Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

টু-প্লাস-টু

সৌরভ হাওলাদার

জানুয়ারি ৩১, ২০২৫

Bengali Story
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

ঘাটের ওপর নৈবেদ্য সাজানো সম্পূর্ণ। আরও কিছু জিনিসপত্র আছে, সেগুলো সিমেন্টের বেঞ্চে রাখা। যজমানেরা সবাই গোল হয়ে বসেছে। সামনে সততঃ প্রবহমান নদী। এবার নিজের আসন পেতে মাখন পন্ডিত বসতে যাবে, ঠিক তখন ঝড়ের মতো বাইক নিয়ে ঘাটে আসে এই গ্রামেরই প্রফুল্ল, ভবদেবের ছেলে। বাইক দাঁড় করিয়ে মাখনের কানের কাছে এসে আবছা গলায় বলে, “আপনি আমায় বাঁচান। বাবা একের পর এক মেয়ে দেখে চলেছে। কিন্তু আমি তো একজনকে ঠিক করেই রেখেছি।” (Bengali Story)

যেমন দ্রুত এসেছিল, তেমনি দুড়দাড় করে চলে যায় প্রফুল্ল।
মাখন এসে নিজের আসনে বসে শুরু করে,
“ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ বিষ্ণু, ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সুরয়ঃ। দিবীব চক্ষুরাততম্‌।
নমো অপবিত্রঃ পবিত্রোবা সর্ব্বাবস্থাং গতোহপি বা যঃ স্মরেৎ পুন্ডরীকাক্ষং সঃবাহ্য অভ্যন্তরঃ শুচি।।”

আরও পড়ুন: চুলচেরা

এর পর একমনে পুজো করে চলেছে মাখন পন্ডিত, যেন তার আগে তেমন কিছুই ঘটেনি। জলের ঢেউ ঘাটের সিঁড়িগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ছলাৎ ছলাৎ। মাখনের মন্ত্রোচ্চারণ একই সঙ্গে যজমানদের মনের মধ্যে তরঙ্গ তৈরি করে। সেই স্রোতে মিশে চলে সনাতনের শুভ অশুভ, সুখ দুঃখ, ভালবাসা ভাললাগা। নতুন মানুষের আবাহনে, বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা পুরানো মানুষের চলে যাওয়ায়, তর্পণ। মিলে যায় ধূপের ধোঁয়া, চন্দনের ঘ্রাণ, ফুলের সৌরভ। (Bengali Story)

Bengali Story

ঘাটের একদিকে পুজো চলছে, অন্য অংশে নিত্যকর্মে ব্যস্ত পাড়ার বৌ-ঝি-রা। কেউ বাসন মাজে, কেউ স্নান সারে, কেউ এক কড়াই কাপড় কাচতে বসেছে। কয়েকটা বাচ্চা ডাঙায়, একটু দূর থেকে দৌড়ে এসে সিঁড়ি ডিঙিয়ে ঝপাং করে জলে লাফিয়ে পড়ছে। জলের ফোঁটা ছিটকে ছিটকে ওঠে। ঘাটে কর্মরত লোকেদের গায়ে জল এসে লাগে। কেউ কেউ বিরক্ত হয়। বাচ্চাদের ধমকে ওঠে। (Bengali Story)

আরও পড়ুন: চা-পানের জার্নাল

মাখন পন্ডিতের এসব কানে আসে না। এক মনে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলে। তার গৌরবর্ণ, সুঠাম চেহারায় এক স্বাভাবিক আভিজাত্য প্রকাশ পায়। যজমানের দল সম্ভ্রমের মুদ্রায় বসে থাকে।
ছাতা মাথায় ভবদেব ঘাটে এসে উপস্থিত। বাঁধানো ঘাটের একপাশে সিমেন্টের বেঞ্চ। পিছনে একটা জারুল গাছ। বেগুনি ফুলের বাহার নিয়ে ছায়া দিচ্ছে। ছাতা ভাঁজ করে সেই ছায়াতে এসে বসে। বেশকিছু পুজোর সরঞ্জাম বেঞ্চির ওপরে রাখা ছিল। ভবদেবকে দেখে, একজন তড়িঘড়ি সব সরিয়ে দিয়ে ভাল করে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। (Bengali Story)

এ গ্রামের কেষ্টু বিষ্টুদের মধ্যে ভবদেব অন্যতম। পঞ্চায়েত সদস্য শশধর পর্যন্ত ভবদেবের কাছে পরামর্শ নিতে আসে। পুজো করতে করতে মাখন ভবদেবকে দেখতে পায়। ভব হাত নেড়ে ইঙ্গিত করে, “আমি আছি। তুমি কাজ সেরে নাও।”
কাজ শেষ হতে আরও আধঘণ্টা লাগল। সেই কোন কালে মাখন ইস্কুলে সংস্কৃত পড়াত, পন্ডিত উপাধিটা তখন থেকেই ওর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে। মাখন দক্ষিণার টাকা, দান সামগ্রীর পুঁটুলি, শালগ্রাম শিলা গুছিয়ে নিয়ে ভবদেবের পাশে এসে বসে, “বল ভাই, কী মনে করে?” (Bengali Story)

“আমার ছেলের একটা সম্বন্ধ প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। একবারটি তুমি যদি দেখে দাও।”
খানিক আগে প্রফুল্ল এসেছিল, সে কথা তার বাবার কাছে মাখন উল্লেখ করে না, বরং স্বাভাবিক গলায় বলে,
“পাত্রীর কোষ্ঠী এনেছো নাকি?”
“সে এনেছি, ঘরে আছে। তবে আমি চাই তুমি আমাদের সাথে পাকা দেখায় চলো। সামনা সামনি দেখে তোমার মতামত জানিও।”
গ্রামের মানুষের মনোযোগ পেতে, মাখনের ভাল লাগে। বিশেষ করে ভবদেবের মতো বিশিষ্টজন হলে তো কথাই নেই। হেসে হেসে বলে, “বেশ তো, দিনক্ষণ ঠিক করে আমায় জানিও।” (Bengali Story)

দুই পাকা মাথা ধীরে ধীরে নদীর ঘাট থেকে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। অনেকটা বেলা চড়ে গেছে, দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এল। প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে নেয় মাখন, বেশিরভাগ দিনই কোনও না কোনও যজমানের পুজোর জন্য উপবাস থাকে। একেবারে দুপুরের খাবার দিয়ে নিয়মভঙ্গ। (Bengali Story)

আরও পড়ুন: টিনা-টিয়া

ছোট একটু উঠোন, সুন্দর করে নিকোনো। এক পাশে তুলসী মঞ্চ। সেই উঠোন ডিঙিয়ে তিন কামরার ছোট একতলা বাড়ি। বছর তিনেক আগে কাঁচা থেকে পাকা করেছে তাপসী। মাখনের একমাত্র মেয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, এখন মুম্বাইতে থাকে।
মাখন নদী থেকে ভরে আনা জলের বোতল থেকে কিছুটা তুলসী গাছে ঢালে। আর উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করতে থাকে…

“মহাপ্রসাদ জননী, সর্বসৌভাগ্যবর্ধিনী, আধি ব্যাধি হরা নিত্য, তুলসী ত্বং নমোস্তুতে।”
মাখনের গলা শুনে স্ত্রী কৃষ্ণা বেরিয়ে আসে। তার হাসি মুখ দেখে মাখন অবাক হয়। তুলসীর গোড়া থেকে একটু মাটি নিয়ে নিজের কপালে টিপ পরে বলে, “কী ব্যাপার আজ যে বেশ খুশি খুশি লাগছে?”
কৃষ্ণা রহস্য করে বলে, “ভেতরে এসো, তবে তো জানবে খুশির কারণ কী?”
“আসছি আসছি, তবে তুমি ভাত বাড়ো, খিদে পেয়েছে জোর।” (Bengali Story)

ঘরে ঢুকে সত্যিই অবাক হয়ে যায় মাখন, ডাইনিং টেবিলে দুপুরের খাবার সাজিয়ে তাপসী অপেক্ষা করছে। এসব আধুনিক সরঞ্জাম তাপসী এনেছে। আগে তো মাটিতে বসেই খেয়েছে, নতুন বাড়ি তৈরির পর ডাইনিং টেবিল, সোফাসেট, গ্যাসের উনোন, ফ্রিজ একটা একটা করে কিনে ঘর সাজিয়েছে। (Bengali Story)

বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ লাফিয়ে ওঠে। হাতে ধরা জিনিসগুলো ঠাকুর ঘরে রেখে হাত পা ধুয়ে খাবার টেবিলে আসতে আসতে বলতে থাকে, “এমন ভাবে সারপ্রাইজ দেয়? খুশিতে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে।”
পিছন থেকে কৃষ্ণা বলে ওঠে, “ওমা! ও কী কথা? কোথায় মেয়ে এসেছে বলে সবাই আনন্দ করব না আজেবাজে কল্পনা করে চলেছে।”
অনেকদিন পর তিনজন একসঙ্গে খেতে বসেছে। কৃষ্ণা যথারীতি, তাপসীর বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে। বিয়ের কথা উঠলেই তাপসী প্রতিবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এবার বেশ নরম করে বলে, “খানিকটা সে কারণেই এবারে আসা।”
মাখন অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, “তবে আমরা খুঁজতে শুরু করি?” (Bengali Story)

তাপসী হাসে, “রেড ফ্ল্যাগ! টোটাল রেড ফ্ল্যাগ বাবা, তোমরা এখনও কোন যুগে রয়েছো? তোমায় খুঁজতে হবে না। আমি একজনকে বাজিয়ে দেখেছি। এবার মনে হয়, আমরা সংসার করতে পারি।”
কৃষ্ণা বিরক্ত হয়, “বাজিয়ে দেখছি? ও কেমন কথা? নিজের বর কে কেউ ওভাবে বলে?”
মাখন বলে, “বর বলছ কেন? বিয়ে হোক, তবে তো?”
তাপসী বলতে পারে না, বরুণের সঙ্গে আজ দুবছর লিভ-ইনে আছে।
মাখন বলে চলে, “ঠিক কাছে, ছেলের বাবা মার সাথে আলাপ করিয়ে দে, কথাবার্তা শুরু করি। মাঘ মাস শেষ হতে চলল, ফাল্গুনে অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, পেরে উঠব না। বৈশাখে আমাদের বিয়ের মাস, জ্যৈষ্ঠতে তোর জন্মমাস, আষাঢ়ের একটা দিন দেখেই আমরা ঠিক করব।” (Bengali Story)

কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে, “খাওয়ার পর পাঁজিটা নিয়ে বসছি।”
তাপসী বাবাকে বলে, “ঠিক আছে, ওর বাবা মা-র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তবে ওরা মারাঠী, মুম্বাইএ থাকে।”
“সেকী!” মাখন আর কৃষ্ণা একসাথে বলে ওঠে।
তাপসী বলে, “কেন মারাঠীরা খারাপ নাকি?” (Bengali Story)

আরও পড়ুন: শূন্যের মাঝার

মেয়ের সব আবদার রেখে তাকে উচ্চশিক্ষিত করিয়েছে মাখন, তাই আজ কোনও কিছুতেই বিরোধ করতে পারে না। শুধু গম্ভীর গলায় বলে, “তাহলে তোর বিয়েটা দেওয়ার জন্য আমি আমার গুরুভাই সদানন্দদাকে বলব। খুব সজ্জন মানুষ, যত্ন করে কাজ করেন। আমি তো সম্প্রদানে ব্যস্ত থাকব।”
তারপর, গলা তুলে বলে, “তোমরা নিজেরা পছন্দ করেছো, আমার কিছু বলার নেই। তবে বিয়েটা আমার মতো করে দিতে দিও। এই গ্রামে অনেকের বিয়ে দিয়েছি, নানা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছি আরও বেশি, তাদেরকে একবার বাড়িতে আপ্যায়ন করার সুযোগ দিও।”
হঠাৎই যেন তাল কেটে গেল। আর বাড়তি কোনও কথা না বলে, দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে আসে মাখন। (Bengali Story)

বাবার ইচ্ছেগুলোর ওপর না বলতে মন চাইছে না। ওদের বিয়েটা শুধু রেজিস্ট্রি করেই হবে, আর তা হবে মুম্বাইতেই। ম্যারেজ রেজিস্টারকে নোটিস দেওয়া হয়ে গেছে। অত দিনক্ষণ মাপামাপির প্রশ্নই নেই। তাপসী উত্তর করে না। আপাতত ওঁদের জন্য এটুকু ধাক্কাই যথেষ্ট।
বিকেলে মাখনের যজমানের বাড়িতে কাজ রয়েছে। সে সব শেষ করে বাড়ি ফিরছে, তখন আবার প্রফুল্লর সঙ্গে দেখা, “কাকা তোমার সাহায্য ছাড়া আমি বাঁচব না।” (Bengali Story)

Bengali Story

পথের মাঝখানে এইরকম কথা শুনে মাখন বেশ বিব্রত বোধ করে। আরেকটু এগোলেই মন্টুর চায়ের দোকানে, সেখানে হাট ফেরতা মানুষ বসে আছে। আছে মাঠের কাজ শেষ করা চাষীর দল। দিনের আলো প্রায় মরে এসেছে। নিভে আছে মাখনের মনও। দুপুরে তাপসীর অমন সপাট সিদ্ধান্ত ওকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রফুল্লকে খুব নরম স্বরে বলে, “বাবা, প্রত্যেকেই চায় তার সন্তান সুখী হোক। তাই তোমার বাবা মা তোমায় আঘাত করে কিছু করবেন না।” (Bengali Story)

“তুমি জানো না কাকা, আমার বিয়ে দেওয়া নিয়ে বাবা, এর মধ্যে প্রায় দশ বারোটা মেয়ে দেখে ফেলেছে, আর নানা রকম অজুহাতে তাদের খারিজ করেছে। তাই আমি ঠিক করেছি, আমার পাত্রী আমিই পছন্দ করব আর সে বিয়ে তুমিই দেবে।”
শেষ কথাটা শুনে মাখন খুশি হয়, গদগদ গলায় বলে, “বেশ তো! আমি নিশ্চয়ই তোর বিয়ে দেব।”
“না শুধু কথার কথা নয়। হয়তো বাবার অনুপস্থিতিতে বিয়ে দিতে হবে। কারণ বাবা এ বিয়ে মেনে নিতে পারবে না।” (Bengali Story)

আরও পড়ুন: লীলা মজুমদারের গল্প: পেয়ারা গাছের নীচে

এবার মাখন বেশ বিচলিত হয়ে পড়ে, তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করে, “চল চল আমাদের ঘরে চল। তাপসী এসেছে। চা খেয়ে যাবি।”
প্রফুল্ল খুব আনন্দ সহকারে রাজী হয়। দু’জনে গুটিগুটি বাড়ির দিকে যায়। ততক্ষণে সন্ধ্যা পার করে অন্ধকার নেমে এসেছে। গ্রামের রাস্তার দুপাশের গাছেরা নিজেদের পাতা দিয়ে ঢেকে রাখে আলো। পাখিরা নিশ্চুপে ডানা গুটিয়ে প্রহর গোণার অপেক্ষায় থাকে। (Bengali Story)

মাখনদের উঠোনে পা দেওয়ার আগে প্রফুল্ল আরেকবার বলে, “সত্যি বলছি কাকা, অখিলাকে না পেলে, আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনও পথ থাকবে না। তুমি বাবাকে বলে দেখো। তোমার কথা বাবা ফেলতে পারবে না।”
কথাটা শুনে মাখন ভেতর থেকে কেঁপে ওঠে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের প্রাণ নেওয়া যেন হাতের মোয়া, কত অনায়াসে বলে ফেলে, কেউ কেউ করেও ফেলে। মনে মনে ঈষ্টদেবতাকে স্মরণ করতে থাকে। (Bengali Story)

Bengali Story

তাপসী আর প্রফুল্লকে কৃষ্ণা চা করে দেয়। ছোটবেলার সাথী, দুজনেই প্রায় সমবয়সী। নিজেদের মধ্যে গল্পগাথায় ব্যস্ত হয়ে যায়। পাশের ঘরে এসে মাখন ভাবতে থাকে, নতুন প্রজন্ম থেকে কি ওরা অনেকটা দূরে চলে এসেছে? রাতে কৃষ্ণার কাছে নিজের কষ্টের কথা গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে, “মেয়ে আমার কাজ কমিয়ে দিয়েছে।” (Bengali Story)

কৃষ্ণা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “যে যুগের যা নিয়ম। প্রফুল্লও তো বলে গেল, ওর বাবা পছন্দ বা অপছন্দ করাকে আমল দিচ্ছে না।”
“ওদের জীবন, ওরা বুঝে নিক। তবে আমরা কি কেউ না?”
“মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছো। সে এখন সাবালক হয়েছে।”
“তাই বলে, শিকড়কে অস্বীকার করবে?”
“অত ভেব না। শুয়ে পড়ো।”
“ভাবনাগুলো তো ঘুমোয় না কৃষ্ণা, সেগুলো তাড়া করে।” (Bengali Story)

গ্রামের নৈঃশব্দ ভেঙে একরাশ পাখি ডেকে ওঠে। জানান দিয়ে যায় প্রহর পার হল। আজ মাখনের কিছুতেই ঘুম এল না। কৃষ্ণাকে আবার বলল, “মেয়েকে বুঝিয়ে বলো, অন্ততঃ বিয়েটা যেন এ গ্রামে করে, তাহলে আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীকে ডাকতে পারি। সারা জীবন তো কত মানুষের বাড়িতে শুধু নিমন্ত্রণ রক্ষা করেই গেলাম, কাউকে আমার বাড়ি ডাকার সুযোগ পাইনি। মেয়ের বিয়ের এটুকু আনন্দও কী জুটবে না?” (Bengali Story)

ভবদেব বলে, “আমার কিছু বলার নেই। ও যদি বিয়ে করতে চায় করুক। আমি সেই বিয়েতে থাকব না।

সকালে বটতলার কাছে মন্টুর চায়ের দোকানে শশধর, ভবদেবের দেখা পেল মাখন। দোকানে আরও কয়েকজন খদ্দের বসেছিল। তাদের কাছ থেকে ওদের একটু আড়ালে নিয়ে এসে বলে, “ভবদেব, প্রফুল্লর বিয়ে নিয়ে তুমি আর মেয়ে দেখো না।” (Bengali Story)

ভবদেব অবাক হয়, “সেকী? তোমায় নিয়ে পাকা দেখায় যাব, সেদিনই তো ঘাটে কথা হয়ে গেল।”
মাখন বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, প্রফুল্লকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে, কোন অঘটনও হতে পারে।
ভবদেব দৃশ্যতঃ ভেঙে পড়ে, “তবে তো আর কথাই চলে না। এরা সবকিছুতেই বাপ-মা-কে এই ভাবে ব্ল্যাকমেল করবে?”
মাখন নিজের মেয়ের কথাও বলে, বোঝানোর চেষ্টা করে, “আমরা এখন বাতিলের খাতায়। এরা নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু চেনে না।” (Bengali Story)

ভবদেব বলে, “আমার কিছু বলার নেই। ও যদি বিয়ে করতে চায় করুক। আমি সেই বিয়েতে থাকব না। তুমি যদি ওর বিয়ে দিতে চাও, দিতে পারো। আমি নেই।”
শশধর এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবারে বলে, “দেখো আইনত আমাদের করার কিছু নেই। তাই সামাজিকতার দিক দিয়ে আমরা যদি দূরে সরে থাকি, ক্ষতি আমাদেরই বেশি। আমাদের মানে আগের প্রজন্মের কথা বলছি।”
চায়ের দোকানের সামনে কয়েকটা ছানাকুকুর একসাথে এ ওর ঘাড়ে পেঁচিয়ে শুয়েছিল। ওদিকে তাকিয়ে শশধর বলে, “এদের দেখো, ছানাপোনা জন্ম দিয়ে, তারপর যার যার তার তার।” (Bengali Story)

আরও পড়ুন: অভিরূপের অভিনয়

মাখন বলে, “পশুর সাথে মানুষের তুলনা? চুরাশি লক্ষ যোনি পার করে তবে মানব জন্ম! তার সাথে পশুজন্মের তুলনা হয় না।”
কিছুদিন পর, মাখনের উঠোনে একটা দামি গাড়ি এসে ঢোকে। পাড়া প্রতিবেশী অবাক! কয়েকটা বাচ্চা একরাশ কৌতুহল নিয়ে গাড়ির পিছন পিছন বেড়ার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। মুম্বাই থেকে বরুণের বাবা দিলীপ শিরকে আর পুষ্পেন দত্ত নামে একজন এসে হাজির হয় মাখন পন্ডিতের বাড়িতে। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে এখানে এসেছে। পুষ্পেন পেশায় ইভেন্ট ম্যানেজার। ঘণ্টাখানেক আগে কৃষ্ণাকে, তাপসী ফোন করে জানিয়েছে, ওদের বিয়ের ব্যাপারটা পুষ্পেন দেখাশোনা করছে।

সাদামাটা পোশাক পরা দিলীপবাবুকে দেখে মাখন বাংলায় কথা বলতে শুরু করে। পুষ্পেন বুঝিয়ে দেয়, উনি বাংলা জানেন না, তাই দোভাষীর কাজটা ওকেই করতে হচ্ছে। পুষ্পেনের পরনে চকরমকর জামা, তার ওপর অজস্র পকেট দেওয়া একটা জ্যাকেট, এক কানে একটা ঝোলা দুল, মাথার পিছনে ঝুঁটি বাঁধা। মাখন, কৃষ্ণা এমন চরিত্র টিভির পর্দা ছাড়া কখনও সামনা সামনি দেখেনি। খানিকটা ইতস্ততঃ করে ওদেরকে ঘরে বসায়। হাজার হোক দিলীপবাবু হবু কুটুম, তার আপ্যায়ন করতে হবে। তাপসীর ওপর খুব রাগ হতে থাকে। মেয়েটা দু’দিন আগে জানালে, কিছু ব্যবস্থা করে রাখতে পারত।

পুষ্পেন নাটকের কায়দায় বক্তব্য রাখতে শুরু করে, “নমস্কার মাসীমা এবং মেসোমশাই। আপনার মেয়ে এবং জামাই আমাকে এই অসামান্য ইভেন্টের সমস্ত দায়িত্ব দিয়েছে। সেখানে সঙ্গীত, প্রিওয়েডিং শুটিং, ইনভিটেশন, লোকেশান থেকে শুরু করে রিং সেরিমোনি, রিসেপশন, ডিজে নাইট, হানিমুন পর্যন্ত সব কিছুর প্ল্যানিং আর এক্সিকিউসানের রেসপন্সিবিলিটি আমার অর্থাৎ আমার কোম্পানি টু-প্লাস-টু-কে দিয়েছেন। যার অর্থ দুটি মাইন্ড, দুটি বডি, ওয়েল্ডিং করে দিচ্ছি!” এমন লম্বা সংলাপ বলে, পুষ্পেন বেশ বড় করে শ্বাস নেয়।

মাখন এতগুলো ইংরাজি শব্দ শুনে কিছুই বুঝল না। একটু হাঁ করে থেকে জিজ্ঞেস করে, “বিয়ে তো এখনও হয়নি, জামাই কী করে হবে?”
পুষ্পেন একটু দম নিয়ে বলে, “আই মিন, হবু জামাই। কুল। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আপনারা জাস্ট টুক করে গাড়িতে উঠে পড়বেন। বাকি দায়িত্ব আমার।”

“কোথায় যাব?”
“কেন? বিয়েতে?”
“বিয়ে? কার?”
পুষ্পেন দম নেয়। বুঝতে পারে, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। আবার করে বোঝাতে শুরু করে।

অনেক কথাবার্তার পর অবশেষে ঠিক হয়, মুম্বাই ছাড়া কলকাতাতেও একটা রিঙ সেরিমোনি হবে সঙ্গে ডিজে-নাইট, বাকি অনুষ্ঠান মুম্বাইতে। প্রোডাকশান টিমের পক্ষে মাখনদের গ্রামে ইভেন্ট করা কঠিন। এখানে তেমন উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। অন্তত একটা বড় এসি ব্যাঙ্কোয়েট।

Bengali Story

এরপর পাঁজিপুঁথির সিলেবাসের বাইরে, একটা উইকেন্ডে কলকাতার উপকণ্ঠে এক বিলাসবহুল রিসোর্টের, একটি ব্যাঙ্কোয়েটের দরজার পাশে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, মাখন পন্ডিত আর পুত্রদায়গ্রস্ত, দিলীপ শির্কে-কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দুজনের গায়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া স্যুট, যা দেখে নাটকের কস্টিউম পরিহিত কাটা সৈনিক ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না, যারা নাটকের মূল ঘটনা প্রবাহের বাইরে দৃশ্যপট বা প্রপ-এর অংশমাত্র। মাখনকে সারা জীবন ধুতি নামাবলীতে দেখে, আজ চেনাই যাচ্ছে না। কৃষ্ণাকেও আসতে বলেছিল, কিন্তু কিছুতেই রাজি হয়নি। মেয়ের বিয়েতে মায়ের থাকতে নেই। সে সন্ধেবেলায় মেয়ের শুভ কামনায় ঠাকুরঘরেই কাটাবে।

একটু আগে পাত্র পাত্রী নিজেদের আংটি বদল করেছে। এখন চলছে, ওদের নিয়ে বন্ধু বান্ধবদের উদ্দাম ডিজে নাইট। অন্ধকার ঘরে লাল নীল আলো জ্বলছে নিভছে, তীব্র শব্দের দাপটে বাজছে হিন্দি গান, সেখানে ছেলেমেয়েরা নিজের নিজের মতো করে হাত পা ছুঁড়ছে। সঙ্গে ককটেল আর হুঁকো। মাখন জানে না এই অতিথিরা কারা? ওদের গ্রামের ছেলেমেয়ে নয়। কেউ কেউ নাকি মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর থেকে উড়ে এসেছে! তাপসী, বরুণের সহকর্মী বা বন্ধু হতে পারে। তাদের নাইট ক্লাবোচিত পোশাক, ঠিক বিয়ে বাড়ি বলে মনে হয় না। পুষ্পেনের কোম্পানির কর্মচারীরা টু-প্লাস-টু লেখা জার্সি পরে এই সব অতিথিদের আপ্যায়ন করছে। মাখন বা দিলীপের কোনও ভূমিকা নেই।

গ্রাম থেকে শশধর, ভবদেব সহ আরও কয়েকজনকে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের অনেকের হাতে ককটেলের গ্লাস আর টুথপিকে গোঁজা রেশমি কাবাবের টুকরো।
মাখনের কাছে এসে শশধর বলে, “তোমার জামাই তো বিরাট আয়োজন করেছে! আমি একবার পার্টির অনুষ্ঠানে এখানে এসেছি। একবেলার হলঘর ভাড়াই দেড় লাখ টাকা। সাথে খানা পিনা নাচানাচি আলাদা।”
ভবদেব বলে, “তুমি প্রফুল্ল-র বিয়েটা যেভাবে পারো দিয়ে দাও। আমার কোনও আপত্তি নেই, আমি নিজেও থাকব।” (Bengali Story)

মাখন কোনও উত্তর করে না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। এখানে তো বিয়েই হচ্ছে, অথচ যাগ যজ্ঞ মন্ত্রোচ্চারণ নেই। এতকাল ধরে মাখন পন্ডিত কত বিয়ে দিয়েছে! আজ নিজের মেয়ের সময়, ও যেন এই উজ্জ্বল ব্যাঙ্কোয়েট থেকে অনেক দূরে, ওর গ্রামের মাটিতে বসে আছে, সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছতোয়া স্রোতস্বিনী। মনে মনেই হোমের আগুন জ্বালিয়ে, বর কনে-কে সামনে রেখে, ওদের কল্যাণ কামনায় আবৃত্তি করতে থাকে,

”যদ্যেত হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।
ওঁ ভূর্ভুবস্ব তৎসবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গোদেবস্য ধীমহি
ধীয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।”

Author Sourav Haolader

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

Picture of সৌরভ হাওলাদার

সৌরভ হাওলাদার

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।
Picture of সৌরভ হাওলাদার

সৌরভ হাওলাদার

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস