কলকাতার বেথুন কলেজের উদ্যোগে প্যান্ডেমিক পরিস্থিতি এবং লকডাউনের বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব আলোচনা করতে সম্প্রতি তিনটে ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়েবিনারের বিষয় ছিল কালচর ও কমব্যাট। ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন স্বনামধন্য অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সাহিত্যিক তৃষ্ণা বসাক ও সঙ্গীতশিল্পী প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়। ওয়েবিনার সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বেথুন কলেজের অধ্যাপিকা ড. মৈত্রী ঘোষ। কলেজের অধ্যক্ষ ড. কৃষ্ণা রায় সমস্ত বক্তাদের স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। এই ওয়েবিনার গত ২রা জুলাই ইউটিউবে প্রকাশ করা হয়।
কোভিড-১৯ এর প্রভাবে গোটা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র আজ এক অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। শিল্প সাহিত্য পারফরমিং আর্টস, শিল্পের কোনও ধারাই এই পরিস্থিতির মোকাবিলার সঠিক পথ এখনও নির্দিষ্ট করতে পারেনি। কোভিড পরবর্তি পৃথিবীতে শিল্প কোন খাতে বইবে তার পর্যালোচনা করাই ছিল এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। ওয়েবিনারের তিন বক্তা তিনটে আলাদা শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন এবং দেখা গেল এঁরা প্রত্যেকেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে দেরিতে হলেও শিল্প তার দর্শক শ্রোতার কাছে ফিরবে। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।
যদিও স্টুডিও পাড়ায় শুটিং শুরু হয়েছে, প্রেক্ষাগৃহ খোলার ব্যাপারে প্রশাসন কোনও নির্দেশিকা প্রকাশ করেনি। শ্যুটিং শুরু হওয়ায় টেলিভিশনের ওপর জীবিকার জন্য নির্ভরশীল কলাকুশলীরা খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও, থিয়েটার, সঙ্গীত, নৃত্য ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের ভবিষ্যৎ এখনও খানিকটা অনিশ্চিত। বিশেষ করে থিয়েটার। ছোট পর্দার সিরিয়াল এবং সিনেমা দুইই এখন মোবাইল স্ট্রিমিং অ্যাপের মাধ্যমে দর্শকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু এই নতুন ধারার বিনোদন মাধ্যম কি নাটকের উপযুক্ত? জীবনধারণের জন্য শুধুমাত্র নাটকের ওপর নির্ভরশীল অভিনেতা, কুশলী যাঁরা, তাঁদের এখন কী অবস্থা, এসব বিষয়ের নিয়ে চর্চা করলেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
অনির্বাণের মতে, থিয়েটার একটা প্রান্তিক শিল্প যা কিনা মাঠের বেড়ার বাইরে দাঁড়িয়ে। বেড়ার ভেতরে সিনেমা, ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের মতো মাধ্যমদের অবস্থান। “থিয়েটার যখনই জন্মায় সে জানে দু ঘন্টা পরা তার মৃত্উ হবে। কিন্তু তাও সে জন্মায়। একই থিয়েটার প্রতিদিন নতুন করে জন্মায়। তিনশো শো হলে তিনশোবার জন্মায় এবং তিনশোবার তার মৃত্যু হয়। এরকম অমোঘ মানসিক বা মানবিক বিজ্ঞান যে শিল্পের সঙ্গে ওপপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেই শিল্পের সামনে যখন কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক এসে দাঁড়ায়, কোনও সন্দেহ নেই সে ঘাতকের রূপ নেয়।” হিসেবের খাতায় থিয়েটার একটা অলাভজনক শিল্প, অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা পিছিয়ে পড়া শিল্প এবং সেই কারণে এই প্যান্ডেমিক অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে। যতদিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, পৃথিবী পুরনো ছন্দে ফিরছে, এর সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরা যাতে একেবারে তলিয়ে না যান, বাকিদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে। এবং অপেক্ষা করতে হবে। স্বাভাবিকতা ফিরলেই থিয়েটারও ফিরবে।
এই প্যান্ডেমিকের ভালো দিক হিসেবে নলেজ শেয়ারিং-এর নানা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের খুলে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুললেন তৃষ্ণা বসাক। প্রযুক্তির এবং মানুষের চরিত্রের অনেক নতুন দিক এই সময় প্রকাশিত হয়েছে, হয়ে চলেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে ইবুক ছেড়ে মলাটবন্দী বইয়ের কাছে ফিরে গেছে পাঠক কারণ ওঁর মতে, “বইয়ের মধ্য়ে য়ে শুশ্রুষাটা রয়েছে, ডিজিটাল বইয়ে তা নেই।” আবার লকডাউন কৌতুককে উপযুক্ত জমি তৈরি করেছে তাই ‘নকশা’ অথবা স্যাটায়ার লেখার এটা উপযুক্ত সময়। ‘হুতোমের নতুন নকশা’ শীর্ষক নকশার অংশবিশেষ পাঠ করে দর্শকদের শোনালেন তৃষ্ণা। লকডাউনে কচুরি জিলিপি কিনতে বেরিয়ে নকশার প্রধান চরিত্রের পর্যবেক্ষণ, “হাবুর চায়ের দোকান খুলিতেছে না বলিয়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে। আমি ভাবিলাম হাবুদাকে বলিয়া য়াই, চা না বিক্রয় করুক, অনলাইনে জ্ঞানবাণীটা অন্তত চালু করুক।” লকডাউন পরবর্তি সময়ে সকলের সঙ্গে দেখা হবে এবং নির্দ্বিধায় একে অপরের “হাত ছুঁতে পারব” এমনই আশা রাখেন তৃষ্ণা বসাক।
রবীন্দ্রনাথের যেতে যেতে একলা পথে গানের হাত ধরে নিজের বক্তব্য শুরু করেন সঙ্গীতশিল্পী প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে শিল্পীদের নিজেকে জানা, এবং নিজের শিল্পকে জানার প্রয়াস শেষ হবে না। প্রযুক্তিকে সমান গুরুত্ব দিয়েও লাইভ অনুষ্ঠানের বিকল্প হিসেবে অনলাইন প্যাটফর্মকে মেনে নিতে তিনি নারাজ।
ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারী প্রত্যক বক্তাই লকডাউন পরবর্তি পৃথিবীতে সমস্ত শিল্পেরই পুরনো মহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার ব্যাপারে আশাব্যঞ্জক রকমের নিশ্চিত। এই গোটা ওয়েবিনারটা অত্যন্ত সাবলীলভাবে সঞ্চালনা করলেন বেথুন কলেজের অধ্যাপিকা ড. মৈত্রী ঘোষ।
পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায় আকারে স্থূল, প্রকারে কুল এবং জোকার-এ মশগুল। ভালোবাসেন মার্ভেল, ডিসি, আর যা কিছু ফিশি। পূর্বজন্মে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে বাংলার নেশায় বুঁদ। পরজন্মে গল-দের গ্রামে খোলা আকাশের নীচে গোল টেবিলে নৈশভোজের আসরে বসে বুনো শূকরের রোস্ট খেতে চান।