেশি এগোবি না। নইলে সারাজীবন তোকে একটা অভদ্র, সৌজন্যবিহীন, রাক্ষস ভাববে।’ আর একদল বলেছিল, “দূর! প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে হয়।” অবিবাহিত ডাক্তার বন্ধু অমলকান্তি বলে গিয়েছিল, “পরিস্থিতি অনুযায়ী আচরণ করবি। কিন্তু যা করবি উইথ ডিগনিটি। বর্বর হোস না।’

কদিন ধরেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল প্রতীক। তার জীবনে কোনও মেয়ে আসেনি। প্রেম করার সুযোগ সে পায়নি। পড়াশুনা এবং গবেষণা নিয়ে এত ব্যস ছিল এতদিন যে মেয়েদের সম্পর্কে কোনও আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়নি কখনও আজ বাড়িতে যে এত মহিলা এবং মেয়েদের ভীড় তা হয়েছে তার বিয়েকে উপলক্ষ করে। বউভাতের পরই সবাই চলে যাবে। সে, মা আর বাবা এই বড় বাড়িতে এতকাল বাস করে এসেছে। এখন থেকে আর একজন বাসিন্দা বাড়ল।

খবরটা এনেছিলেন বড় মাসিমা। কথাবার্তা যাতায়াত করেছিল মা-বাবা। তাকে বলা হয়েছিল দেখে আসতে। প্রতীক আপত্তি করেছিল। ছবিতেই তো ভাল লাগছে। যাকে চিনি না, জানি না তাকে বউ হিসেবে পেতে সামনে যাওয়া কীরকম বোকা বোকা ব্যাপার। অবশ্য মেয়ের যদি তাকে দেখার ইচ্ছে থাকে তাহলে যেতে হবে। জেনেছিল, মেয়েরও সেই বাসনা নেই। অতএব ছাদনাতলায় দেখা হল। দেখে ভাল লাগল।

জানাজানি সম্পূর্ণ না হয় ততদিন পদ্মকলির শরীরের ওপর স্বামীর অধিকার ফলাতে যাবে না। বউভাতের পালা তখনও চোকেনি অথচ রাত গড়িয়েছে এগারটায়। মামাতো পিসতুতো বোনেরা তাদের দুজনকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া সেরেছে। বন্ধুরাও ছিল। খাওয়ার পর যখন তাদের সঙ্গে গল্প করছে মেয়েরা এসে বলল, “একি! আজ তোমার ফুলশয্যা আর তুমি এখনও গল্প করছ? বউদিমনি কতক্ষণ জেগে থাকবে। চল।”

বন্ধুরা হাত নেড়ে বলল, “বিদায়, উইশ ইউ গুড লাক।’

বড়পিসির ধমকানিতে মেয়েরা ঘর ছেড়ে চলে গেল। ফুল দিয়ে চমৎকার সাজানো খাটের ঠিক মাঝখানে মুখ নিচু করে যে সুন্দরী বসে আছে তার নজর কোথাও নেই।

স্বাভাবিক। প্রতীক ভাবল, একদম অচেনা একটি পুরুষের সঙ্গে ওকে আজ রাত কাটাতে হবে। সঙ্কোচ, ভয় তো হবারই কথা। সে দরজা বন্ধ করল। তারপর চেয়ার টেনে খাটের পাশে নিয়ে গিয়ে বসল, “আমি প্রতীক, তুমি তো পদ্মকলি।’

পদ্মকলি মুখ তুলল না।

“আজ নিশ্চয়ই তুমি খুব টায়ার্ড । অন্যদিন না হয় গল্প করা যাবে। তুমি বরং একটু সহজ হয়ে শুয়ে পড়। খাটটা তো বেশ বড়, আমি ওপাশে শুতে পারি। আর তাতে যদি অস্বস্তি হয় মেঝেতে বিছানা পেতে নিতে পারি।” প্রতীক বলল।

পদ্মকলি কোনও সাড়া দিল না।

প্রতীকের খেয়াল হল, “সরি। আমার বোধহয় আপনি দিয়ে শুরু করা উচিত ছিল। এই প্রথম কথা বলছি। আমরা তো কেউ কাউকে চিনি না। পদ্মকলি এবার মুখ তুলল। নীচের ঠৌটের এক প্রান্স ওপরের দীতে চাপল। তারপর দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’

“খুব জরুরি না হলে, মানে আজ তো অনেক ধকল গেল, বিশ্রাম নিলেই ভাল হয়।’

“না। জরুরি, খুব।” পদ্মকলি মুখ ফেরাচ্ছিল না। কিন্তু তার গলার স্বরে উত্তেজনা ছিল।

প্রতীক অবাক হল। বাইরে এখনও লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। বাসরঘরে মেয়েরা জমিয়ে থাকে, ফুলশয্যায় কি আড়ি পাতে? অবশ্য পরা ঢাকা বন্ধ কাচের জানলায় ওরা শুধু আলো দেখতে পাবে। ঘরের কিছু চোখে পড়বে না। সে বলল, “বেশ, শোনা যাক।’

“আপনি হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই আমাকে খুব খারাপ ভাববেন।” পদ্মকলি থেমে গেল।

“না না, অকারণে খারাপ ভাবতে যাব কেন?

“অকারণে নয়। মানে, আমার খুব খারাপ লাগছে আপনাকে কষ্ট দিতে, আপনি তো

সত্যিকারের ভদ্রলোক, তাই না? এই প্রথম তাকাল পদ্মকলি।

সোজা হয়ে বসল প্রতীক, “বুঝতে পারছি না, মানে না শুনলে বুঝব কী করে!

‘হ্যা। আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন আমি আগে বলিনি কেন? একটা ফোন করে সব বলে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যেত। সেটা আমি পারিনি। না পারার কারণ ছিল। আপনি কি বুঝতে পারছেন না, আমি কী বলতে চাইছি? পদ্মকলি করুণ চোখে তাকাল।

মাথা নেড়ে নি:শব্দে না বলল প্রতীক ।

“আমার বিবেক আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমি আপনাকে ঠকাতে চাই না।’

“আহা! আমি কেন ঠকবো? প্রতীক অবাক।

ঠকবেন না? যাকে বিয়ে করেছেন সে যদি অন্য পুরুষকে মন দিয়ে বসে থাকে তাহলে আপনি ঠকবেন না? একি কথা বলছেন? চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করল পদ্মকলি।

“তাই নাকি? শব্দ দুটো অসাড়ে বেরিয়ে এল প্রতীকের মুখ থেকে।

“হ্যাঁ, আড়াই বছর ধরে টানা পেম করেছি ওর সঙ্গে। পার্কে ঘুরেছি, গঙ্গার ধারে গিয়ে ভেলপুরি খেয়েছি, মাসে একদিন সিনেমায় যেতাম। তার বেশি কিছু নয়।’

“তাহলে তো তাকেই বিয়ে করা উচিত ছিল।’

“ছিলই তো। কিন্তু আপনি যেটা সহজে বললেন তা আমার বাবা-মা ভাবতেই পারল না। ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিল, ফোন ধরতে দিত না। আমি সেসব না শুনতে মা একদিন ঘুমের ওষুধ খেল দশটা । যমে মানুষে টানাটানি। সবাই বলতে লাগল মায়ের মৃত্যু হলে আমি দায়ী হব। কিন্তু ডাক্তার বাঁচিয়ে দিল। বাড়িতেই। বাইরের কেউ জানতে পারেনি। ভাল হতেই মা আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন বাড়ির পছন্দ করা পাত্রকে যদি বিয়ে না করি তাহলে গলায় দড়ি দেবেন, বুঝুন ব্যাপারটা ।” করুণ দেখাল পদ্মকলির মুখ।

“সর্বনাশ!” প্রতীক বলল।

“ঠিক এই কথাটাই বলেছিল ও, সর্ব নাশ। আমার অবস্থা ভাবুন। যাকে ভালবাসি তাকে বিয়ে করলে মা গলায় দড়ি দেবে। মানে আমি মাকে হত্যা করব! কোন সন্গান তা পারে?

তাই মাকে বাঁচাতে আপনার সঙ্গে বিয়েতে রাজি হতে হল আমাকে” পদ্মকলি বলল।

“ও।” প্রতীক ভেবে পাচ্ছিল না কী বলবে!

“হ্যাঁ, প্রথম কথা উঠতে পারে, ব্যাপারটা বিয়ের আগে আপনাকে কেন জানালাম না। এ বাড়ির ফোন নাম্বার তো বাইরেই পেতে পারতাম। ফোনেই বলা যেত।’

হ্যাঁ, সেটা অবশ্য ঠিক কথা” মাথা নাড়ল প্রতীক।

“ঠিক কথা? পদ্মকলি এমনভাবে তাকাল যেন অদ্ভুত কথা শুনছে, “না ভেবে বললেন তো? আপনি আমার ফোন পেয়ে বাড়িতে বলতেন, তাঁরা আমার বাড়িতে জানাত। বিয়ে ভেঙে যেত। তখন মা কী করত? শুধু গলায় দড়ি নয়, গায়ে আগুনও লাগাত। বুঝতে পারছেন?

“তা অবশ্য! কিন্তু ওই ছেলেটির ব্যাপারে আপনার বাবা-মায়ের আপত্তি কেন ছিল?

“ও কবিতা লেখে। কবিদের ওপর ভরসা করা যায় না বলে মায়ের ধারণা । তাছাড়া ওর টাইটেল হল কর্মকার, আমরা মুখার্জি। মা মানতেই পারছিল না। তার ওপর বাংলায় এম.এ, স্কুলে পড়ায়। বাবার ধারণা বিয়ে হলে ঘরজামাই হতে চাইবে।” পদ্মকলি বলল,

“কিন্তু হৃদয়? ওর মতো হৃদয় আমি কারও দেখিনি। এই যে এতদিন ধরে প্রেম করেছি, একবারের জন্যও আমার শরীর স্পর্শ করেনি, জানেন? পদ্মকলির চোখ বন্ধ হল,
“যখন বললাম হে বন্ধু বিদায়, তখন যেন ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।’

মাথা নাড়ল প্রতীক, “স্বাভাবিক, খুব স্বাভাবিক।’

“ও দেবদাস হতে পারত, আমাকে খুন করতে পারত, আযাসিড বান্ব ছুড়ে মুখ পুড়িয়ে দিতে পারত, এমনকী বিয়ের সময় এসে হাঙ্গামা করতে পারত কিন্তু করেনি, এত নরম মন ওর।”

“উনি কোথায়?

“নেই।” দ্রুত মাথা নাড়ল পদ্মকলি।

“সেকি?

চুপচাপ হারিয়ে গেল। শিলং-এর পাহাড়ে।’

“ও! কিন্তু শিলং কেন?

“শিলং তো প্রেমিকপ্রেমিকার জেরুজালেম। অমিত লাবণ্যের লীলাক্ষেত্র। ও নাকি শিলং থেকে একটু দূরে চেরাপুঞ্জিতে এক মিশনে গিয়ে জনসেবা করছে।’

“সেখানে তো খুব বৃষ্টি হয়।’

“হত। এখন হয় না। আকাশে যখনই মেঘ দেখি তখনই ওর কথা মনে পড়ে। আচ্ছা, বঙ্গোপসাগর থেকে যেসব মেঘ কলকাতার আকাশে আসে তারা তো চেরাপুঞ্জিতে যায়, না?

“বোধহয়”

“যাক গে, আমার যা কথা ছিল সব বলে দিলাম।’

হুঁ আচ্ছা, উনি যদি হারিয়ে না গিয়ে আপনার উপর জোর করতেন?

“খুশি হতাম। কিন্তু ও তো খুব নরম।’ পদ্মকলি বলল, “এসব শুনে আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুব খারাপ ভাবছেন?

“না না। খারাপ ভাবব কেন? আমি প্রেম করতে পারিনি আপনি করেছেন। আমার বন্ধুরা বলে আমি অস্বাভাবিক বলে প্রেম করতে পারিনি। আপনি স্বাভাবিক ।” প্রতীক বলল।

“থ্যাঙ্ক ইউ।” পদ্মকলি হাসল, “এখন কী করবেন?

“ভাবতে হবে। অনেক ভাবতে হবে।’

“আমি যখন একবার এ বাড়িতে চলে এসেছি তখন এখনই চলে যাওয়াটা কি ভাল দেখাবে? শুনলে আত্মীয়স্বজনরা ছি ছি করবে।” পদ্মকলি বলল।

“তা তো বটেই। আর চলে যাওয়ার কথা উঠছে কেন? আগে সব ভাবি তারপর ঠিক করব কী করা উচিত। নিন, এবার আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।’

“আপনি? না না, আপনি মেঝেতে শোবেন আর আমি খাটে, এ ভারি খারাপ দেখাবে।

বরং উল্টো হোক।” পদ্মকলি খাট থেকে নেমে এল।

“বেশ। আপনার যা ইচ্ছে। প্রতীক উঠে দাঁড়াল।

পদ্মকলি বলল, “এই যে আমাকে দেখছেন, আমার মধ্যে কোনও মন নেই।

“জানি। সেই মন এখন চেরাপুঞ্জিতে।’ প্রতীক বলল।

‘হ্যাঁ। তাই আলো নেভাবেন না। অন্ধকারে যদি আপনি ভুল করে ফেলেন।’

অন্ধকারে ভুল? প্রতীক লজ্জা পেল, “না না। আপনি নিশ্চিন্দে ঘুমান।’

মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল পদ্মকলি। “আপনার বাড়ির লোক শুনলে কী কাণ্ড হবে! আমার মা-বাবা শুনবেন।’

“কেউ শুনবে না।” প্রতীক আশ্বাস দিল।

“কদিন বাদে তো দ্বিরাগমনে যেতে হবে।” পদ্মকলি মনে করিয়ে দিল।

“জানি। মা বলেছে।” প্রতীক বলল, “আমি ভাবছি ওরা আমাদের আপনি আপনি শুনলে কী রকম করবে? বিয়ের আগে যারা তুই তোকারি করে তারাও তো বিয়ের পরে তুমি বলে। আচ্ছা, আমরা এইটুকু আযাডজাস্ট করতে পারি না?

“ছি ছি। এভাবে বলা ঠিক নয়। নিশ্চয়ই পারি।” লজ্জিত হল পদ্মকলি।

“তাহলে গুড নাইট?

হ্যাঁ, গুড নাইট।” ঘরের আলো জ্বলতে লাগল।

সকালবেলায় চা খেতে খেতে বড়পিসি বললেন, “সেসব দিন চলে গেছে। এখন সংসার আর রমণীয় হয় না রমণীর গুণে, পুরুষেরও দায়িত্ব বেড়েছে।’

প্রতীকের বাবা বললেন, “হুম।’

এইসময় মাথায় আধঘোমটা টেনে পদ্মকলি ঘরে ঢুকতেই প্রতীকের মা বললেন, “এসো এসো। খোকা উঠেছে?

পদ্মকলি নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বড়পিসির কপালে ভাঁজ পড়ল, “সারারাত ঘরে আলো জ্বালিয়ে তুমি ঘুমাতে পারো?

খোকা তো জ্বালত না।

বাবা বলতেন, “নতুন জায়গা, বোধহয় ভয় করছিল।

“কেন? খোকা তো পাশে ছিল।” বড়পিসি বললেন, “যাক গে, দ্বিরাগমন থেকে ফিরে এসে আমাদের বাড়িতে যাবে। এখান থেকে পাটনা এমন কিছু দূর নয়। আমার বাড়ি দিয়ে শুরু করবে তারপর অন্ত বারোটা বাড়িতে যেতে হবে তোমাদের। আমরা একসঙ্গে থাকি না বটে, কিন্তু লতায় পাতায় জড়িয়ে আছি। বুঝেছ?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল পদ্মকলি।

মা বললেন, “চেয়ারে বসো না। চা খাও।’

পদ্মকলি বলল, “এখন থাক।’

বড়পিসি কপালে চোখ তুললেন, “ওরে বাবা, তুমি কোন যুগের মেয়ে? স্বামী খায়নি

বলে আগে খাবে না? এখন এসব কেউ মানে? এসো, বসো বলছি।

বাধ্য হল পদ্মকলি। এই সময় প্রতীক এল ঘরে। তাকে দেখে ঘোমটা টানছিল পদ্মকলি।

মা বলল, “না, তোমাকে ঘোমটা দিতে হবে না। তুমি এখন আমার মেয়ে। মা-বাবার সামনে কি মেয়ে ঘোমটা দেয়?

বাবার চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অতিথিদের তদারকি করতে তিনি উঠে গেলে বড়পিসি জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ রে খোকা, হনিমুনে কোথায় যাচ্ছিস?

“হনিমুন!’ প্রতীক ঢোক গিলল।

“একি রে! তুই প্ল্যান করিসনি?

“না।’

“কি আশ্চর্য ! তোর পিসে আমাকে নিয়ে হনিমুনে গিয়েছিল কাশ্মীরে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল বিধবা মা, অবিবাহিত খুড়ো কাকাকে। তাদের সেবা করতে করতে আমার আর গঙ্গায় নৌকো চড়া হয়নি।” পিসি বলল।

“এখন ছুটি নেই। দ্বিরাগমনের পরেই জয়েন করতে হবে।

তা দ্বিরাগমনের তো দেরি আছে। দু-তিনদিনের জন্যে ওকে নিয়ে কোথাও যা। প্লেনে চেপে যাবি, সমুদ্রে কিংবা পাহাড়ে।’

“দেখি। প্রতীক জবাব দিল।

সে রাত্রে প্রতীক ঘরের দরজা বন্ধ করতে পদ্মকলি বলল, “বাব্বা, সারাদিন এত ব্যস যে

কথা বলার সময় পাওয়া গেল না।’

প্রতীক দেখল পদ্মকলি খাটে বসে আছে। সে চেয়ারে বসল, “না, সবার সামনে কী কথা

বলব।’

“কি ভাবা হল?

“কী ব্যাপারে?

‘বা:। কাল বলা হল ভাবতে হবে, অনেক ভাবতে হবে।

“ভাবলাম, যা চলছে তা চলুক। ও হ্যা, বড়পিসি চাপ দিল, মা-ও পরে বলল, বন্ধুদের বলতে ওরা তিনদিনের হনিমুন করার জায়গা বলে দিল। এতদিন প্লেন চলত না, এখন আবার চালু হয়েছে।’ প্রতীক বলল।

“আমার কিন্তু সমুদ্র তেমন ভাল লাগে না।” পদ্মকলি বলল।

“না না। সমুদ্র নয়। পাহাড়। শিলং-এ।” প্রতীক হাসল।

“শিলং! সোজা হয়ে বসল পদ্ধকলি।

“পাইনউড হোটেল বুক করে দিয়েছি।’

“ও:| কি ভাল! আমি ভাবতেই পারছি না।’ চোখ বন্ধ করল পদ্মকলি, “শিলং থেকে

চেরাপুঞ্জি কত দূরে?

“বেশি দূর তো নয়। গিয়ে দেখা যাবে।’

“কবে যাওয়া হবে? মুখে খুশি উথলে উঠল পদ্মকলির।

“কাল। কালই ফ্লাইট। রোজ তো যাওয়া যায় না।’

হঠাৎ পদ্মকলির খেয়াল হল, “আমরা কিন্তু কেউ কাউকে তুমি বলছি না। অবশ্য বন্ধ ঘরে কেউ শুনছে না।’

“বেশ। আমি বলছি। তুমি খুশি? প্রতীক স্মার্ট হল।

তুমি? পদ্মকলি তাকাল।

“তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।’

“থ্যাঙ্ক ইউ।” তারপরেই উদাস হল পদ্মকলি, “আমি ওকে বলেছিলাম, জানো।’

“কী বলেছিলে?

“বলেছিলাম, দ্যাখো, বাবার জন্যে রামচন্দ্রকে বনবাস যেতে হয়েছিল। আমি বিয়ে করছি

মায়ের জন্যে। কিন্তু আমার শরীর আর মন তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে। আমার মনে

হয় ও তিন বছরের জন্যে উধাও হয়ে গিয়েছে। ফৌস করে একটা শব্দ বের হল

পদ্মকলির নাক থেকে।

“তুমি যে কাল বললে উনি চেরাপুঞ্জের আশ্রমে–।’

“ওর মাসত্বৃতো বোনের মুখে শুনেছিলাম। তা অতদূরে যাওয়া মানে উধাও হয়েই

যাওয়া । আজ খুব ঘুম পাচ্ছে।

“শুয়ে পড়।’

“কাল মেঝেতে শুয়ে গায়ে খুব ব্যথা হয়েছে। আমি আজ খাটে শুই? মেঝেতে শোয়ার

কি অভ্যেস আছে?

“নো প্রব্লেম।’ প্রতীক ঝটপট মেঝেতে বিছানা করে নিল।

“তুমি কী ভাল। জানো, আমি না বিয়ের আগে শাড়ি পরে শুতে পারতাম না। কাল রাত্রেবা রংবার ঘুম ভেঙে গেছে। নাইটিতে এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে না!

“যাতে সুবিধে তাই পরো।’

“তখন একা শুতাম, শোওয়া খুব খারাপ। নাইটি হাঁটুর ওপর উঠে যেত। মা বকত খুব।

কিন্তু ঘুমের মধ্যে উঠলে আমি কী করব বল। ভয় হচ্ছে, যদি আজও উঠে যায়?

“ঘুম ভাঙলে নামিয়ে নিও।’ প্রতীক উপদেশ দিল।

“তুমি অবশ্য মাটিতে শুয়ে দেখতে পাবে না। কিন্তু রাত্রে টয়লেটে যাওয়ার সময় আমার দিকে একবারও তাকাবে না।’

“বেশ। তাকাব না।’

“তুমি কি ভাল। তাহলে গুড নাইট ।’

“গুড় নাইট।

এয়ারপোর্ট ছোট । সেখানে নেমে পদ্মকলি মুগ্ধ। দ্যাখো দ্যাখো কি সুন্দর। দ্যাখো রে,

জগতের কি বাহার।’

“সত্যি সুন্দর। কিন্তু ঠান্ডা আছে।’

“তুমি দেখছি খুব শীতকাতুরে। ওর একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল। শুনে

তোমার বোধহয় ভাল লাগবে না।” পদ্মকলি বলল।

“শোনাও না।’ প্রতীক বলল।

“যে পাহাড়ে কখনও শীত নামে না সেখানে জড় হয়েছে কিছু নারী যারা কখনও পুরুষ দেখেনি।” হাসল পদ্মকলি, “দারুণ, না?

না বুঝে মাথা নাড়ল প্রতীক।

হোটেলটি চমতকার। কার্পেটে মোড়া বড় ঘর, বিশাল বাথরুম, ফায়ার প্লেসে রুম হিটার আছে। পদ্মকলি পুলকিত, “এরকম হোটেলে আমি কখনও থাকিনি। হনিমুন করতে হলে এরকম ঘরে এসে থাকা উচিত। না?

“হু। কিন্তু আমি ভাবছি স্লিপিং ব্যাগ ভাড়া করতে হবে। প্রতীক বলল।

“ওমা! কেন?

“এই মেঝেতে শুলে নিমোনিয়া হয়ে যাবে।”

তখন দুপুর। একা বেরিয়ে প্রতীক স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে এল। তখন স্নান শেষ করে পদ্বকলি তাজা। প্রতীক বলল, “এটাকে একটু আড়ালে রাখতে হবে। হনিমুন করতে এসে স্লিপিং ব্যাগ ব্যবহার করছি জানলে হোটেলের কর্মচারীরা যা তা ভাববে।” পদ্মকলি ব্যাগটটাকে ওয়ার্ডরোবের ভিতর ঢুকিয়ে কম্বল চাপা দিয়ে দিল।

প্রতীক বলল, “আমি বাথরুমে যাচ্ছি, বেরিয়েই খেয়ে নেব। খোঁজ নিয়েছি মারুতি ভাড়া করে চেরাপুঞ্জিতে যেতে বেশি সময় লাগে না।’

“আজই যাবে? পদ্মকলি অবাক।

“পরশু তো ফিরতে হবে। সময় কোথায়? বাথরুমে ঢুকে পড়ল প্রতীক। ঢুকে দেখল তোয়ালে রাখার জায়গায় পদ্মকলির কাচা সায়া এবং অন্তর্বাস ঝুলছে। এই প্রথম কোনও নারীর অন্তর্বাস দেখল প্রতীক। দেখেই চোখ সরিয়ে নিল।

ফ্রেশ হয়ে বাথরুমের দরজা খুলতেই দেখল পদ্মকলি পোশাক বদলে দাঁড়িয়ে। এখন তার পরনে জিনস আর পুলওভার। দুটোই নীল। দারুণ দেখাচ্ছে। পদ্মকলি বলল, “সরি। তুমি দ্যাখোনি তো?

“কী অবাক হল প্রতীক।

“ঠিক ভেবেছি। তোমার ওসব নজরে পড়বেই না। পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে সায়াটাকে জিনসের উপর চাপিয়ে দিল পদ্মকলি।

লাঞ্চের পর মারুতিতে উঠে বসল ওরা। মারুতি চলতে শুরু করলে পদ্মকলি তাকাল, তুমি এখন এত গন্তীর কেন গো?

“কোথায় গম্ভীর? প্রতীক প্রকৃতি দেখল।

“নিশ্চয়ই তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কী করব বল। মানুষটাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে বসে আছি। ও যদি তিন বছর আমার জন্যে অপেক্ষা করে তাহলে আমারও তো একটা কর্তব্য আছে কী বল?

“নিশ্চয়ই।’ মাথা নাড়ল প্রতীক।

“আমাকে দেখে খুব কান্নাকাটি করতে পারে। মনটা নরম তো। আমি ওকে তোমার কথা বলব। তুমি কি ভাল, সব বলব।’ পদ্মকলি বলল।

“না না। তার কী দরকার।’

“দরকার আছে। তুমি কিছু বোঝো না। ও যদি আমাকে আটকে রাখতে চায়, অবুঝহ য়? আমি বিবাহিতা, আটকে থাকতে পারি? আগে ডিভোর্স হোক, তারপর ওর ইচ্ছে পূর্ণ হবে। কিন্তু ও যদি শোনে তুমি খুব ভাল তাহলে বিশ্বাস করবে আমি ফিরে যাব। আর আটকাতে চাইবে না।’

প্রতীক বলল, “কিন্তু ও যদি জেদি হয় আর তুমি না আসতে পারো তাহলে আমার আর কলকাতায় ফেরা হবে না।’

“কেন?

“ঝগড়া হত, আলাদা হতাম। ডিভোর্স হল, এর একটা মানে আছে। কিন্তু হনিমুন করতে এসে বউকে রেখে ফিরলে মুখ দেখাতে পারব না।’

“তা ঠিক। তাহলে কি ফিরে যাব? আমার যে খুব ইচ্ছে করছে যেতে!” পদ্মকলি আনমনা হল।

“চল। দেখা যাক, কপালে কী আছে।’ প্রতীক বলল।

চেরাপুঞ্জিতে একটুও মেঘ নেই। চারদিক খটখট। খোঁজখবর করে আশ্রমের সন্ধান মিলল। দারোয়ান আটকে দিল, “এই আশ্রমে নারীর প্রবেশের অধিকার নেই।,

পদ্মকলি বলল, “তাই নাকি? ডাকো ওকে। বল কলকাতা থেকে পদ্মকলি এসেছে।’ নাম বলল সে।

দুরে দাঁড়িয়েছিল প্রতীক। নামটা শুনল।

দারোয়ান ফিরে এসে বলল, “উনি আসছেন।’

তারপরেই একজন ব্রন্মচারীকে দেখা গেল। পরনে সাদা লুঙ্গি, সাদা ফতুয়া। মাথাকা মানো। পদ্মকলি চেচালো, “এ কী! কে মরেছে?

“আমার গৃহী জীবন। সে জীবনে কত দ্বন্দ, কত কষ্ট। এই জীবনে পরম শান্তি। তুমি একা কেন? তিনি কোথায়?

“ওই তো ওখানে।’ হাত তুলে দেখাল পদ্মকলি।

“তুমি সন্ন্যাসী হয়েছ নাকি?

“বড় কঠিন পথ। আমি এখন ব্রহ্মচারী। পরীক্ষায় পাশ করলে ওই পথে হাঁটতে পারব।’

“তুমি আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছ না কেন?

নারী মুখ দর্শনে চিত্তে স্থিরতা থাকে না।’

ন্যাকা।’

“আচ্ছা। চলি। স্বামী সংসার নিয়ে সুখী হও।’

“আশ্চর্য । তিন বছর অপেক্ষা করবে না?

প্রতিদিন পৃথিবী বদলায়। কথা তো বদলাবে। তখন অন্ধ ছিলাম। এখন আলোর ইশারা পাচ্ছি। যাই।’

“বেশ। যাও। ভালই হল। এখানে না এলে শ্রাদ্ধ হত না।’

শ্রাদ্ধ?

‘হ্যাঁ। আমার মনের।” হনহন করে ফিরে এল পদ্মকলি প্রতীকের কাছে। বলল, “চল।

সেদিন সন্ধে থেকে শিলং-এ বৃষ্টি নামল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল ঠান্ডা। সেই দুপুরের পর পদ্মকলি আর কথা বলেনি। বিছানায় লেপচাপা দিয়ে পড়েছিল সন্ধে পর্যন্ত। তারপর প্রতীকের অনুরোধে রাতের খাওয়া শেষ করে আবার লেপের তলায় ঢুকেছিল। স্লিপিং ব্যাগটা বের করে কার্পেটের উপর বিছিয়ে প্রতীক দেখল সেটা বেশ বড়সড়। সোয়েটার পরেই ভিতরে ঢুকে চেন টেনে দিল সে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তার এমন গরম লাগল যে আবার চেন খুলে উঠে বসে সোয়েটার ছেড়ে ফেলল।

এই সময় পদ্মকলির গলা ভেসে এল, “আমার খুব ঠান্ডা লাগছে।’

“আমার লেপটা নিয়ে যাও।’

“না। লেপে ঠান্ডা যাচ্ছে না।’

“তাহলে স্লিপিং ব্যাগটা খাটে তুলে দিচ্ছি। এর ভিতরটা বেশ গরম।” প্রতীক বলল।

“না। খাটে তুলতে হবে না।’

নীচে নেমে এল পদ্মকলি, “এটা কি সিঙ্গল স্রিপিং ব্যাগ?

‘না বোধহয়। বেশ তো বড়।

“তাহলে একটু সরে শোও।’

স্লিপিং ব্যাগের ভিতর ঢুকে পড়ল পদ্মকলি। প্রতীক শুয়ে পড়তেই সে চেন টেনে দিল।

ব্যাগের খোলের মধ্যে দুটো শরীর উত্তপ্ত হচ্ছিল কারণ দুজনের মাঝখানে একটুও ব্যবধান নেই। হনিমুন যেমন হয়ে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com