আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮][১৯][২০] [২১]
আমার স্বপ্নের শহর কলকাতা। এই শহর মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। সেই স্বপ্ন নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি। স্বপ্ন কখনও বাস্তব। কখনও অলীক। তবুও স্বপ্ন দেখি, দেখাই। কারণ স্বপ্ন না থাকলে বাঁচা বৃথা। পাওয়া না পাওয়ার এই দোলাচলের শহর, এই জীবন। আসলে এইতো জীবনাবর্ত, এই জীবন। যেমন ২৯ জুন ২০২৪ যা ঘটল। গত কয়েক মাস ধরে দেখা স্বপ্ন সত্যি হল। T-20 World championship cricket Trophy জিতল ভারত। আমার ভারত। না পাওয়ার জীবনে সবকিছু ভুলিয়ে দিল এই বিজয়। ছোটো, বড়, বুড়ো, মাঝবয়সী সবাই রাত ১১টা/সাড়ে ১১টায় মিলিত স্বরে বলে উঠল ইউরেকা! অসময়ের দীপাবলিতে ঝলমলিয়ে উঠল কলকাতার মিশকালো আকাশ। বড় বড় জতীয় পতাকা নিয়ে বাইক বাহিনী, দ্রুতগামী চার-চাকা, শয়ে শয়ে পথচারীর উচ্ছ্বাসে হঠাৎ যেন পাল্টে গেল গোমড়ামুখো, ঝিম ধরানো এই শহরটা, হ্যাঁ এমনই হলাম আমরা, আমরা সবাই। বড় বড় নেতা, ব্যবসাদার, ফুটপাতের ঘরছাড়া বাসিন্দা, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত সবাই তখন এক হয়ে সমস্বরে বলে উঠল- India Wins, চাক দে ইন্ডিয়া। স্বপ্ন দেখানোর শহর, রূপকথার শহর এই কলকাতাই আমার সব। এখানেই আমার স্বপ্নরা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও তারা সত্যি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।

এইরকমভাবে অনেক না দেখা স্বপ্নও সত্যি হয়ে যায়। আমি বারবার বলি গান আমার অনেকখানি জুড়ে আছে। এই গান আমাকে অনেকগুলি মানুষের কাছে নিয়ে এসেছে। এই গান দিয়েই অনেক রুদ্ধদ্বার আমার সামনে খুলে গেছে অবলীলায়।
-ইন্দ্রাণী(Indrani Bhattacharya) গানটা আপনি যদি মন দিয়ে গাইতেন একদিন প্রথম সারির শিল্পীদের পাশে জায়গা হত আপনার। এত উদাসীন কেন আপনি? অবিচার করছেন নিজের উপর। বারবার মনে হয় সমরেশ দা’র কথা- সমরেশ মজুমদার। সুনীলদা। শক্তিদা, সন্তোষদা, পূর্ণেন্দু পত্রী আরও কত যে গুণীজনের প্রশংসা, উৎসাহ আমার ঝুলিতে আছে, বলে শেষ করতে পারব না। বলতে গিয়ে, লিখতে গিয়ে সঙ্কোচও হয়। নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছি। কিন্তু কী করব? আত্মজীবনী লিখতে গেলে তো এর থেকে রেহাই নেই।

২৫ বৈশাখ বারবার আমার জীবনে খুব Special হয়ে এসেছে, আগেও লিখেছি। আবারও বলছি। সামনে তো কটা অনুষ্ঠান আছে। একক, সম্মেলক, অনেকের সঙ্গে একটা বা দুটো গান। ঐ যা হয় আর কী কবিপক্ষে। গানগুলি নিয়ে ভাবছি, পড়ছি, লিখছি, ল্যান্ডফোন বেজে উঠল, ধরলাম।

-“আপনি কি ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য বলছেন?” মনে হয় কোনও অল্প বয়সী মেয়ের গলা।
-“হ্যাঁ। বলছি।”
ফিসফিস শুনতে পেলাম। -“বাবা, ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য।”
-আপনার সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য কথা বলবেন।
-আমি বেশ বিরক্ত হলাম। আবার কে ফাজলামি করতে বসল।
-“আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য বলছি।”
আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবলাম-গলাটা তো আমাদের Chief Minister-এর মতোই লাগছে।
থতমত খেয়ে কিছুই বললাম না।
-“আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য বলছি।”
আমি কোনও মতে বললাম-
-হ্যাঁ বলুন।
– আপনি এত ভালো গান করেন? একদম ইফফাত আরা খানের মতো।

আমার তখন ন যথৌ ন তস্থউ অবস্থা। আনন্দে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। উত্তেজনায় প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছে।
এ আমি কী শুনছি। আমার ভীষণ শ্রদ্ধা আর পছন্দের মানুষ আমার গানের প্রশংসা করছেন?
আমার খুব ভালো লাগার শিল্পী ইফফাত-এর গান-এর সঙ্গে আমার গানের তুলনা! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
কোনোমতে বললাম-
“আপনার ভালো লেগেছে! ইফফাতের মতো অত ভালো! আমি তো ওর গান খুব শুনি। খুব ভালোবাসি।”
– “হ্যাঁ। আপনি এত অসাধারণ গান করেন। কিন্তু আগে শুনিনি কেন? খালি তো খবর পড়েন। গান? সেটা কেন করেন না?”
– “আপনার ক্যাসেটটা পাওয়ার পর শোনা হয়নি। তা প্রায়- মাস দুয়েক হয়ে গেল। বিনয়দা (বিনয় চৌধুরী) চলে গেলেন। মনটা খুব খারাপ। ভাবলাম আপনার ক্যাসেটটা শুনি। শুনে সত্যি বলছি খুব ভাল লাগল। ভাবলাম ফোন করি। অংশুর কাছে আপনার নাম্বার নিয়ে ফোন করছি।”
আমি স্থাণুর মতো ফোন কানে নিয়ে শুনে যাচ্ছি। আনন্দে আমার সারা শরীর পাথরের মতো ভারী হয়ে আসছে। আমার শ্রবণকে সত্যি বিশ্বাস করতে পারছি না।

-“প্রত্যেকটা গান এত ভাল গেয়েছেন। Selection-ও খুব ভাল।”
– আপনি কবিপক্ষে আমাদের অনুষ্ঠানে গান করেন?
– না তো। কেউ বলেননি তো।
– আপনি গাইবেন? এইবারের ২৫ বৈশাখের অনুষ্ঠানে? রবীন্দ্র সদনে?
– আমি তো আমার কানকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এ তো দৈববাণী। কোনওমতে বললাম, হ্যাঁ।
– ‘আচ্ছা, বলে দিচ্ছি, ওরা আপনাকে ফোন করবে, কথা বলে নেবেন, গানটা seriously করুন। খুব ভাল গান শুনলাম, খবর পড়ুন, গানটাও করুন, আরও রেকর্ড করুন,’
ফোন কেটে গেল।
আমি বহুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য সবাই জানেন, সংস্কৃতিমনস্ক-ব্যক্তিত্ব গান ভালোবাসেন। শিল্পীদের খুব সম্মান করেন।
অসাধারন আবৃত্তি করেন, লেখক প্রতিবাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ভ্রাতুস্পুত্র। রাজনীতির সঙ্গে খেলাধুলোর খবরও রাখেন। আমি ওঁর একটা ছবি একবার খবরের কাগজে দেখেছিলাম, ধুতি পরে ফুটবলে শট দিচ্ছেন। বিশিষ্ট ভদ্র মানুষ, পরবর্তীতে খুবই বন্ধুত্ব হয় ওঁর সঙ্গে আমাদের। বলেছিলেন, “রবীন্দ্র সঙ্গীত খুবই ভালোবাসি, কিন্তু গাইতে পারি না। কিন্তু তিনশো গান আমার মুখস্থ।”

দুই বাংলার শিল্পীদের সঙ্গেই ওঁর এবং ওঁর পরিবারের সখ্য কারোর অজানা নয়। ওঁর স্ত্রী মীরাদি’র মাধ্যমে এখনও ওঁদের খবরা-খবর পাই, প্রতি বছর ১ মার্চ ওঁর জন্মদিনে বই, ফুল দিয়ে আমরা শুভেচ্ছা জানাই। তিনি এখন নিজে বই পড়তে পারেন না তবে মীরাদি এখনও ওঁকে বই পড়ে শোনান।
আমার প্রথম সোলো অনুষ্ঠানে, রবীন্দ্র সদনে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য উপস্থিত ছিলেন। শেষ বেলায় একটা গানের অনুরোধও আসে তাঁর কাছ থেকে, আমি ওই গান দিয়েই সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ করি।
– “চৈত্রপবনে মম চিত্ত বলে
বাণী মঞ্জরী সঞ্চলিতা
ওগো ললিতা।।
তোমার লাগিয়া আছি পথ চাহি
বুঝি বেলা আর নাহি নাহি,
বনছায়াতে তারে দেখা দাও।
করুণ হাতে তুলে নিয়ে যাও-
কণ্ঠহারে করো সঞ্চলিতা
ওগো ললিতা…”
“পুড়ে যায় জীবন নশ্বর”-এই বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সই করে উপহার দিয়েছিলেন। বইটি ওঁর প্রিয় লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবন ও কাজ নিয়ে রচিত প্রবন্ধ।
রবীন্দ্র সঙ্গীত অনুরাগী, জীবনানন্দ দাশের কবিতার গুণগ্রাহী, বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ জ্ঞানী এই মানুষটি যখন ফোন করেন তখন আবার অবস্থা কীরকম হতে পারে সহজেই অনুমেয়। এবার মনে পড়ছে, আমাদের প্যারিসের বন্ধু সম্বিত সেনগুপ্ত কলকাতায় এসে ওঁর Advertisement Agency-Sunshine কোম্পানীর তরফে গগনেন্দ্র সংগ্রশালায় একটি product launch করে। সেখানে আমরা আমন্ত্রিত ছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য-ও আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন।
তখন সবেই ‘গাথানী’ থেকে আমার প্রথম ক্যাসেট বেরিয়েছে। ওই অনুষ্ঠানের পর আমি, আমার একটি ক্যাসেট তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিই। হাতে নিয়ে বললেন,
-‘ও আপনার ক্যাসেট বেরিয়েছে? আবৃত্তি?’ আমি কিছু বলার আগেই অংশু’দা, অংশু সুর পাশ থেকে বললেন-‘না না, ইন্দ্রাণী খুব ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়। এটা তারই ক্যাসেট।’

বুদ্ধদেব বাবু খুবই খুশি হলেন, বললেন, অবশ্যই শুনবেন। তারপর অবশ্য প্রায় দু’তিন মাস পর এই ফোন। ফোন কেটে যাওয়ার পরও আমি কতক্ষণ যে একইভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না।
সম্বিত ফিরল আবার ফোনের আওয়াজে, হ্যাঁ ক্রমাগত ফোন এসেই চলেছে, ২৫ বৈশাখে গান গাইবার ব্যাপারে।
কবে গাইব, কোথায় গাইব, কখন গাইব…
আমার জীবনের আর একটি অন্যতম দিন। আমি সরকারি অনুষ্ঠানে গাইবার আমন্ত্রণ পেলাম প্রথম। এরপর তো ইতিহাস, সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত রাজ্যের বাইরে, ভিতরে কত যে অনুষ্ঠানে গেয়েছি গুনে বলতে পারব না। ভালোবাসা, নিন্দা সব নিয়েই আমার এই সফর। চিরকাল কৃতজ্ঞই থাকব আমার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, কত ভাবে, কত বার যে নানা বিষয়ে ওঁর সাহায্য পেয়েছি, তাও হয়তো হাতের করে গোনা সম্ভব নয়।
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
One Response
বাহ! খুউব ভাল লাগলো আজকের লেখাটা। অনেক অজানা কথাও জানতে পারলাম। এটা ঘটনা যে আপনার প্রতিভার কোনো শেষ নেই। তাই একই সঙ্গে আবৃত্তি, গান, এবং আরো নানান নান্দনিক বৈচিত্রে বিধাতা আপনাকে নিজের হাতে সাজিয়েছেন। আপনি সত্যিই ধন্য! আপনাকে অনুরোধ, আপনি এই লেখাটা চালিয়ে যান প্লিজ! আপনাকে নতুন নতুন আঙ্গিকে প্রতিবার আরো নতুন করে চিনতে পারছি। অনেক ধন্যবাদ। আবার একমাস ধৈর্য ধরে থাকছি কিন্তু পরের পর্বটি পড়ার জন্য!!