স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ভবানীপুরে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে যেন চাঁদের হাট। নির্ভেজাল বাঙালি আড্ডায় যোগ দিতে হাজির হয়েছেন একঝাঁক বিশিষ্ট নাগরিক। কে নেই সেখানে! বিখ্যাত সাহিত্যিক, স্বনামধন্য বিচারপতি,নামজাদা ইতিহাসবিদ, বিখ্যাত স্থপতি, বিশিষ্ট চিকিৎসক। বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা প্রকৃতই হয়ে উঠেছিল সর্বস্তরের বাঙালির মিলন মঞ্চ। নানা ক্ষেত্রের একঝাঁক কৃতী স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে চেষ্টা করলেন ইতিহাসের আলোকে সমকালকে পড়তে। স্বাধীনতার আগে কেমন ছিল বাঙালি, স্বাধীনতার পরেই বা সে কেমন আছে, ঠিক কতখানি বদল এসেছে বাঙালি মননে- একসন্ধে আলোচনায় নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেন বিশিষ্টরা। সেই খোঁজ শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল আত্মসমীক্ষা। বদলে যাওয়া সময়ে কেমন করে ধরে রাখা যায় নিখাদ বাঙালিয়ানা, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েও কী ভাবে অটুট রাখা যায় শিকড়লগ্নতা- সেই সন্ধানের পাশাপাশি উঠে এল সাতচল্লিশের স্মৃতি, দেশভাগের অনন্ত রক্তপাতের এখনও নিরাময় না হওয়া ক্ষত। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে শ্রাবণ সন্ধ্যার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রাপ্তি যাবতীয় মারী, মড়ক, মন্বন্তর পেরিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার স্পর্ধিত বাঙালি উচ্চারণ। আয়োজনে ছিল বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ডট কম এবং বাংলালাইভ ডট কম।
ভবানীপুরের মুখোপাধ্যায় বাড়ির আলোচনা কক্ষে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার, বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, ইতিহাসবিদ হোসেনুর রহমান। ছিলেন প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্তা ধ্রুবনারায়ণ ঘোষ, ইতিহাসবিদ রীণা ভাদুড়ি, বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক দীপক ঘোষ, চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত হয়েছিলেন আইনজগতের দিকপাল অনিন্দ্য মিত্র, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। ছিলেন শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরি, চিকিৎসক ভাস্কর দাসগুপ্ত-সহ আরও অনেকে। এসেছিলেন শ্রীহট্ট সমিতির শক্তিবিকাশ রায়, সূতানূটি পরিষদের গোপীনাথ ঘোষ। সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মহানাগরিক তথা বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
আলোচনার শুরুতেই বিকাশবাবু মাইক্রোফোন তুলে দিলেন প্রবীন চিত্ততোষবাবুর হাতে, শুনতে চাইলেন ৭২ বছর আগের সেই ১৫ অগস্টের স্মৃতি। প্রাক্তন বিচারপতির উচ্চারণে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল নতুন ভারতের জন্মলগ্নের মূহুর্তগুলি। চিত্ততোষবাবু শোনালেন ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট দিল্লিতে স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা উত্তোলনের গল্প। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদকে করমর্দনের দূরত্ব থেকে দেখার স্মৃতি, সুচেতা কৃপালনির কণ্ঠে প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বন্দেমাতরম এবং তার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জাতীয় সংগীত শোনার দুর্লভ অভিজ্ঞতা। উঠে এল বাংলা ভাষায় রাজেন্দ্রপ্রসাদের অসামান্য দক্ষতার কথা।
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার শোনালেন দেশভাগের কান্নাদীর্ণ ইতিহাসের কথা। পূর্ববঙ্গের যে গ্রামে পবিত্রবাবুরা থাকতেন, সেখানে উড়েছিল পাকিস্তানের পতাকা। প্রথমে ভিটে ছাড়তে চাননি পবিত্রবাবুর গুরুজনেরা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা। প্রবীন শিক্ষাবিদের উচ্চারণে মিশে যাচ্ছিল চেনা পাড়া, চেনা মাঠ, চেনা পুকুরঘাট, আজন্মের সঙ্গী গাছপালা, প্রাণের সুজনদের ছেড়ে আসার যন্ত্রণা। বলছিলেন ট্রেন থামিয়ে নাকা চেকিংয়ের দুঃসহ স্মৃতি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে মানুষে মানুষে বেড়া উঠে যাওয়ার ইতিহাস। দুই বাংলার দোস্তালির বুক চিড়ে উঠে যাওয়া কাঁটাতার কী ভাবে দশক দশক ধরে রক্ত মেখেছে, বলছিলেন তার কথা। শল্য চিকৎসক দীপক ঘোষের অভিজ্ঞতাও কিছুটা একরকম। তাঁরা থাকতেন চট্টগ্রামে। কলমের এক খোঁচায় দুই টুকরো হয়ে যাওয়া বাংলার গল্প বললেন তিনি। জানালেন এক আশ্চর্য রেডিয়োও-ঘোষণার কথা। সেই সময় আকাশবাণীতে খবর পড়তেন বিভূতি দাস। দীপকবাবু শুনেছিলেন তাঁর ইতিহাস হয়ে যাওয়া ঘোষণা- ‘আমি বিভূতি দাস বলছি। রাত ১২টা। ভারত স্বাধীন হল!’
বুদ্ধদেব গুহর স্মৃতিচারণের বড় অংশ জুড়ে ছিল বাঙালির আশ্চর্য বীরগাথা। কী ভাবে বাঙালি নেতৃত্ব দিয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে, সেই ইতিহাসের কয়েক টুকরো উঠে এল তাঁর কথায়। প্রবীন সাহিত্যিকের এক কাকা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ঔপনিবেশিক শক্তিকে তাড়াতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাফেলায়। বুদ্ধদেববাবু বলছিলেন তাঁর বীরত্বের কথা। ব্রিটিশ পুলিশের থেকে আত্মগোপন করতে তিনি দাড়ি রেখেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট দেশ স্বাধীন হল, কিন্তু দাড়ি কাটতে রাজি হননি বুদ্ধদেববাবুর কাকা। বলেছিলেন, ‘যে স্বাধীনতা আমাদের বাংলাকে দু টুকরো করে দেয়, সেই স্বাধীনতার জন্য আমি দাড়ি কাটব না। যে দিন আমার দুই বাংলার মাজখানের কাঁটাতারের বেড়া উঠে যাবে, সেই পূণ্যলগ্নে আমি দাড়ি কাটব।’ বুদ্ধদেবের উচ্চারণের মিশে যাচ্ছিল বিষাদ, “আমার কাকার দাড়ি আর কখনও কাটা হয়নি…..”
আলোচনার বিষয় থেকে কি খানিকটা সরণ ঘটছিল গত সন্ধ্যায়, দেশভাগ আর দাঙ্গার মর্মান্তিক স্মৃতি কি আচ্ছন্ন করছিল বক্তাদের? অনিন্দ্য মিত্র তেমনটাই বললেন। বুকের গহনে প্রতিনয়ত ঘটে চলা রক্তপাত হয়তো সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়। অনিন্দ্যবাবুর কথায়, “আমরা থাকতাম বর্ডার এলাকায়, দু’দিকে দুই সম্প্রদায়। প্রচুর হানাহানি দেখেছি, দাঙ্গা দেখেছি, কিন্তু আর নয়। সে সব ভুলতে চাই আমি। ওই দুঃসহ অতীত পেরিয়ে বাঁচতে হবে বাঙালিকে।” সেই পেরিয়ে আসার দিশার খোঁজ করলেন অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর মতে, স্বাধীনতার আগে বাঙালি যতজন দিকপালের জন্ম দিয়েছে, স্বাধীনতার পরে সেই স্রোত যেন কিছুটা স্মিমিত। তবে আশার কথা, বহমানতাটি রয়ে গিয়েছে। তাই নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ সন্তান রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষচন্দ্রেরা যেমন প্রাক স্বাধীনতা কালপর্বে উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন বাঙালির গৌরবের নিশান, তেমনই স্বাধীনতার পরেও এসেছেন সত্যজিত রায়, রবিশঙ্করের মতো একঝাঁক দিকপাল। অশোকবাবুর কথায়, “আমাদের এই স্রোতকে আরও বেগবান করতে হবে। তা হলেই ফের বাঙালি তার হৃতসম্মান ফিরে পাবে।” সুতানূটি পরিষদের গোপীনাথ বাবুর উচ্চারণে যেন একুশ শতকের বাঙালির প্রতি ঈষৎ কটাক্ষ। বললেন, “আমরা যেন অনেকখানি বদলে গিয়েছি। ধুতি-পাঞ্জাবির মতো পোশাক বা নিজেদের অসামান্য পদগুলি এখন যেন নব্য বাঙালির কাছে কিছুটা ব্রাত্য। বাংলায় কথা বদলেও যেন লজ্জা পান অনেকে। এমন হলে কিন্তু শিকড়বিচ্ছিন্নতা অবশ্যম্ভাবী।” লন্ডনের বাসিন্দা চিকিৎসক ভাস্করবাবু মনে করিয়ে দিলেন তৃতীয়, চতুর্থ প্রজন্মের কাছে বাংলাভাষার মাধুর্য পৌঁছে দেওয়ার গুরুত্ব। বিচারপতি সমরেশ বন্দ্যোোপাধ্যায় অবশ্য প্রত্যয়ী। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ- “ফর্ম হয়তো বদলাবে, কিন্তু বাঙালি মরবে না, বাঙালিয়ানা থাকবেই।”
এই স্পর্ধাই হয়তো বাঙালির অভিজ্ঞান। গোটা বিশ্বকে আপন করেও নিজের শিকড় ছুঁয়ে বেঁচে থাকার এই প্রত্যয়ই হয়তো তার কবচকুণ্ডল। বৃহস্পতিবারের আলোচনার নির্যাস তেমনটাই।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।