আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮][১৯][২০] [২১] [২২]
হ্যাঁ যা বলছিলাম। আমাকে কবিপক্ষে গান গাইবার অনুমতি দিয়ে, মমতা তাঁর গানের প্রতি বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি ভালবাসার কথা নিঃশব্দে প্রকাশ করেন। একটা ফোন নম্বর দিয়ে আশ্বস্ত করেন। যখন তখন ঐ ফোনে চাইলেই আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে পাওয়া যাবে। এবং আমার যদি কোনও কিছু জানাবার থাকে খুব সহজেই তা জানাতে পারব। যদিও সেটা কখনোই সম্ভব হয়নি। কারণ ঐ ফোনের মালিক কোনওদিনও আমার ফোন রিসিভ করেননি। তিনি একটি টিভি চ্যানেলের মালিক। তাঁর নাম অনেক পরে জেনেছিলাম। তোমরাও চেনো তাকে। নামটা অবধারিত কারণেই বলছি না। (Indrani Bhattacharya)
মমতার সঙ্গে আমার ফোনের কথোপকথন শেষ হতেই, আশ্চর্যভাবে অনেক অজানা ফোন আসতে শুরু করল। মোবাইলে এবং ল্যান্ড নম্বরে, যেগুলো শুনছিলাম সেগুলো এইরকম মোটামুটি-
– আপনি কোন আক্কেলে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করলেন?
– কেন ৯, ১০ তারিখে ওঁর সঙ্গে দেখা করবেন না?
– গান গাইবার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সময় নেই?
– আপনার দ্বারা কিস্যু হবে না।
– এইরকম একটা সুযোগ কেউ ছাড়ে?
– যান, কালকেই গিয়ে অভিষেকের সঙ্গে দেখা করুন।
– ব্লা, ব্লা, ব্লা…
প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত সহ্য করে আমি বললাম-
আপনারা কে জানি না, আর কোনওরকম ফোন আমাকে করবেন না। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু এনাফ। আমি এবার ঘুমাতে যাব। কাল সকালে আমার T.V তে duty আছে। দয়া করে আপনারাও ঘুমাতে যান। আমি নির্দিষ্ট দিনেই মুখ্যমন্ত্রীর কথামত কালীঘাটে যাব। ওঁর সঙ্গে দেখা করব। মোবাইল সুইচ অফ করে এবং ল্যান্ডফোন ডিসকানেক্ট করে নিজেকে শুভরাত্রি জানালাম। ভোরবেলা ৫ টার মধ্যে উঠতে হবে। দূরদর্শনে মর্নিং শিফটের জন্য সকাল ৭টার মধ্যে T.V তে পৌঁছতে হবে। নিউজ সকাল ৮.৩০ এ। লাইভ।
১৯ শে মে, ২০১৭। সকালবেলা মমতার দেওয়া মোবাইলে ফোন করলাম। কেউ একজন ধরলেন। বললাম, আপনার ফোন থেকে ৪ মে মুখ্যমন্ত্রী আমাকে ফোন করেছিলেন। আপনার সামনেই উনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে আপনার নম্বরে ফোন করতে। আপনি দয়া করে জানান ওঁর কথামতো বেলা ১ টায় আজ কোথায় যাব?
খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর সেই ভদ্রলোক বললেন, জানাচ্ছি। কিন্তু সময় চলে গেল কোনও খবর আমি সেদিন ওঁর কাছ থেকে পাইনি। তারপর তিন-চার বার ফোন করেছি। কিন্তু মোবাইল বেজেই গেল।
বাধ্য হয়ে ডেরেক ও’ব্রায়েন কে ফোন করলাম। ডেরেক আমার পুরোনো বন্ধু। ও যখন টেলিগ্রাফে ছিল, তখন থেকে পরিচয়।
ডেরেক, আজ কোথায় যাব… সমস্ত ব্যাপারটা ও ধৈর্য্য ধরে শুনল-
ইন্দ্রাণী, আমি তো তোমার এই ব্যাপারটা প্রথম শুনছি। আমায় একটু দেখতে দাও।
সময় এগিয়ে চলেছে। কী করব কোনও হদিস করতে পারছি না। ১ টার মধ্যে যেতে হবে, কিন্তু কোথায়?
…এবার সুব্রত দাকে ফোন করলাম। সুব্রত মুখার্জী আমাদের বহুদিনের পরিচিত। ঘরের মানুষের মতো। যে কোনও সমস্যায় সুব্রতদাই আমাদের পরিত্রাতা…
– কী খবর? ইন্দ্রাণী বল।
ফোনের ওপাশ থেকে সুব্রতদা’র গলা। উনি নিজেই ফোন ধরতেন সবসময়।
– সুব্রতদা, মমতা আজ আমাকে দলে যোগ দিতে বলেছে। কোথায় যাব?
– সেকি! আমি তো কিছু জানি না।
আমি পুরো ঘটনাটা বললাম।
– কে তোমাকে রেকমেন্ড করেছে?
– জানি না, সুব্রতদা।
– তুমি join করবে?
– হ্যাঁ!
– তাহলে আমি তোমাকে যখন বলাগড় বা সোনারপুরের মহিলা সিটে দাঁড়াতে বলেছিলাম, তুমি রাজি হওনি তো, কেন?

আমি চুপ করে ভাবলাম। সত্যি, খুব সম্ভবত ২০০৬ সালে সুব্রতদা বারবার আমাকে MLA election-এ contest করতে বলেছিলেন। মমতা’র সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি খুব ভীতু মানুষ। অল্পে সন্তুষ্ট। গান গাইব। সংসার করব। খবর পড়ব। ব্যবসা করব। সবটাই নিজের হাতে। কখনও অনেক ওপরে ওঠার স্বপ্ন দেখিনি। যা হয়েছে, যেটুকু সুনাম, সবটাই ঈশ্বরের কৃপা। ইনি যেভাবে চালনা করেছেন, দিক দেখিয়েছেন। সেই ভাবেই চলেছি। আর রাজনীতি– আমার পরিবারের কাছাকাছি কাউকে দেখিনি ঐ বলয়ে। তাই ধারণা একদমই ছিল না। সুব্রতদা যখন জানান, আমাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে প্রার্থী হওয়ার জন্য। আমি সবিনয়ে, সভয়ে, না বলি। যদিও মা, বাবা, কর্তা কারুরই কোনও আপত্তি ছিল না, কিন্তু আমি রাজনীতি থেকে দূরেই থেকেছি চিরকাল। আমি বললাম-
– সুব্রতাদা এই নির্দেশ আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন। আমি না বলতে পারিনি। আর আমি এখন অনেক পরিণত এবং অন্যান্য দায়িত্ব থেকে অনেকটাই মুক্ত। তখন আমার মেয়ে ছোট। এখন সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়ে করেছে। তাই মনে হল এইবার আমি এই কাজে সময় দিতে পারব।
সুব্রতদা কিছুই বললেন না। ফোন রেখে দিলেন।
তৎকালীন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়’কে ফোন করলাম। শোভনও সব শুনে বলল, দিদি আমরা কেউ কিন্তু এ খবরটা জানি না। তুমি বাইপাসে নতুন তৃণমূল ভবনে চলে এসো। আমরা সবাই ওখানেই যাচ্ছি। মমতাদি ওখানে বেলা ১টায় আসবেন। তুমি আর কালীঘাটে যেও না। ওখানেই এসো।
কীভাবে যাব? ঠিক কোথায় নতুন ভবন, ও বুঝিয়ে দিল। আমি দেখলাম খুব বেশি সময় নেই। গাড়ি নিয়ে ঝড়ের গতিতে ১টা বাজার দশ মিনিট আগে ভবনে পৌঁছোলাম। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গেটের দিকে খুব তাড়াতাড়ি যাচ্ছি। হঠাৎ – দিদি ও দিদি এইদিকে তাকান। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রচুর ক্যামেরা। পুরো একটা ক্যামেরার দেওয়াল যেন ভবনের গেট অবধি পৌঁছে গেছে। কত মিডিয়া যে এসেছে ঈশ্বরই জানেন। তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে অজস্র আলোর ঝলকানি। আমি তো ক্যামেরা ফেস করছি সেই কত ছোটবেলা থেকে। কিন্তু এই যে ফ্ল্যাশ, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। আস্তে আস্তে বড় হলঘরে যখন পা রাখলাম কত চেনা মুখ। তার চেয়েও বেশি অচেনা চেহারা। দলের নেতা, মন্ত্রী, সাধারণ কর্মী সবাই, সবাই আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
শোভন, অরূপ এদের পাশে বসলাম। খুব অস্বস্তিকর লাগছিল। সবারই চোখে জিজ্ঞাসা চিহ্ন। এই সময় আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, আমার বহুদিনের চেনা মমতা সেই পরিচিত ছটফটে পায়ে হলে ঢুকল। আমার সামনে আসতে হেসে বললাম, এসেছি। ও হেসে এগিয়ে গেল।
মাইক হাতে নিয়ে বলল, আজ আমাদের দলে জয়েন করছে, টিভির পরিচিত মুখ ইন্দ্রাণী, ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য।
সবাই উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাল।
ইন্দ্রাণী আজ থেকে আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। ডেরেক, ডেরেক কোথায়?
ডেরেক সামনে এসে দাঁড়ান।
ডেরেক ইন্দ্রাণীকে দেখবে। ও এবার থেকে তোমার সঙ্গে কাজ করবে। ইন্দ্রাণী, ডেরেকের সঙ্গে তুমি কাজ করবে।
সবাই, সব্বাই চারপাশে আমার পূর্ব পরিচিত, কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম।
আমার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হল।
১৯ মে, ২০১৭।
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব