৩রা জানুয়ারি দুপুর দেড়টা নাগাদ আমার নতুন চশমার কাচটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। মিনিট দুই পরে যখন অবস্থাটা অসহ্য হতে শুরু করল ঠিক তখনই আবার সব যে কে সেই। কিন্তু তারপরে অনেক খুঁজেও আমায় টেবিল থেকে একটা জিনিস কোথাও আর পেলাম না। জিনিসটা অতি সামান্য, একটা পাথরের পেপার ওয়েট, সবুজ আর কালো গ্র্যানাইটের মোটা গোল চাকার আকারের, মাঝখানে রিলিফে বৌদ্ধ বজ্র চিহ্ন। আজকাল পেপারওয়েটের চল আর নেই, তবে ওটা একজন দিয়েছিল। তার স্মৃতি হিসেবেই আমার কাছে ওর যা কিছু দাম ছিল। হারিয়ে ফেলে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আমার অফিসের আলমারিতে আরেকটা স্মৃতিচিহ্ন আছে, সেই তারই দেওয়া একটা আংটি, দর্জিলিঙের সবুজ আর কালো মেশানো পাথর বসানো। আংটির সঙ্গে ওইরকম পথরের একটা হার ছিল, সেটা তাকেই দিয়েছিলাম। এসব জিনিসের কথা কেউ জানে না। মা নয়, শ্রাবন্তী তো নয়ই।
আলমারি খুলে দেখলাম আংটি যথাস্থানেই আছে। কিন্তু অন্য জিনিসটার কোনও হদিস নেই! কী করব? আর গেলই বা কোথায়? ভেবে কোনও কূলকিনায়া পেলাম না। অগত্যা কাজে মন দিলাম। তবে মনের মধ্যে অস্বস্তি আর আফশোস রয়েই গেল।
অফিস থেকে ফেরার পথেই আমিনিয়ার দোকান। মনে হল অনেকদিন ওদের কাবাব খাইনি। মনের অভাব পূরণ করার জন্য সবচেয়ে ভালো ওষুধ মুখ চালানো। ঢুকে পড়ে নিজে খেলাম, বাড়ির জন্যও নিলাম। যা ভেবেছিলাম, মনটা আপনা থেকেই ভালো হয়ে গেল।
বাড়ি ফেরার পর কাবাব আর পরোটা এনেছি দেখে সবাই খুশি। বিশেষ ক’রে শ্রাবন্তী, ও এসব আবার খুব ভালবাসে। বেচারা!

৩রা গিয়েছিল, ৫ই ফিরে এসেছে। গতকাল আবার সেই একই সময়ে একই ঘটনা। চশমার কাচ ঝাপসা হল, আর চেষ্টা করেও না পারলাম মুছতে, না পারলাম খুলতে। মনে হল যেন কেউ চশমাটা আমার মুখের উপর চেপে ধরে আছে। আবার মিনিট দুই পরে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তখন দেখি হারনো জিনিসটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই বসে আছে।
কী একটা মনে হল। উঠে আলমারি খুলে দেখলাম এবার আংটি উধাও। এবার আর খোঁজ করার বেকার পরিশ্রমের প্রয়োজন বোধ করলাম না। কেন জানি না, তবে নিশ্চিত বুঝলাম খুঁজে লাভ নেই।
কী হচ্ছে এসব? এমন ব্যাপার যে কারও সঙ্গেই এ নিয়ে কথা বলার উপায় নেই। কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, জিনিসগুলো সম্বন্ধে কাউকে বলতে একদম চাইছিলাম না। নিজেকে কেমন কোণঠাসা লাগছে!
আর কাজে মন দিতে পারলাম না। মিস্টার অধিকারীর ফোনে একটা মেসেজ করে বললাম, শরীর খারাপ লাগছে, ওয়েবসাইট ডিজাইনের বাকি কাজটা আজ রাতের মধ্যেই বাড়িতে শেষ করে নেব। এসব নিয়ে ওঁর কোনও সমস্যা নেই। তাছাড়া উনি আমার উপর ভরসা রাখেন। তখনই উত্তর দিলেন “নো প্রবলেম”।
বেরিয়ে বুঝলাম আজ শুধু খাবার দিয়ে হবে না, আরও কড়া ওষুধ লাগবে। অফিসের কাছেই কয়েকটা বার অছে কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়ার সময় অফিসের কারও চোখে পড়ার সুযোগ আছে। তাই একটা ট্যাক্সিতে অফিস আর বাড়ির মাঝামাঝি একটা বারে হাজির হলাম।
যখন বেরোলাম তখন সন্ধে সাতটা। একটু দেরি হল। তাছাড়া মুখে মদের গন্ধ। ঠিক আছে, বাড়িতে বলব অফিসে একটা বড় ডিল থ্রু হল, তাই পার্টি ছিল। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বড়জোর মা বলবে, “ওসব একটু কম খাস”, শ্রাবন্তী বলবে “ও বুঝেই খায়, মা।” ব্যাস।

রাতে ঘুম ভালই হত, কিন্তু শেষরাতে একটা বাজে স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, একটা কাঠের বাড়িতে একটা ডাবল বেডে শুয়ে আছি। ঘরের চেহারা দেখে মনে হল পাহাড়ি এলাকার কোনও হোমস্টে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতে গিয়ে মনে হল পর্দার বদলে অন্য কিছু একটা ঝুলে আছে। বিছানা ছেড়ে উঠে কাছে গেলাম। দেখি একটা কাটা হাত। নিটোল ফর্সা এই হাত আমার চেনা। কাটা, কিন্তু একফোঁটা রক্ত কোথাও নেই, ঠিক যেন গ্রাফিক কাট অ্যান্ড পেস্ট।
অন্যদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেদিকের জানলাতে আরেকটা হাত ঝুলে আছে। পাগলের মতো এদিক ওদিক চাইতে গিয়ে চোখ পড়ল খাটের নীচে, দেখলাম দুটো ধবধবে পা হাঁটুর নীচ থেকে কাটা, যেন সাজিয়ে রাখা আছে।
বিছানায় আমার পাশের বালিশে রাখা আছে একটা মাথা, একঢাল খোলা চুল কিন্তু নাক-কান-চোখ-ঠোঁট কিছুই নেই। ডিমের মতো নিটোল ফর্সা। ধীরে ধীরে সেই মুখে একে একে ঠোঁট, কান, নাক, সবশেষে দুটি বোজা চোখ ফুটে উঠল। এই মুখ অমি খুব চিনি, একে আমি ভুলে যেতে চাই।
আস্তে আস্তে চোখের পাতাদুটো কেঁপে উঠল। এবার খুলবে, আমার দিকে তাকাবে। ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে দেখলাম ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। জেগে দেখি, শ্রাবন্তী আমার দিকে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে। বললাম “সব ঠিক আছে। একটা খারাপ স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুমিয়ে পড়।”

অফিসে দেড়টা নাগাদ আবার সেই কাণ্ড। এবার সব পরিষ্কার হল যখন, আলমারি খুলেই দেখি আংটির সঙ্গে হারটাও রয়েছে। একবার দুটোই হাতে নিয়ে দেখলাম। সদ্য খুলে রাখা গয়নার মতোই হালকা গরম। আপনা থেকেই জিনিস দুটো নাকের কাছে নিয়ে এলাম। খুব আবছা একটা সুগন্ধীর সঙ্গে মিশে আছে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। শরীরের মধ্যে কেমন একটা করে উঠল।
কী করে আসছে সে? কেন আসছে? এতদিন আসেনি কেন? কোথায় ছিল? কোথায় আছে এখন? জানতে চাই না। কিচ্ছু জানতে চাই না। ওই জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। এখন এইটাই আমার জীবন।
কাজের চাপ মনে হয় বড্ড বেশি নিয়ে ফেলেছি। ২৩শে জানুয়ারির সপ্তাহটা পড়ার আগে রিসর্টগুলো একটু ফাঁকা থাকবে। দুজনে চট করে অযোধ্যা পাহাড়ে একটা উইক-এন্ড কাটিয়ে আসি। মনে মনে ছকে ফেললাম, আমার চেনা এজেন্টের একটা ভালো জায়গা আছে।
শুক্রবার কনে-দেখা আলোয় এসে পৌঁছনো গেল রিসর্টে। উল্টোদিকের পাহাড়ের মাথা তখন কালো হতে শুরু করেছে আর রিসর্টের বাড়িগুলোর চাল পড়ন্ত আলোয় জ্বলজ্বল করছে। যা ভেবেছিলাম, এসময় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, আমাদের কটেজের দুপাশে আর কেউ নেই। শ্রাবন্তী ভারি খুশি।
শনিবার বিকেল অবধি দারুণ কাটছিল। বিকেলের দিকে একবার একা একা চারপাশটা একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। শ্রাবন্তীকে আলিস্যিতে ধরেছিল বলে ঘরেই শুয়েছিল। ফিরে আসতেই ছুটে বেরিয়ে এসে বলল, “এক্ষুনি ম্যানেজারকে বলো, আমি পাশের কটেজের সম্পর্কে কমপ্লেন করব। একটা অসভ্য মেয়ে এসেছে, জানলায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে আমাদের ঘরের ভেতরের সবকিছু দেখছে।”
“মেয়ে? পাশের কটেজে তো কেউ আছে বলে মনে হয় না।”
“বললেই হল। এতক্ষণ ধরে ওই জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল। এখন তোমাকে দেখে সরে পড়ল বোধহয়।”
“কেমন মেয়ে?”
“আমারই বয়সী হবে। দেখে মনে হচ্ছিল নেপালি বা নর্থ ইস্টের। বেশ ভালো দেখতে কিন্তু।”

মাথাটা ঘুরে উঠল। পাশের কটেজের দরজার দিকে তাকাতেই বুঝলাম ম্যানেজারকে ডাকার কোনও দরকার নেই। দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগানো। জানলাও সব বন্ধ। শ্রাবন্তীকে দেখাতে ওর মুখ সাদা হয়ে গেল, তারপর বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটা চাপতে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
কোনোমতে জিনিসপত্র গুছিয়ে সূর্য ডোবার আগেই ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর একটা ট্রেন ধরে কলকাতা। কোনও গাড়িতে নয়… অনেক লোকজন এখন চাই আমাদের।
বাড়ি ফিরে মা’কে বললাম শরীর খারাপ লাগছিল তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। কথাটা কিন্তু একেবারে মিথ্যে নয়। আমাদের দুজনের কেউই সুস্থ বোধ করছিলাম না। শ্রাবন্তী বেশি, ও তো নিজের চোখেই দেখেছিল তাকে। বিছানায় আসার পর মুখচোখের আতঙ্ক আর ঢাকার চেষ্টা করল না। বারবার বলতে লাগল, “ওই চোখদুটো আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।” শেষে ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে হল দুজনকেই।
রবিবার সকালটা আমার সাধারণত বেশ ভালো লাগে। এই রবিবারের সকাল এল একটাই চিন্তা নিয়ে, কাল অফিসে আবার কী হবে?
সমস্ত দিন আমরা দুজন দুজনের মুখোমুখি হলাম না, দুজনেই মা’র সঙ্গে যতটা পারি সময় কাটানোর চেষ্টা করে গেলাম। এমনকি দুপুরের খাওয়ার পরে নিজেদের ঘরে না গিয়ে মা’র কাছে বসেই গল্প করে কাটালাম। কিন্তু রাতের খাওয়ার পরে তো নিজেদের ঘরে যেতেই হল। কাল অফিস, তাই ঘুমের ওষুধ খেতেও পারব না। ঘুম আসবে না, আসবে না ভাবতে ভাবতেই কখন জানি না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙতে দেখি ভোর সাড়ে ছ’টা, শ্রাবন্তী আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড কষ্ট হল। তাছাড়া কিন্তু শরীরে আশ্চর্যভাবে আর কোনও গ্লানি নেই।

অফিস যাওয়ার সময় বেশ ঝরঝরে লাগল। ঠিক করলাম জিনিস তিনটেকে বিদেয় করতেই হবে।
অফিসে সারাদিন কোনও সমস্যা হল না। বিকেলের রোদ থাকতে থাকতেই বের হলাম, পকেটে জিনিস তিনটে নিয়ে। অফিসের কাছেই একটা নতুন কে এম সি’র ডাস্টবিন বসিয়েছে। ওটার পাশ দিয়ে হেঁটে উল্টোদিকের ফুটপাথের কাফের দিকে যাওয়ার সময় চট করে পকেটের জিনিস সব ওর মধ্যেই ফেলে দিলাম। উল্টোদিকে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই আমার চশমার কাচ পুরোপুরি সাদা হয়ে গেল। চশমাটা আমার চোখের উপর কে যেন চেপে রেখেছে আবার। তারপর আমার আঙুলে কেউ একটা আংটি পরিয়ে, পকেটে একটা কিছু ঢুকিয়ে দিল। বোধহয়, না বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই একটা পেপারওয়েট।
একটা হাত আমার কবজি মুঠো করে ধরেছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, তবে এই হাত, হাতের ছোঁয়া আমার চেনা, ভীষণ চেনা। আট বছর আগের জুন মাসের এক দিন সিপাইঝোরায় একটা ভেজা পাথরে পিছলে যাওয়ার মুহূর্তে এই হাত আমার কবজি ঠিক এইভাবেই শক্ত করে ধরে আমাকে বাঁচিয়েছিল। এই হাত আমায় টেনে নিয়ে চলেছে। আমি কোথায় চলেছি জানি না, অন্ধের মতো এগিয়ে চলেছি, কারণ জানি বাধা দিয়ে বা হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। শুধুমাত্র একটাই প্রাণপণ চেষ্টা— স্বাভাবিকভাবে হাঁটা, যাতে রাস্তার কেউ অদ্ভুত কিছু না ভাবে।
এভাবে কতক্ষণ চলল জানি না। ভেসে চলার মতো চলেছি কোথায় জানি না। শুধু বুঝতে পারছি ফুটপাথ বদল হয়নি। তারপর থামা। বুঝলাম সামনে একটা বড় দরজা খুললো। তারপর সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠা।
হঠাৎই আমার চশমা একদম পরিষ্কার হয়ে গেল। একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দরজার উপরে কাঠের নেমপ্লেটে একটা চেনা নাম। প্রেমা রাই।
দরজাটা কেউ খুলে দিল। তারপর সেই হাতটা আমায় টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। টের পেলাম, আমার পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।
একটা ঘর। জানলা সব বন্ধ, কিন্তু কাচের মধ্যে দিয়ে যা আলো আসছে তাতেই সবকিছু স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে। সাজানো ঘর। ঠিক মাঝখানে একটা সোফা। তাতে সোজা হয়ে বসে আছে বাজ পড়ে সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া একটা দেহ। একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছে। গলায় আমার দেওয়া সেই দার্জিলিং স্টোনের হার।
আর কিছুই আমার মনে নেই।
আলোকময় দত্ত ২০১৭ সালে সিনিয়র প্রফেসর পদে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজা রামান্না ফেলো হিসাবে সেন্ট্রাল গ্লাস অ্যান্ড সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে তিন বছর অতিবাহিত করেন। বর্তমানে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক।