(Story)
বাবা জিজ্ঞেস করলেন “এটা কি সরকারি চাকরি?”
সুজয়া হেসে উঠল, “না, না। একজন কড়া মহিলার কাছে আমরা চাকরি করি। তাঁর নাম বে এমারসন্ ব্যানক্রফট্। তিনি হচ্ছেন র্যাল্ফ্ ওয়াল্ডো এমারসনের নাতনির নাতনি। এঁরাই এই বাড়ির মালিক। বস্টনে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেন মিউজিয়ামের কাজকর্ম ঠিক মতো চলছে কিনা। তবে খরচপত্রের ব্যাপারে বেশ উদার। মাঝে মাঝেই তাঁর কাছ থেকে গীফ্ট পাই। দেখি, কতদিন এখানে থাকতে পারি।” (Story)
আরও পড়ুন: স্মৃতি ভবন ও জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)
গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাবা বললেন “তুমি তো একদিন আসতে পারো। ওয়েস্ট পোর্ট কি খুব দূর হবে? আমি অবশ্য আর মাসখানেক থাকব। যদি পারো একবার এসো।” (Story)
ভদ্রতা করে আমিও একই কথা বললাম। ফোন নম্বর ই-মেল অ্যাড্রেস দিলাম। সুজয়া বললো “দেখি, চেষ্টা করব। আমার ছুটি থাকে ‘থ্যাঙ্কস্ গীভিং’ আর ‘ক্রীসমাসে’এর দিন। ততদিন পর্যন্ত তো স্যার থাকবেন না।”
“আমরা থাকব। কখনও কালেটকাটে গেলে সময় পেলে কন্ট্যাক্ট করবেন।” (Story)

গাড়ি হাইওয়েতে পড়ার পর সুবীর বলল “আপনার ছাত্রী বনবাসে ভালই আছে মনে হল। সংসারের ঝুট ঝামেলা নেই। শুধু এমারস্ন আর হেনরি থরোর সঙ্গে ভূতবাংলোয় বসে ফিলসফি চর্চা! আপনার একটা ছাত্রী অ্যাটলিস্ট বে-লাইনে যায়নি।” (Story)
বাবা ওর রসিকতায় কান দিলেন না। নিজের মনেই বললেন “কি জানি? বনবাস না আত্ম নির্বাসন, সে কথা যার জীবন সে ই জানে। ও তো আরও পড়াশোনা করতে পারত। এ দেশে ওর দাদা আছে বলছিল। বিয়ে টিয়েও দেয়নি নাকি? তোমরা যে এত ‘অ্যাচিভ্মেন্টের’ কথা বলো, সুজয়াকে দেখে ঐ কথাটাই মনে আসছে।”
“বাবা দেশে চলে যাওয়ার কয়েক মাস বাদে সুজয়ার ফোন এল। নতুন চাকরি নিয়ে সময় মতো যোগাযোগ করতে পারেনি বলে লজ্জিত। সুজয়া বাবার কলকাতার ঠিকানা, আর ফোন নাম্বার চেয়ে নিল।”
গভীর অন্ধকারে এক প্রাচীন বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা পরবাসী মেয়েটির জন্যে বাবার মনে কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। যদিও জানি মানুষ হিসেবে বাবার চিন্তাধারা খুব গতানুগতিক নয়। মেটিরিয়ালিজম্, সাক্সেস আর অ্যাচিভ্মেন্টের ডেফিনেশন নিয়ে আমাদের সঙ্গে তাঁর তর্ক বিতর্ক হয়, তবু সুজয়াকে দেখে বোধহয় এ-কথাই ভাবছিলেন, ভাল ছাত্রী হয়ে ও যে আমেরিকায় আরও পড়াশোনা করেনি, প্রফেশনাল চাকরি, বিয়ে, সংসার কোনও কিছুই হয়তো যার বেঁচে থাকার আদর্শ রুটিন আনুযায়ী হয়নি, শুধু এক স্মৃতিঘরে আশ্রয় নিয়ে এ তার কেমন জীবন যাপন? (Story)
হতে পারে বাবার এতকিছু মনে হয়নি। অনেকটাই আমার অনুমান। বাবাকে বললাম “মহিলা বেশ তো আছে বাবা। একজন বন্ধুও রয়েছে। তুমি ভাবছ কেয়ার টেকারের চাকরি। সুজয়া হয়তো শখ করেই কাজটা নিয়েছে। বলছিল না, ওর মিউজিয়ামে কাজ করতে ভাল লাগে?” (Story)
বাবা উত্তর দিলেন “হবে হয়তো। বাঁধা রুটিনের বাইরের জীবনকে তো সেভাবে দেখা হয়নি।”
সুবীর বলে উঠল “কথাটা কোটেশন দিয়ে শেষ করুন। ‘যে, জীবন ফড়িং এর—-’
উত্তরটা কানে বাজল। তবে কি শনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভেঙে গেছে? সুজয়া বলছিল “দ্যাট্ ওয়াজ্ এ কাইন্ড অফ্ এক্সপেরিয়েন্স। আন্ড আই লাভ্ড্ দ্যাট!”
ওয়েস্টপোর্টে ফিরে আসার কিছুদিন পরে বাবার কথায় সুজয়ার ফোন নম্বরে ফোন করেছিলাম। এমারসন মিউজিয়ামের নতুন কেয়ার-টেকার জানাল সুজয়া পী-বডি মিয়ুজিয়ামে চাকরি পেয়ে চলে গেছে। কৌতূহল হলেও সুজয়ার সেই বনমালী শন্ এর কথা আর জিজ্ঞেস করিনি। (Story)
বাবা দেশে চলে যাওয়ার কয়েক মাস বাদে সুজয়ার ফোন এল। নতুন চাকরি নিয়ে সময় মতো যোগাযোগ করতে পারেনি বলে লজ্জিত। সুজয়া বাবার কলকাতার ঠিকানা, আর ফোন নাম্বার চেয়ে নিল।
আরও পড়ুন: স্মৃতি ভবন ও জীবন: প্রথম পর্ব
জিজ্ঞেস করলাম “এখন কোথায় থাকেন?”
“এক মহিলার বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়েছি। মিউজিউয়াম থেকে ডিস্ট্যান্স বেশি নয়।”
“এখন তাহলে আর মিউজিউয়ামে রাত কাটাতে হচ্ছে না।”
সুজয়ার গলার স্বর যেন ভারী শোনাল “নাঃ, ঐ এপিসোড শেষ।” (Story)
উত্তরটা কানে বাজল। তবে কি শনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভেঙে গেছে? সুজয়া বলছিল “দ্যাট্ ওয়াজ্ এ কাইন্ড অফ্ এক্সপেরিয়েন্স। আন্ড আই লাভ্ড্ দ্যাট!”

“হ্যাঁ, বাবাকে নিয়েও গিয়েছিলাম।”
“সেকি? স্যারের সঙ্গে তাহলে আমার দেখা হবে কোথায়?”
আমি হেসে উঠলাম “হয়তো নিউইয়র্কের কোনও মিউজিয়ামে। যদি বাবা আবার কখনও আসেন।” (Story)
সুজয়ার সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি। মাঝে একবার ওর ফোন পেলাম। বলছিল “স্যারকে আমি আর ফোন করতে পারিনি। দেশে যাওয়াও হয়নি। এমনভাবে সময় চলে যাচ্ছে, সবদিক ম্যানেজ করে উঠতে পারি না।”
“মাঝে আর কথা হয়নি। এক সন্ধ্যেবেলায় ইউ-টিউব-এ বাংলা ছবি দেখছিলাম। সুবীর আজ হস্পিটালে অন্-কল। কিছুক্ষণ আগে ফোন পেয়ে বেরিয়ে গেছে। ছবি দেখতে দেখতে ফোন বাজল…”
কী জানি কিসের ওর এত ব্যস্ততা? সংসারের দায়িত্ব তো ওর নেই। হয়তো পার্ট টাইম আরও কোনও কাজ-টাজ করে। বলার ফাঁকে সুজয়া বলল “একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কনকর্ডে এসে স্যার বোধহয় আমার সম্পর্কে একটু ডিস্যাপয়েন্টেড হয়েছিলেন?” (Story)
“কেন? পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন বলে? সে তো পুরোনো প্রফেসরদের বাঁধা প্রশ্ন। বাবা কিছু মনেও রাখেননি।”
সুজয়া উত্তর দিল, “আসলে, স্যার তো জিজ্ঞেস করতেই পারেন। ওঁর কাছে পরীক্ষার আগে কতবার নোটস্ নিতে গিয়েছি। তখন তো টিউশন ফী বলে কিছু ছিল না। আপনাদের বাড়িতেও গিয়েছি। আপনি বোধহয় তখন এ দেশে চলে এসেছেন।” (Story)

“তাইই হবে। শুধু বাবা নয়, আমার মামারাও ছিলেন ফিলোসফির লোক। প্রবাসে জীবন চৌধুরী, গোপীনাথ ভট্টাচার্য, কালিদাস ভট্টাচার্য, এদের কত ছাত্র ছাত্রী ছিল! টিউশন ফী নিয়ে পড়ানোর কথা এঁরা ভাবতেও পারতেন না।”
সুজয়া নিজের মনেই বলল “সে একটা যুগ ছিল।” (Story)
মাঝে আর কথা হয়নি। এক সন্ধ্যেবেলায় ইউ-টিউব-এ বাংলা ছবি দেখছিলাম। সুবীর আজ হস্পিটালে অন্-কল। কিছুক্ষণ আগে ফোন পেয়ে বেরিয়ে গেছে। ছবি দেখতে দেখতে ফোন বাজল। সুজয়ার নম্বর মনে থাকে না। গলা শুনে বুঝতে পারলাম।
“অনেকদিন ফোন করতে পারিনি। আপনারা ভাল? স্যার কেমন আছেন?”
“আছেন একরকম। মাঝে একবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাত ভাঙলো। এ বয়সে এ সব ভয়ই তো করে।”
“তবু ভাল, বড় ইন্জুরী কিছু হয়নি। আমি আসলে এত স্ট্রেসের মধ্যে থাকি! ভাবি কল্ করব। হয়ে ওঠে না। এনিওয়ে, নাউ উই আর সেট্লিং ডাউন।” (Story)
ওর কথার কোনও সূত্র ধরতে পারি না। একবার বলে খুব স্ট্রেসের মধ্যে আছি। এখন বলছে আমরা সেট্ল ডাউন করছি। এত সামান্য পরিচয়ে জানার আগ্রহও হয় না। গতবার ফোনে বলেছিল ওকে ‘আপনি’র বদলে ‘তুমি’ বলতে। বয়সেও ছোট।
জিজ্ঞেস করলাম “সেট্ল করছ বললে। কোথায়?”
“কুইন্সিতে একটা ছোট বাড়ি কিনেছি। শনের বাবা মা’র বাড়ির কাছাকাছি। ইনফ্যাক্ট আমরা লাস্ট ইয়ারে বিয়ে করেছি।”
“কন্গ্র্যাচুলেশান্স। লাস্ট টাইম বলেছিলে পী বডি মিউজিয়ামের কাছাকাছি কোথায় যেন রুমিং হাউজে আছো।” (Story)
(ক্রমশ)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
